যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে তুমুল লড়াইয়ের পর এফসি গোয়াকে হারিয়ে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে উঠল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দ্বিতীয় সেমিফাইনালে এক গোলে পিছিয়ে থাকার পরেও পরপর দু’গোল করে নির্ধারিত সময়েই ২-১-এ জিতে খেতাবী লড়াইয়ে নামার যোগ্যতা অর্জন করে নিল তারা।

এ দিন দুই দলের মধ্যে আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণে লড়াই জমে উঠলেও ২৩ মিনিটের মাথায় নোয়া সাদাউইয়ের গোলে এগিয়ে যায় সাগরপাড়ের দল। গোল খাওয়ার পরেই আক্রমণের তীব্রতা ও নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে বিরতির তিন মিনিট আগেই পেনাল্টি থেকে সমতা আনেন জেসন কামিংস। বিরতির পরও দুই দলের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই জারি ছিল। ৬১ মিনিটের মাথায় আরমান্দো সাদিকুর দর্শনীয় গোল এগিয়ে দেয় মোহনবাগানকে। এর পরের ৪০ মিনিটে দু’পক্ষের লড়াইয়ের তীব্রতা চরমে পৌঁছলেও কোনও পক্ষই আর কারও জালে বল জড়াতে পারেনি।

এই জয়ের ফলে আগামী রবিবার মরশুমের প্রথম খেতাব জয়ের লড়াইয়ে সবুজ-মেরুন বাহিনী মুখোমুখি হতে চলেছে চিরপ্রতিদ্বন্দী ইস্টবেঙ্গল এফসি-র। অর্থাৎ আবার একটা কলকাতা ডার্বি। ষোলো বার করে ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুই ক্লাবই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে দুই প্রধান মুখোমুখি হয়েছে এগারোবার। পাঁচবার জিতেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী ও চারবার লাল-হলুদ ব্রিগেড। দু’বার অমীমাংসিত ভাবে ফাইনাল শেষ হওয়ায় যুগ্মজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয় দুই দলকেই। এ বার ঐতিহ্যবাহী ডুরান্ড কাপের ফাইনালে আবার সেই কালজয়ী ফুটবল-দ্বৈরথ, যা নিয়ে আগামী তিন দিন যে উন্মাদনার সীমা থাকবে না, তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

রবিবারের ফাইনাল যে প্রকৃত অর্থেই উত্তেজনায় ঠাসা এক ফুটবল-যুদ্ধ হতে চলেছে, দুই সেমিফাইনাল দেখেই বোঝা গিয়েছে। প্রথম সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল যেরকম লড়াকু ফুটবলে মাতিয়ে দেয় তাদের সমর্থকদের, এ দিনও মোহনবাগান সমর্থকেরাও বুঝে নিলেন, ফাইনালে লড়াই ছাড়া এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বে না তাদের প্রিয় দল।

আরমান্দো সাদিকুর জায়গায় দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে এ দিন শুরু থেকে মাঠে নামায় মোহনবাগান। কামিংস এবং তিনি ছিলেন আক্রমণের দায়িত্বে। সহাল, বুমৌস, আশিকরা ছিলেন তাঁদের পিছনে। বুমৌসকে এ দিন কিছুটা হলেও ফিকে লেগেছে। গোয়ার গোলটিও হয় তাঁর ভুলেই। যার ফলে বিরতির মিনিট দশেক পরেই তাঁকে তুলে সাদিকুকে নামান কোচ হুয়ান ফেরান্দো।

শুরু থেকেই গতিময় ফুটবল দেখা যায় দুই দলের পারফরম্যান্সে। চতুর্থ মিনিটেই প্রতিপক্ষের বক্সে ক্রস পাঠান ভিক্টর রড্রিগেজ। কিন্তু তা গোল পর্যন্ত পৌঁছনোর মতো কেউ ছিলেন না। নবম মিনিটে আশিক কুরুনিয়ান আক্রমণে ওঠেন, যা ওদেই ওনাইন্দিয়া আটকে দেন। এ ভাবেই আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণে ম্যাচের উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

১৬ মিনিটের মাথায় আশিকের ক্রস থেকে ভাল জায়গায় গোল করার মতো বল পেয়ে যান কামিংস। কিন্তু তিনি গোলে শট নিলেও তা গোয়ার দলের রক্ষণে আটকে যায়। এর পরের মিনিটেই ডান দিক থেকে বুমৌসের স্কোয়ার পাসে বল পান পেট্রাটস। সামনে ছোট জায়গা থাকা সত্ত্বেও গোলে শট নেন তিনি। কিন্তু গোয়ার গোলকিপার ধীরজ দুর্দান্ত সেভ করেন।

যে সময়ে ক্রমশ ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছিল মোহনবাগান, সেই সময় বুমৌসের এক ছোট্ট ভুলকে কাজে লাগিয়ে প্রথম গোল করে দেন নোয়া সাদাউই। মাঝমাঠে সতীর্থকে পাস দিতে গিয়ে অদ্ভূতভাবে তাঁর পায়ে বল তুলে দেন বুমৌস এবং সেই বল নিয়ে অনেকটা দৌড়ে বক্সের মাথা থেকে সোজা গোলে শট নেন ও জালে বল জড়িয়ে দেন তিনি (১-০)। হেক্টর ইউস্তে, আনোয়ার আলি-রা তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও পারেননি। এই নিয়ে ডুরান্ডে ছ’নম্বর গোল করে ফেললেন তিনি।

গোল পাওয়ার পর থেকে এফসি গোয়া ব্যবধান বাড়ানোর জন্য আরও তৎপর হয়ে ওঠে। ছোট ছোট পাসে নিজেদের মধ্যে বল রেখে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ নিজেদের হাতে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করে। ৩২ মিনিটের মাথায় ক্রস থেকে হেড করে গোল করার সুযোগ পান নোয়া। কিন্তু বলের গতি বেশি থাকায় তিনি সফল হননি। ৩৮ মিনিটের মাথাতেও নোয়ার জোরালো শট গোলে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে ক্লিয়ার হয়।

মোহনবাগান খুব বেশি প্রতি আক্রমণে ওঠার সুযোগ না পেলেও ৩৯ মিনিটে ডানদিক দিয়ে বল নিয়ে বক্সে ঢোকার চেষ্টা করেন আশিক। বক্সের ঠিক মাথায় তাঁকে ফাউল করেন জয় গুপ্তা, যার ফলে মোহনবাগানকে পেনাল্টি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রেফারি। পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতা আনেন জেসন কামিংস (১-১)। প্রথমার্ধের শেষ দিকে আক্রমণে ধার বাড়ানোর চেষ্টা করে মোহনবাগান। কিন্তু গোয়ার রক্ষণ তাদের চেষ্টা প্রতিহত করে। এ দিন বল দখলের লড়াইয়ে এ দিন অনেকটাই এগিয়ে (৬২-৩৮) ছিল গোয়া। গোলে শটও তারা বেশি নেয় (৫-৩)। কিন্তু আসল কাজের কাজটা করে উঠতে পারেনি।

বিরতির পরও মরিয়া গোয়ার চেষ্টায় কোনও ত্রুটি ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই নোয়া প্রতিপক্ষের গোলে শট নেন, কিন্তু বিশাল কোনওক্রমে তা আটকে দেন। এর পরে এক প্রতিআক্রমণে উঠে বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শট নেন রেইনিয়ে ফার্নান্ডেজ, যা বিশালের সামনে গিয়ে পড়ায় তিনি কিছুটা হলেও থতমত খেয়ে যান, তবে বাঁচিয়ে নেন। ৫২ মিনিটের মাথায় কর্নার থেকে পাওয়া বল বক্সের মধ্যে ভাসিয়ে দেন জয়, যা হেড করে গোলের দিকে বল পাঠান ম্যাকহিউ। এবারও বল ফের আয়ত্তে নিয়ে নেন বিশাল।

আক্রমণে ধারাবাহিকতা আনার জন্য বুমৌসকে তুলে সাদিকুকে নামায় মোহনবাগান বেঞ্চ। তার ফলে সন্দেশ, সেরিটনদের চাপ আরও বাড়ে। প্রতিআক্রমণে এফসি গোয়াও চাপ বাড়াতে থাকে। কিন্তু সাদিকুকে নামিয়ে যে একেবারে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন কোচ, তা তিনি নিজেই প্রমাণ করে দেন ৬১ মিনিটের মাথায়। মাঝমাঠ থেকে আসা বল সন্দেশের পা থেকে পিছলে গেলে সেই বল পেয়ে সোজা গোলে শট নেন আলবানিয়ান স্ট্রাইকার, যাতে এতটাই গতি ছিল যে, নড়াচড়াও করতে পারেননি তরুণ গোলকিপার ধীরজ সিং (১-২)।

পিছিয়ে যাওয়ার পর এফসি গোয়া সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ৬৫ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক থেকে নোয়ার ক্রসে ঠিকমতো মাথা ছোঁয়াতে পারলে হয়তো গোল পেতেন বরিস সিং। কিন্তু তিনি পারেননি। কর্নার থেকে সেরিটন গোলে শট নিলেও তা বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ৭২ মিনিটের মাথায় ফের গোলের সামনে বল পেয়ে যান রাওলিন বোর্জেস। কিন্তু চারদিক থেকে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা তাঁকে ঘিরে ধরায় তিনি ফিনিশ করতে পারেননি।

ব্যবধান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ৭০ মিনিটের মাথায় কামিংসকে তুলে মনবীরকে নামান মোহনবাগান কোচ। ৭৮ মিনিটে আশিকের জায়গায় লিস্টন কোলাসোকেও নামানো হয় এবং একই সঙ্গে রক্ষণকে আরও আঁটোসাঁটো করার জন্য অনিরুদ্ধ থাপার জায়গায় নামানো হয় ব্রেন্ডান হ্যামিলকে।

ম্যাচের শেষ দশ মিনিটে লড়াই আরও জমে ওঠে, দুই দলই আরও মরিয়া হয়ে ওঠায়। ৮১ মিনিটের মাথায় জয় গুপ্তার জোরালো দূরপাল্লার শট গোলে ঢোকার মুহূর্তে তালুবন্দী করে ফেলেন বিশাল। এ দিন সারা ম্যাচেই জয়ের পারফরম্যান্স ছিল নজর কাড়ার মতো। ৮৬ মিনিটে মনবীর ও ৮৭ মিনিটে সহাল গোলের সুযোগ পেলেও গোয়ার রক্ষণের তৎপরতায় দু’বারই ব্যর্থ হন তাঁরা।

আট মিনিটের বাড়তি সময়ের শুরুতেই ডান দিকের উইং থেকে আসা ফ্রি কিকে হেড করে যে গোলের চেষ্টা করেন জয়, তা দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতায় বিশাল আটকে না দিলে হয়তো এই সেমিফাইনালও টাই ব্রেকারে গড়াত। তবে নোয়া ফের চেষ্টা করেন গোলের। কিন্তু প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ভীড়ে আটকে যান। এই সময়ে সহালও ডানদিক দিয়ে উঠে বক্সে ক্রস পাঠালেও সাদিকুর দূর্বল শটে সে যাত্রায় সাফল্য পায়নি তারা। একেবারে শেষ মিনিটে রাওলিন বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শট নেন গোলে, যা অল্পের জন্য পোস্টের বাইরে দিয়ে চলে যায়। এর পরে আর ফল বদলানোর সুযোগ ছিল না এফসি গোয়ার পক্ষে।