গোল্ডেন বুটজয়ী দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস: ব্লাস্টার্স শিবিরের নিউক্লিয়াস
মাঠের মধ্যে তাঁর ক্যারিশমা তো সারা দুনিয়া দেখেছে। কিন্তু মাঠের বাইরে, ড্রেসিংরুমে দলনেতা ও রোল মডেল হয়ে ওঠার যে ক্ষমতা দেখিয়েছেন দিয়ামান্তাকস, তা অভাবনীয়।

ফুটবল খেলাটা দলগত খেলা ঠিকই, কিন্তু কয়েকজন ফুটবলার যে ভাবে তাদের একক দক্ষতার মাধ্যমে দলের পারফরম্যান্সে প্রভাব বিস্তার করেন, তাতে দল তাদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। দলের সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করে সেই সব অসাধারণ ফুটবলারদের ওপর। দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস তেমনই একজন ফুটবলার, যিনি এ মরসুমে তাঁর দল কেরালা ব্লাস্টার্সকে প্রচুর গোল এনে দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার গোল্ডেন বুট জিতে নিয়েছেন।
সারা মরশুমে মোট ১৩টি গোল করে এ বারের সবচেয়ে বেশি গোলদাতার সন্মান অর্জন করে নেন এই গ্রিক ফরোয়ার্ড। কেরালা ব্লাস্টার্সের আর এক তারকা আদ্রিয়ান লুনাও যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিলেন এ মরশুমে। কিন্তু দিয়ামান্তাকসের প্রভাবের কথাও অস্বীকার করতে পারবেন না ব্লাস্টার্সের সমর্থকেরা।
মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট যেমন তাদের দিমিত্রিয়স-এর ওপর অনেক ভরসা করেছে এবং সেই ভরসার দামও পেয়েছে তারা, কেরালা ব্লাস্টার্সও তাদের দিমিত্রিয়সকে কেন্দ্র করে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। এই নিয়ে আইএসএলে দ্বিতীয় মরশুম খেলে ফেললেন দিয়ামান্তাকস। গত মরশুমে দশটি গোল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আরও এক মরশুম থাকলে তিনি দলকে আরও সাফল্য এনে দিতে পারেন। মাঠের মধ্যে তাঁর ক্যারিশমা তো সারা দুনিয়া দেখেছে। কিন্তু মাঠের বাইরে, ড্রেসিংরুমে দলনেতা ও রোল মডেল হয়ে ওঠার যে ক্ষমতা দেখিয়েছেন দিয়ামান্তাকস, তা অভাবনীয়।
মরশুমের অনেকটা সময়ই দলের হয়ে মাঠে নামতে পারেননি লুনা। অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। সেই সময়েও যে ভাবে দলকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন গ্রিক ফরোয়ার্ড, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। যে ভাবে প্রায় প্রতি ম্যাচে বিপক্ষের গোল এরিয়ায় সবচেয়ে বড় ত্রাস হয়ে ওঠেন তিনি, তার যত প্রশংসা করুন, তা যথেষ্ট নয়।
দলের সব বিভাগেই একজন করে স্তম্ভ রেখে দিয়েছিলেন ব্লাস্টার্সের কোচ ইভান ভুকোমানোভিচ। সেন্টার ব্যাক মার্কো লেসকোভিচ, লুনা এবং দিয়ামান্তাকস—এই তিন তারকা থাকার ফলে দলের তিন বিভাগেই শক্তি অনেক বেড়ে যায়। যে সব ম্যাচে দলের হয়ে প্রথম দুজন খেলতে পারেননি সেইসব ম্যাচে নিজেকে আরও ভাল জায়গায় নিয়ে গিয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যাান্স দেখিয়েছেন এই দিয়ামান্তাকস। এমনকী তাঁদের অনুপস্থিতিতে দলকে দুর্দান্ত নেতৃত্বও দেন কেরালার দিমি।
নিজের জন্য যেমন জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন, তেমনই সতীর্থদেরও গোলের সামনে গোলে শট নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন বারবার। গোলের নিখুঁত পাসও বাড়িয়েছেন অনেক। লুনা ছিটকে যাওয়ার পর তিনি কোয়ামে পেপরার সঙ্গে জুটি বেঁধে দলের আক্রমণ বিভাগকে শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করেন দিয়ামান্তাকস। কিন্তু পেপরাও চোট পাওয়ার পর দলের নতুন বিদেশী ফেদর সেরনিচের সঙ্গেও ভাল বোঝাপড়া তৈরি হয়ে যায় তাঁর। এ বার সারা মরশুম ধরেই চোট-আঘাত ও খেলোয়াড় পরিবর্তন ভুগিয়েছে ভুকোমানোভিচের দলকে। ফলে ফিরতি লেগে লিগ টেবলের শীর্ষস্থান থেকে ক্রমশ নীচের দিকে নেমে যায় তারা। শেষ পর্যন্ত কোনও রকমে নক আউটে পৌঁছলেও ওডিশার কাছে ১-২-এ হেরে ছিটকে যায়।
লিগের শেষের দিকে তাদের এমন অবস্থা হওয়ার কারণও সেই দিয়ামান্তাকস। কারণ, চোট পেয়ে শেষ দিকের ম্যাচগুলিতে আর খেলতে পারেননি তিনি। তার আগে পর্যন্ত একাধিক খেলোয়াড়ের চোটের ফলে একাধিক কম্বিনেশনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে খেলতে হয় তাঁকে। তা সত্ত্বেও নিজের পারফরম্যান্সে কোনও ঘাটতি হতে দেননি তিনি।
মরশুমের শুরুতে অবশ্য চোট সারিয়ে মাঠে ফিরে ছন্দে ফিরতে সময় নেন দিয়ামান্তাকস। ঘরের মাঠে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে কষ্টার্জিত ২-১ জয়ে ছন্দে ফেরেন তিনি। সেখান থেকে আর পিছন ফিরে তাকাননি গ্রিক তারকা। পরের ম্যাচেই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে জয়সূচক গোলটি তিনিই করেন। চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে প্রথম জোড়া গোল আসে তাঁর পা থেকে। কিন্তু ঘরের মাঠে সেই ম্যাচ ৩-৩-এ ড্র হয়। জানুয়ারির অবকাশের আগে পরপর তিনটি ম্যাচে গোল করে ও একটি অ্যাসিস্ট দিয়ে দলকে লিগ টেবলের শীর্ষে থাকতেই সাহায্য করেন দিয়ামান্তাকস।
কিন্তু অবকাশের পরের সময়টা ব্লাস্টার্সের মোটেই ভাল কাটেনি। দশটি ম্যাচের মধ্যে সাতটিতেই হেরে শেষ পর্যন্ত টেবলের পাঁচ নম্বরে থেকে লিগ শেষ করে তারা। দল ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে গেলেও নিয়মিত গোল করে যান দিয়ামান্তাকস। ওডিশার বিরুদ্ধে ফিরতি লেগে দল হারলেও তিনি গোল করেন। এফসি গোয়া ও মোহনবাগান এসজি-র বিরুদ্ধে দুই ম্যাচেই জোড়া গোল পান তিনি। জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধেও ১-১ ড্রয়ে একমাত্র গোলটি ছিল তাঁরই। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে পাওয়া চোটেই তাঁর এই মরশুম শেষ হয়ে যায়। নক আউটে খেলতে পারলে হয়তো আরও গোল পেতেন দিয়ামান্তাকস। কিন্তু লিগে যে ১৩টি গোল করেন, সেই গোলসংখ্যাই তাঁকে সেরার শিরোপা এনে দেয়।
ওডিশার রয় কৃষ্ণাও ১৩টি গোল করে তালিকার শীর্ষে ছিলেন। কিন্তু গোল ও মিনিটের অনুপাতের বিচারে দিয়ামান্তাকসই (প্রতি ১০২.৫৪ মিনিটে একটি গোল) এই দৌড়ে ছিলেন এক নম্বরে। শুধু তা-ই নয়। ব্লাস্টার্স শিবিরের খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি (৩২) শট মেরেছেন। এর মধ্যে ২৩টি ছিল লক্ষ্যে। ১৩টি গোলের পাশাপাশি তিনটি অ্যাসিস্টও করেছেন তিনি। কিন্তু দলকে সেমিফাইনালে বা ফাইনালে পৌঁছে দিতে না পারার আফসোস রয়েই গেল তাঁর।