আগামী কয়েক মরশুমে সিনিয়র দলের সাপ্লাই লাইন নিয়ে যে হয়তো বেশি ভাবতে হবে না মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে, তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল শনিবার, কলিঙ্গ সুপার কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। যে ভাবে তাদের ডেভলপমেন্ট দলের খেলোয়াড়রা আইএসএলে খেলা একটা পূর্ণশক্তির দলকে রীতিমতো আধিপত্য বজায় রেখে হারায়, তার পরে এই কথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

শনিবার ভুবনেশ্বরে কলিঙ্গ সুপার কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যে ভাবে সম্পুর্ণ নতুন কম্বিনেশন নিয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা সবুজ-মেরুন বাহিনী পূর্ণ শক্তির কেরালা ব্লাস্টার্সকে ২-১-এ হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে, তার কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

বিশেষ করে দলের জুনিয়র ও সিনিয়রদের মধ্যে যে রকম বোঝাপড়া দেখা যায়, তাতে একবারও মনে হয়নি এই দলটা এই প্রথম কোনও ম্যাচ খেলতে নেমেছে। একসঙ্গে অনেকগুলো ম্যাচ খেলার পরে যে রকম বোঝাপড়া গড়ে ওঠে একটা দলের মধ্যে, সে রকমই বোঝাপড়া দেখা গিয়েছে শনিবারের এই ম্যাচে।

ছ’দিন আগেই যে কেরালা ব্লাস্টার্স রীতিমতো দাপট দেখিয়ে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছিল, সেই দলটাকে এ ভাবে দমিয়ে রেখে হারাবে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের জুনিয়র ও সিনিয়র খেলোয়াড়দের এই মিশ্রণ, তা অনেকেই ভাবতে পারেননি।

শনিবারের ম্যাচের দলে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট আইএসএলের দলে থাকা সাতজনকে মাঠে নামিয়েছিল। অধিনায়ক দীপক টাঙরি, সহাল আব্দুল সামাদ, আশিক কুরুনিয়ান, দীপেন্দু বিশ্বাসরা আইএসএলে ভাল ম্যাচটাইম পেলেও ধীরজ সিং, অভিষেক সূর্যবংশী, আমনদীপ, সৌরভ ভানওয়ালা, সুহেল ভাটরা খুবই কম সময় পেয়েছে আইএসএলে। এঁদের বেশিরভাগকেই রিজার্ভ বেঞ্চে বসে কাটাতে হয়েছে পুরো মরশুম। সালাহউদ্দিন আদনানের মতো খেলোয়াড়রা যুব দলে

খেলেছেন, যাঁরা রিলায়ান্স ফাউন্ডেশন ডেভলপমেন্ট লিগে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন। এঁদের বেশিরভাগই এই ম্যাচে ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে।

এখন যাঁরা সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে আইএসএলের আসরে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকেন, সিনিয়র দলের অনুশীলনে নিয়মিত অংশ নেন, তাঁরাই যে ভবিষ্যতে আইএসএলের প্রথম এগারোয় নিয়মিত জায়গা করে নেওয়ার পথে এগোচ্ছেন, সেই ইঙ্গিতই পাওয়া গেল কলিঙ্গ সুপার কাপের প্রথম ম্যাচে। সুহেল ভাট থেকে শুরু করে অভিষেক, আমনদীপ, ধীরজ, সৌরভরা যে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তাদের পারফরম্যান্সেই তা বোঝা যায়।

কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ২১ মিনিটের মাথায় সহালের গোলে এগিয়ে যায় আইএসএলের জোড়া খেতাবজয়ীরা। ৫১ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন সুহেল ভাট, যাঁকে মাপা ক্রস দিয়ে প্রায় গোল সাজিয়ে দেন আশিক। সহালের গোলের আগে চমৎকার, মাপা ক্রসে তাঁকে অ্যাসিস্ট করেন সালাহউদ্দিন।

কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি অদ্ভূত ভাবে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের এই দ্বিতীয় সারির দলের কাছে মাথা নত করে। আক্রমণ, মাঝমাঠ ও রক্ষণ, কোনও বিভাগেই ছন্দ বজায় রাখতে পারেননি নোয়া সাদাউই, জেসুস জিমিনিজরা। প্রতিপক্ষের সুপরিকল্পিত ফুটবলের সামনে প্রায় আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায় তাদের। অবশ্য জিমিনিজ যে ভাবে একাধিক সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেন, তারই মাশুল তাদের দিতে হয় এই ম্যাচে হেরে। না তিনি সুযোগগুলি কাজে লাগাতে পারলে হয়তো স্কোরলাইন অন্যরকম হত।

বিশেষ করে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে যাঁরা রীতিমতো আগ্রাসী মেজাজে ছিলেন, সেই নোয়া সাদাউই ও জেসুস জিমিনিজকে কড়া পাহাড়ায় রাখার পরিকল্পনা নিয়ে শনিবার মাঠে নেমেছিল মোহনবাগান। তাদের ডিফেন্ডাররা এই দুই অ্যাটাকারকে যে ভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন সারাক্ষণ, তার প্রশংসা করতেই হবে। গোল খাওয়ার পরেই তা শোধ করার জন্য যখন ঘন ঘন আক্রমণে ওঠে ব্লাস্টার্স, তখনই প্রায় পুরো মোহনবাগান দল দ্রুত নেমে এসে রক্ষণে যোগ দিচ্ছিলেন। ফলে সংখ্যায় কমে যাচ্ছিলেন জিমিনিজরা। এ ভাবেই প্রতিপক্ষকে হতাশ করে তোলে তারা।

দলের স্প্যনিশ হেড কোচ হোসে মোলিনা দেশে ফিরে গিয়েছেন। তাই এই দলের দায়িত্ব মূলত সহকারী কোচ ও প্রাক্তন ফুটবলার বাস্তব রায়ের কাঁধে। এই পরিকল্পনা ও কৌশল তিনিই তৈরি করেন। মোলিনার আগে আন্তোনিও লোপেজ হাবাস ও হুয়ান ফেরান্দোদের সঙ্গেও কাজ করেছেন বাস্তব। তাঁদের সঙ্গে থেকে যে কৌশল, রণনীতি তৈরির ব্যাপারটা যে ভালই রপ্ত করেছেন বাস্তব, তা ভালই বোঝা যায় এই ম্যাচে।

এই টুর্নামেন্টে তারা যে খেতাব জয়ের লক্ষ্য ছাড়াও আর একটা লক্ষ্য নিয়েও এসেছেন এবং তা হল জুনিয়র ফুটবলারদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া, তা ম্যাচের আগের দিনও বলেছিলেন বাস্তব। তাই জেতা-হারার চাপ নিয়ে এই টুর্নামেন্টে আসেনি সবুজ-মেরুন বাহিনীর ছোটরা। চাপমুক্ত থাকার জন্যই হয়তো তারা নিজেদের সেরাটা দিতে পেরেছেন। কারণ, জিততেই হবে, এই চাপ নিয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেওয়ার মতো পরিণত এখনও তারা হয়ে উঠতে পারেনি।

সহাল, আশিক, টাঙরিদের মতো সিনিয়র খেলোয়াড়দের কাজ জুনিয়রদের সবরকম ভাবে সাহায্য করা। তাও তাঁরা ভরপুর করছেন। ফলে দলের মধ্যে একটা ভাল বোঝাপড়া গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। কলিঙ্গ সুপার কাপের প্রথম ম্যাচে সেটাই দেখা গিয়েছে।

দল সেমিফাইনালে ওঠায় অবশ্যই খুশি কোচ বাস্তব। তবে তা অন্য কারণে। সেই কারণ ব্যাখ্যা করে ম্যাচের পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “কঠিন ম্যাচ ছিল। আমাদের রিজার্ভ দলের খেলোয়াড়রা প্রত্যেকেই খুব ভাল খেলেছে। সেমিফাইনালে ওঠায় আমরা আরও একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছি, তাও টুর্নামেন্টের সেরা দলের বিরুদ্ধে, এ জন্যই আমি বেশি খুশি। কারণ, এর ফলে আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে। এই জুনিয়র ফুটবলারদের বড় ও শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করানোই এই টুর্নামেন্টে খেলার প্রধান উদ্দেশ্য আমাদের”।

দলের ফুটবলারদের প্রশংসা করে কোচ বলেন, “কৃতিত্ব পুরোপুরি ছেলেদের। ওরা ৯০ মিনিট ধরে সমান ভাবে লড়েছে। ওদের কুর্নিশ জানানো উচিত। যে দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে ওরা মাঠে নেমেছিল, এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। ওরা এত ভাল খেলেছে আজ যে, একটার বেশি পরিবর্তন করতেই হয়নি (সুহেল বাটের জায়গায় গ্ল্যান মার্টিন্স)। দলের সিনিয়ররা সব রকম ভাবে সাহায্য করেছে জুনিয়রদের। আমরা মাঠে সেরা পারফরম্যান্স দেখাতে পেরেছি বলেই জিতেছি”।

সহাল, আশিকদের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, “সিনিয়রদের আজ আমরা নামিয়েছিলাম জুনিয়রদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। আশিক, সহালদের সেই জন্যই নামানো হয়েছিল। ওরা সেই কাজটা ভাল ভাবে করেছিল। চার-পাঁচজন সিনিয়র খেলোয়াড়ের জন্যই দলের জুনিয়ররা আরও ভাল খেলল। তবে এই প্রক্রিয়াটা অনেক দীর্ঘ। এখনও ওদের অনেক পথ যেতে হবে। আশা করি, দু-তিন বছরের মধ্যে এদের সিনিয়র দলে খেলাতে পারব”।

দলের তারকা মিডফিল্ডার আশিক কুরুনিয়ান জুনিয়রদের মানসিকতার প্রশংসা করে বলেন, “মোহনবাগানে যখন থেকে যোগ দিয়েছি, তখন থেকেই মানসিকতা এমন তৈরি হয়ে গিয়েছে যে, মরশুমের শুরু থেকেই আমরা খেতাব জয়ের জন্য খেলি। প্রতি ম্যাচেই আমাদের খেলোয়াড়দের লক্ষ্য থাকে জয়। কোনও ম্যাচে অন্য কিছু করার জন্য আমরা নামি না”।

শনিবার দলকে নেতৃত্ব দেন যিনি, সেই দীপক টাঙরি বলেন, “আমাদের হারানোর কিছু ছিল না। কারণ, আমরা এখানে জুনিয়রদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিতে এসেছি। ওদের সাহায্য করতে আমরা, সিনিয়ররা এসেছি। সেটাই করছি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একশো শতাংশ দিয়ে জিতব। সব দল এ রকম টুর্নামেন্টে জুনিয়রদের সুযোগ দিতে পারে না। জুনিয়রদের প্রমাণ করার সুযোগ ছিল। ওরাও নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে”।

দলের আর এক তারকা ও গোলদাতা সহাল আব্দুল সামাদ বলেন, “আমরা সব ম্যাচেই জিততে নামি। প্রতি ম্যাচেই আমরা জয়ের খিদে নিয়ে খেলি। তাই জিততে পারলেই আমরা খুশি। দলের জয়ে অবদান রাখতে পারলে ভাল লাগেই। তাই আমি খুশি”।

ম্যাচের সেরা নির্বাচিত হন তরুণ মিডফিল্ডার সালাহউদ্দিন আদনান, যাঁর অসাধারণ ক্রসে প্রথম গোল করেন সহাল। সেই সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “এরকম একটা টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পাওয়াটাই বড় ব্যাপার। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পেরে ভাল লাগছে। দলের সিনিয়ররা, কোচেরা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। সে জন্য আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে খেলতে পারছি। সেমিফাইনালে আরও কঠিন লড়াই আমাদের সামনে। এর চেয়েও ভাল খেলতে হবে আমাদের। আশা করি, পরের ম্যাচেও জিতব”।

সালাহউদ্দিনের প্রশংসা শোনা যায় আশিক, টাঙরিদের মুখেও। আশিক বলেন, “সালাহউদ্দিন খুব ভাল খেলেছে। আমাদের সাহায্য করার কথা ছিল ওদের। আমরা করেছি। ওরাও ভাল খেলেছে। এ ভাবেই যেন খেলে যায় ওরা”। টাঙরি বলেন, “সালাহউদ্দিন ভাল খেলেছে। আমার মনে হয়, আরও সুযোগ পেলে ও আরও ভাল খেলবে”।

এই সাফল্যের মধ্যে সমর্থকদেরও ধন্যবাদ দিতে ভোলেননি সহাল। বলেন, “সমর্থকদের ধন্যবাদ, এখানে এসে আমাদের সমর্থন করার জন্য। সেমিফাইনালেও আশা করি, অনেকে আসবেন আমাদের জন্য গলা ফাটাতে। সমর্থকেরাই আমাদের ভরসা। তারা সঙ্গে থাকলে আমরা সফল হতে পারি। আশা করি, এখানেও পারব”।