আইএসএলের জোড়া খেতাব জয়ের একেবারে দোরগোড়ায় এসেও শেষ পর্যন্ত একটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে। তবে তারা এ বার যা অর্জন করেছে, তা এর আগে তারা কখনও পায়নি। আর যা অর্জন করতে পারেনি, তা তারা গতবারেই অর্জন করে নিয়েছে। সে দিক দিয়ে তাদের কোনও আফসোস তেমন নেই। যদি কোনও আক্ষেপ থেকে থাকে, তা হল একই মরশুমে দু’টো একসঙ্গে না পাওয়ার।

একাধিক চড়াই-উতরাই পেরিয়েই এ বার মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে খেতাবি লড়াই পর্যন্ত উঠে আসতে হয়। ফুটবলারদের চোটই সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে তাদের। এ ছাড়াও একসঙ্গে প্রায় সাত-আটজন ফুটবলারের ভারতীয় ফুটবল শিবিরে চলে যাওয়া, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিভিন্ন খেলোয়াড়দের সাসপেনশন— এই সব নিয়ে জর্জরিত ছিল সবুজ-মেরুন শিবির। মরশুমের মাঝধখানে কোচও বদলায় তারা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েও তারা যে শেষ পর্যন্ত লিগশিল্ড জিতে কাপ জেতার লড়াইয়েও নামতে পেরেছে, এ তাদের ফুটবলারদেরই কৃতিত্ব। তাঁদের সাহায্য করেছেন আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের মতো পোড়খাওয়া কোচ, যাঁকে আইএসএলের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল কোচ বলা হয়।

তারকাদের মেলা

গত মরশুমের আগে দলবদলে বেশ কয়েকটি চমক দেয় মোহনবাগান এসজি। কাতার বিশ্বকাপে নামা সেন্টার ফরোয়ার্ড জেসন কামিংস ও আলবানিয়ার জাতীয় দলের হয়ে ইউরো ২০১৬-য় খেলা সেন্টার ফরোয়ার্ড আরমান্দো সাদিকু যোগ দেন তাদের শিবিরে। গত বছর দলে যোগ দেওয়া অস্ট্রেলিয়ার তারকা অ্যাটাকার দিমিত্রিয়স পেট্রাটস তো ছিলেনই। এঁরাই ছিলেন দলের প্রধান চালিকা শক্তি, দলের ৫০টি গোলের মধ্যে ৩০টিই করেন যাঁরা।  কামিংস ১২টি গোল করেন, পেট্রাটস ১০টি ও সাদিকু আটটি।

রক্ষণে ভরসা ছিলেন গত মরশুমে দলে যোগ দেওয়া ব্রেন্ডান হ্যামিল, আশিস রাই ও পুরনো সঙ্গী শুভাশিস বোস। সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ান রোনাল্ডোর বিরুদ্ধে খেলা স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হেক্টর ইউস্তে। এ ছাড়াও এফসি গোয়া থেকে সবুজ-মেরুন শিবিরে যোগ দেন ভারতীয় দলের নিয়মিত ডিফেন্ডার আনোয়ার আলি। যিনি মরশুমের শুরু থেকেই ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে।

এছাড়াও ভারতীয় দলের কয়েকজন নিয়মিত তারকা যেমন মিডফিল্ডার অনিরুদ্ধ থাপা ও কেরালার আর এক নির্ভরযোগ্য উইঙ্গার সহাল আব্দুল সামাদকেও সই করায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। ভারতীয় দলের সঙ্গে এএফসি এশিয়ান কাপে তাদের মোট সাতজন ফুটবলার গিয়েছিলেন কাতারে।

মরশুমের শুরুতেই দুঃসংবাদ এসে পৌঁছয় তাদের শিবিরে, আশিক কুরুনিয়ান ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে চোট পেয়ে সারা মরশুমের জন্যই ছিটকে যান। কিন্তু সেই অভাব পূরণ করে দেন অভিষেক সূর্যবংশী, দীপক টাঙরিরা। প্রাক্তন কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসকে ফিরিয়ে এনে আরও এক চমক দেয় মোহনবাগান। তবে অন্য ভূমিকায়। দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর বা টিডি হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। তিনি কোচ হুয়ান ফেরান্দোর বড় ভরসা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন কি না জানা নেই, তবে তাঁর বিকল্প যে হয়ে উঠতে পারেন, সে রকম আন্দাজ করা গিয়েছিল এবং তা বাস্তবায়িতও হয়।  

শুভ সূচনার পরও বিপর্যয়

মরশুমের শুরুতেই ডুরান্ড কাপের গ্রুপ লিগে চিরপ্রতিদ্বন্দী ইস্টবেঙ্গলের কাছে হেরে যায় ফেরান্দোর দল। যা ছিল ৫৫ মাস পরে তাদের প্রথম ডার্বি-হার। সেটাই ছিল মরশুমের শুরুতে তাদের ঘুম ভাঙানোর অ্যালার্ম। ঘুম ভাঙে এবং টানা চারটি ম্যাচ জিতে ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে মুম্বই সিটি এফসি-কে হারায়, যা ছিল মুম্বইয়ের ক্লাবের বিরুদ্ধে তাদের সর্বপ্রথম জয়। সেমিফাইনালে এফসি গোয়াকেও হারায় তারা এবং ফাইনালে ডার্বি হারের বদলাও নিয়ে নেয়।

আইএসএলের দশম মরশুমে দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য তারকাকে ছাড়াই সাতটি ম্যাচে অপরাজিত ছিল তারা। আশিক কুরুনিয়ানের দুঃসবাদ থেকেই বিপর্যয়ের শুরু। আশিকের পর চোট পেয়ে যান আনোয়ার আলিও। তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের রক্ষণ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। যিনি ক্রমশ ফর্মে ফিরছিলেন, সেই মনবীর সিংও মরশুমের মাঝখানে চোট পেয়ে ছিটকে যান। এমনই অবস্থা দাঁড়ায় যে, এএফসি কাপের শেষ ম্যাচে মলদ্বীপে দ্বিতীয় সারির দল পাঠাতে হয়।

অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার পেট্রাটসও চোটের তালিকায় নাম লেখান। তবে মাঠে ফিরেও আসেন। জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকুরা ক্রমশ ফর্ম হারান। দলকে নিয়মিত গোল করে সাহায্য করতে পারেননি তাঁরা। সব শেষে সর্বনাশটি হয় মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচে। লাল কার্ড দেখে আশিস রাই, হেক্টর ইউস্তে ও লিস্টন কোলাসো সাসপেন্ড হয়ে যান। প্রথম দু’জন পরের ম্যাচে ফিরলেও কোলাসো ফিরতে পারেননি, চার ম্যাচের জন্য সাসপেন্ড হওয়ায়।

কোচ বদলে ভোল বদল

পরপর এই বিপর্যয়েই ক্রমশ তারা নেমে আসে পাঁচ নম্বরে। এই অধঃপতনের ফলেই কোচ হুয়ান ফেরান্দোকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নেন ক্লাবের কর্তারা। যাতে দল একেবারে লিগ টেবলের তলানিতে চলে না যায়। সিদ্ধান্তটি যে একেবারেই ভুল হয়নি, তা দায়িত্ব নেওয়ার পরেই প্রমাণ করেন হাবাস।

নতুন বছর শুরুর পর টানা আটটি আইএসএল ম্যাচে অপরাজিত ছিল মোহনবাগান। যার মধ্যে ছ’টিতে জেতে তারা এবং দু’টিতে ড্র করে। হাবাসের প্রভাব পড়া শুরু হয় সেই সময় থেকেই। এই আটটি ম্যাচের প্রথমটিই ছিল কলকাতা ডার্বি। ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে তার চেনা আগুনে মেজাজে ফেরে কলকাতা ডার্বি। দুই দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই তো করেই, ৯০ মিনিটের সেই উত্তেজনায় ভরা লড়াই দেখে ৫৮ হাজার সমর্থক। এই উত্তেজনার মধ্যেই হয় চার-চারটি গোল। শেষ পর্যন্ত ২-২-এ খেলা শেষ করে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয় কলকাতার দুই প্রধান। এই ডার্বিতেই নতুন কোচ হাবাসের বাহিনী স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে, তারা লড়াইয়ে ফিরে এসেছে।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের দিকেও ফিরতি ডার্বিতে দেখে নেওয়ার স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখে তারা এবং সেই ডার্বি আসে তার পরের মাসেই, ১০ মার্চ। দুই ডার্বির মাঝে আরও পাঁচটি ম্যাচ খেলে মোহনবাগান, যার মধ্যে একটিতেও হারেনি তারা। শুধু ভুবনেশ্বরে গিয়ে গোলশূন্য ড্র করে আসে। বাকি চারটি ম্যাচেই জিতে ফের লিগ টেবলে নিজেদের তুলে নিয়ে যেতে শুরু করে হাবাসের বাহিনী।  ফিরতি ডার্বিতে দাপুটে ফুটবল খেলে ৩-১-এ জিতে স্বমহিমায় ফেরে মোহনবাগান।

ফিরতি ডার্বির এই দুর্দান্ত জয়ের তিন দিন পরেই তাদের আরও একটি কঠিন ম্যাচ ছিল কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে। চারদিনের মধ্যে দু-দু’টি বড় ম্যাচ। কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল মোহনবাগানের সামনে। কোনও কিছুই সে দিন তাদের অনুকুলে ছিল না। তবু প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের শব্দব্রহ্ম উপেক্ষা করেই ৪-৩-এ ম্যাচ জিতে ফিরে আসে তারা। কোচিতে সেই জয়ের ফলে ১৮ ম্যাচে ৩৯ পয়েন্ট নিয়ে ফের লিগ টেবলে দু’নম্বরে চলে আসে মোহনবাগান এসজি, মুম্বই সিটি এফসি-র পরেই। তখন থেকেই শুরু হয় তাদের লিগশিল্ডের দৌড়।

ঘরের মাঠে অ্যলার্ম’ ও জেগে ওঠা

কিন্তু ঘরের মাঠে চেন্নাইন এফসি-র কাছে ২-৩-এ দুঃস্বপ্নের হারের পরেই তারা বুঝে যায় শিল্ড জিততে গেলে শেষ তিন ম্যাচে জিততেই হবে। তখন কোচ হাবাস অসুস্থ। পরপর দুটো অ্যাওয়ে ম্যাচ দিল্লি ও বেঙ্গালুরুতে। পাঞ্জাবকে ১-০-য় হারিয়ে তারা পৌঁছয় বেঙ্গালুরুতে। শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে আইএসএলের ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে বড় (৪-০) জয়টি অর্জন করে সে দিনই শিল্ড-যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী।

আইএসএলে প্রথম লিগ শিল্ড জয়ের জন্য শেষ ম্যাচে ঘরের মাঠে মুম্বই সিটি এফসি-কে হারানো ছাড়া কোনও উপায় ছিল না মোহনবাগানের। যে মুম্বইকে আইএসএলের আসরে কোনও দিন হারাতে পারেনি তারা, সেই মুম্বইকে হারিয়ে লিগশিল্ড জেতার স্বপ্ন দেখা মোটেই সোজা কাজ ছিল না। কিন্তু তাও করে দেখায় তারা। বঙ্গ বছরের দ্বিতীয় দিন যুবভারতীর প্রায় ৬০ হাজার সমর্থকের সামনে লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়ন মুম্বই সিটি এফসি-কে ২-১-এ হারিয়ে প্রথমবার লিগসেরার খেতাব জিতে নেয় তারা।

প্লে-অফে ফের অ্যালার্ম, কিন্তু...

সেমিফাইনালে তাদের মুখোমুখি হয় লিগ টেবলের পাঁচ নম্বরে থাকা ওডিশা এফসি। কিন্তু সেমিফাইনালের প্রথম লেগেই ধাক্কা খায় লিগশিল্ডজয়ী মোহনবাগান। ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে ওডিশা এফসি ২-১-এ প্রথম লেগ জিতে এগিয়ে ছিল। মোহনবাগানকে ফাইনালে উঠতে গেলে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অন্তত দু’গোলের ব্যবধানে জিততে হত। সেই চ্যালেঞ্জেও জেতে তারা।

প্রথম লেগে হারের বদলা নিয়ে ওডিশা এফসি-কে ২-০-য় হারিয়ে ফাইনালে ওঠে গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু আইএসএলের দ্বিমুকুট জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়নি তাদের।  তিন সপ্তাহ আগে লিগের শেষ ম্যাচে যে মুম্বইকে নিজেদের মাঠে হারিয়ে শিল্ড জিতে নিয়েছিল মোহনবাগান এসজি, সেই মুম্বইয়ের কাছেই ফাইনালে ১-৩-এ হারে তারা। পিছিয়ে থেকেও দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাজিমাত করে অতিথিরা।

পরের মরশুমে যা দরকার

এ মরশুমে যে সাফল্য তারা পেয়েছে, পরবর্তী মরশুমে প্রয়োজন তার ধারাবাহিকতা। এই দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়কেই যদি ধরে রাখতে পারে তারা, তা হলে সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে পারে। তবে পরবর্তী মরশুমে যেহেতু তাদের সামনে আরও বড় পরীক্ষা রয়েছে, এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এর গ্রুপ পর্ব, তাই আরও দু-একজন ভাল বিদেশী ও দেশীয় খেলোয়াড় আনা দরকার, যারা দলকে আরও শক্তি জোগাতে পারবে। সে রকম কয়েকজন খেলোয়াড়ের খোঁজ নিশ্চয়ই শুরু করে দিয়েছে ক্লাব। কারণ, সাফল্য শুধু গর্ব এনে দেয় না, দায়িত্বও আরও বাড়িয়ে দেয়।