ঘরের মাঠে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায় মোহনবাগান, জয়ে ফিরতে মরিয়া বেঙ্গালুরু এফসি
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে গত আইএসএল ফাইনালের রিপ্লে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। একদিকে জয়ের ছন্দ ধরে রাখতে মরিয়া মোহনবাগান এসজি। অন্যদিকে, জয়ে ফিরতে মরিয়া বেঙ্গালুরু এফসি।

নবাগত পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে জয় দিয়ে চলতি ইন্ডিয়ান সুপার লিগ শুরু করার পরে আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছে গত মরশুমের নক আউট চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। অন্যদিকে প্রথম ম্যাচেই কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি-র কাছে হারের ফলে কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে গতবারের ফাইনালিস্ট বেঙ্গালুরু এফসি-র মধ্যে। বুধবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে গত আইএসএল ফাইনালের রিপ্লে-তে লড়াইটা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। একদিকে জয়ের ধারা বজায় রাখতে মরিয়া মোহনবাগান এসজি। অন্যদিকে, জয়ে ফিরতে মরিয়া বেঙ্গালুরু এফসি।
ডুরান্ড কাপ জয়ী মোহনবাগান মরশুমের প্রথম কলকাতা ডার্বিতে হারার পর থেকে আর পিছন ফিরে তাকায়নি। এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে দাপুটে ফুটবল খেলে ওডিশা এফসি-কে ৪-০-য় হারায় তারা। আইএসএলের শুরুটাও তারা করেছে দাপুটে ফুটবল খেলে পাঞ্জাবকে ৩-১-এ হারিয়ে। তাই মোহনবাগানকে তাদের ঘরের মাঠে হারানো যে মোটেই সোজা হবে না বেঙ্গালুরুর পক্ষে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
খাতায় কলমে ফেভারিট মোহনবাগানই। কিন্তু আইএসএল এমন এক লিগ, যেখানে যে কোনও দল, যে কোনও সময়ে, যে কোনও প্রতিপক্ষকে হারাতে পারে। কোন ম্যাচে কে জিতবে, তা আগে থেকে আন্দাজ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কোচিতে ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে যে ফুটবল খেলে তারা, তাতে লড়াই থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই ধরে রাখার ক্ষমতা ছিল না। নিজগোলে কেরালার দলকে এগিয়ে দেওয়ার পর ফের গোলকিপার গুরপ্রীত সিং সান্ধুর ভুলেই দ্বিতীয় গোল খায় তারা। ম্যাচের একেবারে শেষ মিনিটে একটি গোলশোধ করলেও আর গোল করার সময় ছিল না তাদের হাতে।
তাই ম্যাচের পরে কোচ সাইমন গ্রেসন আফসোস করে বলেন, আরও একটু সময় পেলে হয়তো ম্যাচ ড্র করে মাঠ ছাড়তে পারতেন তাঁরা। বুধবারের ম্যাচে ভুলভ্রান্তি শুধরে যখন নামবে বেঙ্গালুরু এফসি, তখন তারা আরও উন্নত ফুটবল খেলবে, এমনই আশা করা যায়। তাই মোহনবাগান এসজি-কেও সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রথম ম্যাচের মতো নিজেদের সেরাটাই দিতে হবে।
দুই শিবিরের খবর
মোহনবাগান এসজি: গত ম্যাচে জেসন কামিংস, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও মনবীর সিং গোল করে দলকে জেতান। আরমান্দো সাদিকু একাধিক সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেন। আক্রমণাত্মক ফুটবলের জন্য যা যা দরকার, সবই সেদিন তারা করেছে। অনিরুদ্ধ থাপা গত ম্যাচে খেলতে পারেননি ডুরান্ড কাপ ফাইনালে লাল কার্ড দেখায়। এই ম্যাচে তিনি মাঠে ফিরতে পারেন। ফলে মাঝমাঠ আরও কিছুটা শক্তিশালী হবে। এই ম্যাচের পাঁচ দিন পরেই পরেই, ২ অক্টোবর আবার তাদের এএফসি কাপের ম্যাচ খেলতে হবে। সেই ম্যাচের কথা ভেবেও দল গড়তে হবে কোচ ফেরান্দোকে। থাপা ছাড়া দলে আর তেমন পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা যাচ্ছে না। গত ম্যাচে আরমান্দো সাদিকু ও হুগো বুমৌসকে প্রথম এগারোর বাইরে রেখে দল নামায় মোহনবাগান। আক্রমণে লিস্টন কোলাসো ও দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে রেখে ও রক্ষণে ব্রেন্ডান হ্যামিল, আনোয়ার আলি ও হেক্টর ইউস্তেকে রেখে ৩-৫-২-এ দল সাজান ফেরান্দো। মাঝমাঠ সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন শুভাশিস, গ্ল্যান, সহাল, কামিংস ও আশিস। এই ম্যাচে বুমৌস ও সাদিকু প্রথম দলে থাকবেন কি না, সেটাই দেখার।
বেঙ্গালুরু এফসি: ভারতীয় দলের হয়ে খেলছেন সুনীল ছেত্রী। ফলে লিগের শুরুতে তাঁর অনুপস্থিতির অভাব টের পাচ্ছে বেঙ্গালুরু এফসি। এমনিতেই এ মরশুমে সন্দেশ ঝিঙ্গন, রয় কৃষ্ণা, উদান্ত সিংয়ের মতো তারকাদের ছেড়ে দিয়েছে বেঙ্গালুরু এফসি। বেশির ভাগই নতুন মুখের ভীড় এ বারের দলে। তাই নতুন দলের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি হতে হয়তো একটু সময় লাগবে। হয়তো সেই কারণেই প্রথম ম্যাচে দলকে খুব একটা আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলানোর পক্ষেও ছিলেন না কোচ গ্রেসন। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ৫-৩-২-এ দল সাজিয়ে শুরু করেন তিনি। রায়ান উইলিয়ামস, সুরেশ ওয়াংজাম, রোহিত কুমার, কেজিয়া ভিনডর্প ও শিবশক্তি নারায়ণনরা এই দলের আক্রমণের বেশিরভাগটাই সামলান। জেসেল কার্নেইরো, স্লাভকো দামিয়ানোভিচ, আলেকজান্দার জোভানোভিচরা দলের রক্ষণের স্তম্ভ। এ ছাড়া অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার হাভিয়ে হার্নান্ডেজ, ইংল্যান্ড থেকে আসা ফরোয়ার্ড কার্টিস মেন (গত ম্যাচের গোলদাতা), ১৮ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড মনিরুল মোল্লা গ্রেসনের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়। গত ম্যাচে হারের ফলে বুধবারও একই দল নামাবেন তিনি, না কিছুটা অদলবদল করবেন, সেটাই দেখার।
সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স
মোহনবাগান এসজি: ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে টাই ব্রেকারে হারিয়ে ডুরান্ড কাপে চ্যাম্পিয়ন। তার আগে গ্রুপ পর্বে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হার সত্ত্বেও বাংলাদেশ আর্মি ও পাঞ্জাব এফসি-কে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে মুম্বই সিটি এফসি-কে হারায়, যা ছিল মুম্বইয়ের ক্লাবের বিরুদ্ধে তাদের সর্বপ্রথম জয়। সেমিফাইনালে এফসি গোয়াকেও হারায় তারা। মরশুমের প্রথম ডার্বিতে হারের পর এখন পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের একটিও ম্যাচে হারেনি তারা। এর মধ্যে এএফসি কাপের প্লে-অফ, প্রাথমিক পর্বে জিতে গ্রুপ পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে কলকাতার দল এবং গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ওডিশা এফসি-কে ৪-০-য় হারায় ও আইএসএল শুরু করে পাঞ্জাবকে ৩-১-এ হারিয়ে।
বেঙ্গালুরু এফসি: ডুরান্ড কাপের গ্রুপ পর্বে ভারতীয় বায়ূসেনার দলের সঙ্গে ১-১ ড্র করে মরশুম শুরু করে গতবারের আইএসএল ফাইনালিস্ট বেঙ্গালুরু এফসি। সেই টুর্নামেন্টে কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধেও ২-২ ড্র করে তারা। শেষে গোকুলাম কেরালা এফসি-কে ২-০-য় হারালেও কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারেনি তারা। আইএসএলের শুরুতেও ধাক্কা খেল গতবারের ফাইনালিস্টরা, গতবার যাদের ফাইনালে ওঠাটা ছিল অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো। লিগপর্বে তারা নেমে গিয়েছিল টেবলের দশ নম্বরে। কিন্তু টানা আটটি ম্যাচে জিতে চার নম্বরে থেকে লিগ শেষ করে প্লে অফে পৌঁছয় তারা। তাদের এই লড়াই শেষ পর্যন্ত তাদের খেতাবের লড়াই পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এ বারেও সে রকম লড়াই দেখা যাবে কি না বেঙ্গালুরুর কাছ থেকে, সেটাই দেখার।
দ্বৈরথের ইতিহাস
গত তিন মরশুমে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট সাত বার। তার মধ্যে পাঁচবারই জিতেছে এটিকে মোহনবাগান, একবার বেঙ্গালুরু ও একটি ম্যাচে ড্র হয়। গত বার প্রথম মুখোমুখিতে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের গোলে জেতে কলকাতার দল। ফিরতি লিগে ২-১-এ জিতে মধুর প্রতিশোধ নেয় বেঙ্গালুরু। ২১-২২ মরশুমে সুনীল ছেত্রী-হীন বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে ৩-৩-এ ম্যাচ অমীমাংসিত রেখে মাঠ ছাড়ে সবুজ-মেরুন বাহিনী। ২০২০-২১ মরশুমে প্রথমে এটিকে মোহনবাগান ডেভিড উইলিয়ামসের গোলে জেতে ও পরেরবার রয় কৃষ্ণা ও মার্সেলো পেরেরার গোলে জেতে।
পরিসংখ্যানবিদরা বলছেন
গত ম্যাচের সাফল্য নিয়ে আইএসএলে টানা সাতটি ম্যাচে অপরাজিত রয়েছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। ২০২১-এর ডিসেম্বর থেকে ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত টানা ১৫টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল তারা। সেটাই ছিল লিগে তাদের সেরা ধারাবাহিকতার নজির। ঘরের মাঠে এই নিয়ে টানা চার আইএসএল ম্যাচে অপরাজিত তারা। ঘরের মাঠে তারা শেষ হেরেছিল এ বছর ফেব্রুয়ারিতে, এই বেঙ্গালুরু এফসি-র কাছেই। অন্য দিকে, গত ম্যাচে হারার ফলে লিগে বেঙ্গালুরু এফসি-র টানা আট ম্যাচে জয়ের ধারা ব্যহত হল। দুই দলের কোচ হুয়ান ফেরান্দো ও সাইমন গ্রেসনের এটা চতুর্থ মুখোমুখি। এই দ্বৈরথে দু’জনেই একটি করে জয় পেয়েছেন।
নজরে যাঁরা
জেসন কামিংস: ভারতে এসে এর মধ্যেই কামিংস পাঁচ গোল করে ফেলেছেন সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে। আইএসএল শুরুও করেছেন গোল দিয়েই। পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে প্রথম গোলটি তিনিই করেন। মোহনবাগান এসজি তিন বছরের চুক্তি করেছে অস্ট্রেলিয়ার এই গোলমেশিনের সঙ্গে। প্রতিপক্ষের গোল এলাকায় তাঁর ঢুকে পড়া মানে তাদের বিপদ, এমনই আশঙ্কা করেন অনেকে। কারণ, তাঁকে আটকানো বেশ কঠিন। এ-লিগে সেন্ট্রাল কোস্ট মেরিনার্সের হয়ে খেলে ২০২২-২৩ মরশুমে ২৯টি ম্যাচে ২১টি গোল করেন ও ছ’টি গোলে অ্যাসিস্ট করেন তিনি। ফাইনালে মেলবোর্ন সিটি-র বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে দলকে ৬-১-এ জিতে চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্যও করেন। সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে আটটি ম্যাচ খেলেছেন। পাঁচটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট করেছেন। ২০২২-এ তিনি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলে ডাক পান ও বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পান।
স্লাভকো দামিয়ানোভিচ: গত মরশুমে জানুয়ারির দলবদলে ফ্লোরেন্তিন পোগবার জায়গায় এই সার্বিয়ান ডিফেন্ডারকে নিয়ে আসে তৎকালীন এটিকে মোহনবাগান। এ বার তাঁকেই সই করিয়েছে বেঙ্গালুরু এফসি। ২০২১-২২ মরশুমে চেন্নাইন এফসি-র হয়ে ১৯টি ম্যাচ খেলেন স্লাভকো। সেই আইএসএল মরশুমের পর পরে তিনি সার্বিয়ার সুপার লিগ ক্লাব নোভি পাজরে যোগ দিলেও শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেন ভারতের এক নম্বর ফুটবল লিগে। বুধবার সেই মোহনবাগানের ধারালো ফরোয়ার্ডদের কী ভাবে রুখবেন ছ’ফুটের ওপর উচ্চতার এই ডিফেন্ডার, সেটাই দেখার এবং তাঁর কাছেও এটা বড় পরীক্ষা।
ম্যাচ- মোহনবাগান এসজি বনাম বেঙ্গালুরু এফসি
ভেনু- বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা
সময়- ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, সোমবার, রাত ৮টা
সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং
টিভি: ডিডি বাংলা ও কালার্স বাংলা সিনেমা- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, ভিএইচ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, সূর্য মুভিজ- মালয়ালাম
স্ট্রিমিং: জিও সিনেমা ও ওয়ানফুটবল