একশো গোলের মাইলফলক ছুঁতে না পারার আক্ষেপ নেই: সুনীল ছেত্রী
‘জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে বেঙ্গালুরু এফসি-র সঙ্গে প্রাক মরশুম প্রস্তুতি শুরু করব। গত মরশুমে আমরা ন’নম্বরে থেকে শেষ করেছিলাম। সে জন্য খুব কষ্ট পেয়েছি’।
বৃহস্পতিবার যখন থেকে জাতীয় দল থেকে অবসর ঘোষণা করেছেন সুনীল ছেত্রী, তখন থেকেই হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে দেশের ফুটবল মহলে এবং সংবাদ মাধ্যমে। দেশের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল কিংবদন্তি বলে কথা। তিনি আর দেশের হয়ে খেলবেন না, এই খবরে ফুটবলপ্রেমীরা তো বিচলিত হবেনই। কিন্তু সুনীল নিজেই চাইছেন না, তাঁর অবসরের খবর নিয়ে এত আলোচনা হোক চার দিকে। তিনি চান, এখন শুধু ভারতীয় দলের আসন্ন বিশ্বকাপ বাছাইয়ের অভিযান নিয়ে আলোচনা শুরু হোক।
বৃহস্পতিবার নিজের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডলে পোস্ট করা এক ভিডিওয় ভারতীয় অধিনায়ক ও দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক গোলদাতা সুনীল ছেত্রী জানিয়ে দেন ৬ জুন কলকাতায় কুয়েতের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচেই দেশের জার্সি গায়ে শেষবার মাঠে নামবেন তিনি।
তাঁর এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার এক ভার্চুয়াল সাংবাদিক বৈঠকে সুনীল বলেন, “গত দু’দিন ধরে শুধু আমাকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছে দেখছি। কিন্তু আজ এই সাংবাদিক বৈঠকে এসেছি যাতে আজকের পর এ সব থেমে যায়। কাল থেকে যাতে শুধু ভারতীয় দলেকে নিয়ে আলোচনা হয়। আমি অনেক ভালবাসা পেয়েছি এবং কাল থেকে ফোন বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হয়েছি। এর মধ্যে ৬৮৮টা মিস কল এসে গিয়েছে। আমি খুবই সৌভাগ্যবান। কিন্তু আমি চাই, কাল থেকে কুয়েত আর আমাদের বাছাই পর্বের ম্যাচ নিয়েই বেশি আলোচনা হোক, আমার অবসর নিয়ে নয়”।
ভুবনেশ্বরে ভারতীয় দলের প্রস্তুতি শিবির শুরু হয়েছে, যেখান থেকে শুক্রবার ভার্চুয়াল প্রেস কনফারেন্স করেন সুনীল। এই শিবিরেও শুধু কুয়েত ম্যাচ নিয়েই ভাবনা চলছে বলে জানান অধিনায়ক। বলেন, “শিবিরে সবাই মানসিক ভাবে প্রস্তুত। আমরা প্রত্যেকেই এখন শুধু কুয়েত ম্যাচ নিয়ে ভাবছি, আর কিছুই না”।
Shades of the 🐐 in India's Blue! 🇮🇳💙#SunilChhetri #IndianFootball pic.twitter.com/XmuDFKSTOx
— Indian Super League (@IndSuperLeague) May 16, 2024
‘একসময় ঠিকমতো হাঁটতেই পারতাম না’
ভারতের হয়ে দেড়শো ম্যাচে ৯৪ গোল করেছেন তিনি। ১৯ বছর ধরে ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে নামছেন তিনি। এত বছর ধরে নিজেকে সেই জায়গায় ধরে রাখার জন্য পরিবারের সদস্যদের ও জাতীয় দলের ফিজিও, ডাক্তারদের কৃতিত্ব দেন। বলেন, “আমার শরীরে যত্ন তাঁরাই করেছেন। মাঠের বাইরে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং মাঠে জাতীয় দলের ফিজিও, চিকিৎসকেরা। বিশেষ করে একজনের কথা বলতেই হবে, গিগি জর্জ, জাতীয় দলের সঙ্গে যে ১২ বছরেরও বেশি সময় রয়েছে। মূলত ওর জন্যই এতদিন ধরে জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামতে পেরেছি। দলের মেডিক্যাল স্টাফ ছাড়া এত বছর ধরে খেলতেই পারতাম না। এমন একটা সময় এসেছিল, যখন আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারতাম না। কিন্তু ওরা আমাকে দৌড় করিয়ে ছেড়েছিল। চোটের জন্য এক সময় আমার ফুটবল ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওদের জাদুর জোরে আমি আবার মাঠে নামতে পেরেছি। ওদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই”।
অধরা একশো গোলের মাইলফলক
দেশের হয়ে ৯৪ গোল করে বিশ্বের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোলদাতাদের তালিকায় বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের পরেই রয়েছেন তিনি। আর ছ’টি গোল করলেই গোলের সেঞ্চুরি করতে পারতেন। তা সত্ত্বেও কেন থেমে গেলেন, শুক্রবারের সাংবাদিক বৈঠকে অনেকেই এই প্রশ্ন তোলেন।
তাঁদের প্রশ্নের জবাবে সুনীল বলেন, “যখন শুরু করেছিলাম, তখন ভাবতেই পারিনি যে দেশের হয়ে এত গোল করতে পারব, এত ম্যাচ খেলতে পারব। ১৯ বছরে দেড়শো ম্যাচ খেলতে পারাটা বাগ্যের ব্যাপার। সে জন্য আমি গর্বিত। নিজেকে এর জন্য সৌভাগ্যবান মনে করি আমি। ৯৪ গোল করতে পারাটা আমার কাছে বিশাল ব্যাপার। একশো গোল করতে না পারার জন্য কোনও আফসোস নেই আমার”।
কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে দেশের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলাটাও তাঁর কাছে বড় ব্যাপার। সে কথা প্রকাশ করে সুনীল এ দিন বলেন, “কে কোন ক্লাবের সমর্থক, সেটা বড় কথা নয়। ভারতীয় দলের খেলা থাকলেই কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের ঢল নামে সল্টলেক স্টেডিয়ামে। এ বারেও আশা করি, তার ব্যতিক্রম হবে না। তাই নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। সবাই মিলে আমাদের সমর্থন করতে আসুন। যেমন প্রত্যেকবার আসেন। ম্যাচটা উপভোগ করুন। আমাদের কাছে সত্যিই এটা বড় ম্যাচ। আশা করি, ম্যাচের পর আমরা সবাই খুশি মনে মাঠ ছাড়ব”।
জুলাইয়েই ফের মাঠে
দেশের হয়ে খেলা বন্ধ করলেও ক্লাবের হয়ে খেলা চালিয়ে যাবেন বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন সুনীল ছেত্রী। বলেন, “৬ জুন শেষ ম্যাচ খেলার পরের দিন হয়তো একটু কান্নাকাটি করব। ৮ জুন থেকে বিশ্রাম নেব, কয়েকদিন ছুটি নেব, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চাই। তার পরে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে বেঙ্গালুরু এফসি-র সঙ্গে প্রাক মরশুম প্রস্তুতি শুরু করব। গত মরশুমে আমরা ন’নম্বরে থেকে শেষ করেছিলাম। সে জন্য খুব কষ্ট পেয়েছি। এ বার যাতে আর সে রকম কিছু না হয়, তাই অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করব আমরা”।
আন্তর্জাতিক ফুটবল জীবনে যেমন পেয়েছেন অনেক, তেমন অনেক কষ্টের মুহূর্তও এসেছে। যেমন ২০১৫-র এশিয়ান কাপের মূলপর্বে খেলতে না পারার আফসোস বোধহয় কোনও দিনই যাবে না সুনীল ছেত্রীর। বলেন, “সেই ঘটনাটা এখনও কাঁটার মতো বেঁধে আমার বুকে। মায়ানমারের বিরুদ্ধে কী জঘন্য খেলেছিলাম আমরা। এখনও সেই ম্যাচটার প্রসঙ্গ উঠলে নিজের ও সতীর্থদের ওপর খুব রাগ হয়”।
তাঁর আশা, তাঁর ১৫১তম ম্যাচই হতে চলেছে তাঁর আন্তর্জাতিক ফুটবল কেরিয়ারের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। যুবভারতীর ভরা গ্যালারির সামনে ভারতকে জিতিয়ে যদি দলকে প্রথমবার বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ডে তুলে ইতিহাস গড়তে পারেন, তা হলে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিই বা হতে পারে?
স্টিমাচের সঙ্গে বোঝাপড়া
অনেকের প্রশ্ন, কুয়েতের বিরুদ্ধে ম্যাচের পাঁচ দিন পরই তো কাতারের বিরুদ্ধে আর এক কঠিন লড়াই ভারতের। সেই ম্যাচে খেলেই তো অবসর নিতে পারতেন সুনীল। কিন্তু তা করলেন না কেন, এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সুনীল বলেন, “যখন আমি কথাটা জাতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচকে জানাই, তখন উনি আমাকে এ কথা বলেননি। কারণ, উনি আমার মানসিকতা বোঝেন। দলের খেলোয়াড়দের অনেক স্বাধীনতা দেন কোচ। উনি জানেন দেশের হয়ে খেলার জন্য আমি কতটা মরিয়া হয়ে থাকি।
কোনও ম্যাচের ৭০ মিনিটের মাথায় সঙ্গত কারণেও যদি উনি আমাকে বসিয়ে দেন, তা হলেও আমি খুশি হতে পারি না। তাই যখন আমি ওঁকে বলি, কুয়েতের বিরুদ্ধে ম্যাচই আমার শেষ ম্যাচ, তখন উনি আমার ব্যাপারটা বুঝেছেন। কারণ, উনি নিজেও দেশের হয়ে খেলেছেন। অল্পসময় এই নিয়ে কথা হয় আমাদের। উনি বলেন, চলো ছ’তারিখে সবাই মিলে ম্যাচটা জিতে মাঠ ছাড়ব”।
#ThankYouSC11 💙#IndianFootball ⚽️ pic.twitter.com/J5y4pew6Ee
— Indian Football Team (@IndianFootball) May 16, 2024
সর্বকালের সেরা হওয়ার জন্যই ওর জন্ম: স্টিমাচ
দলের অধিনায়ক ও তাঁর অন্যতম প্রিয় ফুটবলারের অবসরের কথা শুনে যে অবাক হয়েছেন ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ, তাঁর প্রতিক্রিয়ায় তা একোবারেই মনে হয়নি। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে স্টিমাচ বলেন, “সুনীল জানে কোন সময় অবসরের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ওর মনের কথা তো একমাত্র ওরই জানার কথা। আমি চাই, ৬ জুন ওর বিদায়ী ম্যাচকে যেন সব দিক দিয়ে, সবার কাছে স্মরণীয় করে রাখতে পারি আমরা”।
ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা ফুটবলারের প্রশংসা করেন স্টিমাচ বলেন, “খেলতে খেলতেই ও কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে। এমন কৃতিত্ব ক’জনেরই বা আছে? প্রত্যেকের কাছেই ও প্রেরণা। দেশের জার্সির কাছে সম্পুর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ একজন খেলোয়াড় সুনীল। এখনকার তরুণ ফুটবলারদের ওকে অনুসরণ করা উচিত। আবেগ ও ভালবাসা নিয়ে দেশের হয়ে মাঠে নামে ও। এতে যে অসীম আনন্দ পায় ও, তা তো ও নিজেই বলেছে”।
সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে স্টিমাচ বলেন, “ওর মতো অসাধারণ এক মানুষের সঙ্গে কাজ করে এবং ওর সুন্দর পরিবারকে কাছ থেকে জেনে আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি। আমাদের মধ্যে কোচ-খেলোয়াড়ের সম্পর্কের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। আমার বিশ্বাস, ফুটবল ছাড়ার পর ও সমাজের ওপর ভাল প্রভাব ফেলার মতো কিছু করবে। সর্বকালের সেরা হওয়ার জন্যই জন্মেছে ও”।