মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট সিজন রিভিউ: সেরা মরশুম, স্বপ্নের মরশুম
যে পাঁচবার আইএসএলে অংশ নিয়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী, তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল মরশুম ছিল এটিই। দাপুটে ফুটবল খেলে অন্যান্য দলগুলিকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়ে ফাইনালে ওঠে তারা।

পরিসংখ্যান
লিগ ম্যাচ: ২৪ | জয়: ১৭ | পরাজয়: ২ | ড্র: ৫ | পয়েন্ট: ৫৬ | পক্ষে গোল: ৪৭ | বিপক্ষে গোল: ১৬
প্লে-অফ ম্যাচ: ৩ | জয়: ২ | পরাজয়: ১ | ড্র: ০ | পক্ষে গোল: ৫ | বিপক্ষে গোল: ১
আইএসএল ২০২৪-২৫ মরশুমে পারফরম্যান্স
ইন্ডিয়ান সুপার লিগে তাদের পঞ্চম মরশুমকে স্বপ্নের মরশুম বললেও বিন্দুমাত্র ভুল বলা হবে না বোধহয়। এমন আধিপত্য ও দাপটের সঙ্গে এর আগে কেউ কখনও মরশুম করতে পারেনি আইএসএলের ১১ মরশুমের ইতিহাসে। প্লে-অফেও তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যে ভাবে জোড়া খেতাব জয় করে এক নতুন ইতিহাস তৈরি করল যারা, তাদের সম্পর্কে এ কথা বলা যেতেই পারে।
এ মরশুমের আগে ঢেলে দল সাজায় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। চার নতুন বিদেশী আসেন দলে। অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড জুটি দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও জেসন কামিংসের সঙ্গে যোগ দেন অস্ট্রেলিয়ার আর এক নামী ফরোয়ার্ড জেমি ম্যাকলারেন এবং স্কটিশ মিডফিল্ডার গ্রেগ স্টুয়ার্ট। স্প্যানিশ সেন্টার ব্যাক আলবার্তো রড্রিগেজকে সই করায় তারা। অভিজ্ঞ স্কটিশ ডিফেন্ডার টম অলড্রেডও যোগ দেন মোহনবাগান শিবিরে।
দেশীয় ফুটবলারদের মধ্যে দুর্দান্ত মিডফিল্ডার আপুইয়াকে মুম্বই সিটি এফসি থেকে নিয়ে আসে তারা। চোট সারিয়ে এ মরশুমে দলে ফেরেন আশিক কুরুনিয়ানও। আর গতবারের দলের বিশাল কয়েথ, মনবীর সিং, লিস্টন কোলাসো, অনিরুদ্ধ থাপা, শুভাশিস বোস, আশিস রাই, সহাল আব্দুল সামাদরা তো দলেই থেকে যান। তরুণ ডিফেন্ডার দীপেন্দু বিশ্বাসের চুক্তির মেয়াদও বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে ভাল ও ভারসাম্যযুক্ত দলই গড়ে মোহনবাগান। ২০২৩-২৪ মরশুমের দল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় আরমান্দো সাদিকু, হুগো বুমৌস, জনি কাউকো, ব্রেন্ডান হ্যামিল, হেক্টর ইউস্তে, লালরিনলিয়ানা হ্নামতে, কিয়ান নাসিরিদের।
বছরের শুরুতেই ডুরান্ড কাপ ফাইনালে উঠে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট শিবির আইএসএলে ভাল খেলার ইঙ্গিত দিয়ে রাখে। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে মরশুম শুরু করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, সেই ম্যাচেই যেন তারা ঘোষণা করে, তারা এসেছে খেতাব জয়ের সংকল্প নিয়ে। যদিও পরের ম্যাচে বেঙ্গালুরুর কাছে হেরে যায় তারা, সেই হোঁচটই যেন নতুন করে জেদ বাড়িয়ে তোলে তাদের। এর পর টানা আট ম্যাচে অপরাজিত থেকে সাতটি জয় তুলে নেয় তারা, উপহার দেয় দর্শনীয় ও দলগত ফুটবল।
ডিসেম্বরে গোয়ার মাঠে লিগ পর্বের দ্বিতীয় ও শেষ হার মানে তারা, তবে সেটিও ছিল সামান্য এক ছন্দপতনের ফলে। বাকি পুরো লিগ পর্বে আর কেউই তাদের হারাতে পারেনি। ১২ ম্যাচের অপরাজিত থেকে মরশুম শেষ করে তারা এবং ঘরের মাঠে ছিল একেবারে দুর্ভেদ্য— সমর্থকদের সামনে টানা ১১টি জয়।
লিগের সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি আসে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে, যেখানে জয় মানেই ছিল লিগশিল্ড নিশ্চিত করা। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে দিমিত্রি পেট্রাটসের গোল সেই স্বপ্নকে বাস্তব করে তোলে। সেই এক মুহূর্তে ধরা পড়ে দলের আত্মবিশ্বাস, সাহস আর জয়ের জন্য মরিয়া মনোভাব। ২৪ ম্যাচে ১৭টি জয়, মাত্র দু’টি হার, ৪৭ গোল এবং মাত্র ১৬ গোল হজম করে তারা লিগপর্ব শেষ করে। এফসি গোয়াকে আট পয়েন্টে পেছনে ফেলে নিশ্চিত করে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব।
শিল্ড জিতে সরাসরি সেমিফাইনালে ওঠে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। প্রথম লেগে জামশেদপুরের মাঠে দুর্ভাগ্যজনক হারে পিছিয়ে পড়ে তারা। সম্ভবত সেই হারই ছিল ঘুম ভাঙানোর অ্যলার্ম। কিন্তু ঘরের মাঠে ফিরে আত্মবিশ্বাসী পারফরম্যান্সে কামিংস ও আপুইয়ার গোলে ২-০ ব্যবধানে জয় তুলে নিয়ে মোট ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। এ জয়ে তারা পৌঁছে যায় টানা তৃতীয় আইএসএল ফাইনালে। গত শনিবার সেই ফাইনালেই নির্ধারিত সময়ে ১-১ রাখার পর অতিরিক্ত সময়ে জেমি ম্যাকলারেনের দুর্দান্ত গোলে জোড়া খেতাব জিতে ইতিহাস তৈরি করে ফেলে সবুজ-মেরুন বাহিনী।
ইতিবাচক দিক
সারা মরশুম জুড়ে তাদের অসাধারণ পারফরম্যান্সে অনেক ইতিবাচক দিক দেখা গিয়েছে। সবার আগে যার কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তা হল, দলের খেলোয়াড়দের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস। এমন ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁদের এই দুই গুণের জন্যই সম্ভব হয়েছে। পরষ্পরের মধ্যে বোঝাপড়াও ছিল দুর্দান্ত, যা তৈরি করতে দারুন ভাবে সাহায্য করেছেন তাদের স্প্যানিশ হেড কোচ হোসে মোলিনা। তাঁর তুখোড় ফুটবল বুদ্ধি এবং নিখুঁত কৌশল তৈরির ক্ষমতাও এই দলের একটা বড় ইতিবাচক দিক। সমর্থকদের কাছ থেকেও লাগাতার সমর্থন পেয়ে গিয়েছে তারা।
দলের খারাপ ফলে বা খেলোয়াড়রা অনেকে একসঙ্গে চোট-আঘাত ও কার্ড সমস্যার মধ্যে পড়লেও কখনও মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে যাননি তিনি এবং খেলোয়াড়দেরও ভেঙে পড়তে দেননি। দলের রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়দের ওপরও সমান আস্থা রেখেছেন তিনি এবং সেই আস্থার দামও দিয়েছেন পরিবর্ত খেলোয়াড়রা। তাই দলের সব খেলোয়াড়ই তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন। দলের আক্রমণ বিভাগকে যেমন ধারালো করে তুলেছিলেন মোলিনা, তেমনই রক্ষণকেও দুর্ভেদ্য করে তোলেন তিনি। ফলে দল হিসেবেও ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলে তারা। সব মিলিয়ে এক কমপ্লিট প্যাকেজ।
নেতিবাচক দিক
খুব কমই নেতিবাচক বিষয় পাওয়া যায় এ বারের মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট দলে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি ছিল প্রচুর গোলের সুযোগ তৈরি করেও তা হাতছাড়া করার দোষ, যা সারা মরশুমে সংশোধন করতে পারেনি তারা। লক্ষ্যে থাকা শটকে গোলে রূপান্তরিত করার হার তাদের ছিল ১৬.১ শতাংশ। রক্ষণে ধারাবাহিকতার অভাবও দেখা যায় তাদের। যদিও ১৬টি ম্যাচে ক্লিন শিট রেখেছে তারা। সবচেয়ে কম গোলও খেয়েছে, ১৮টি। কিন্তু কবে যে তাদের রক্ষণ ভাল খেলবে বা খারাপ খেলবে, তার কোনও ঠিক ছিল না। যেমন লিগের শুরুর দিকে টানা তিনটি ম্যাচে গোল অক্ষত রাখে তারা। তার পরে ওডিশার বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে। ফের তিনটি ম্যাচে কোনও গোল খায়নি তারা। চলতি বছরের শুরুতে টানা ছ’টি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রাখে তারা। কিন্তু ফাইনালের আগে শেষ চারটি ম্যাচের মধ্যে দুটিতে কোনও গোল খায়নি সবুজ-মেরুন বাহিনী। কিন্তু বাকি দু’টি ম্যাচে দু’টি করে গোল খায়। ফাইনালে তো ডিফেন্ডারের নিজের ভুলেই গোল খায়।
সেরা খেলোয়াড়
এ মরশুমে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে সবচেয়ে বেশি গোল করে সর্বাধিক ভরসা জুগিয়েছেন যিনি, সেই অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার জেমি ম্যকলারেনই সেরা বলা যেতেই পারে। যে ২৫টি ম্যাচ খেলেছেন ম্যাকলারেন, তার মধ্যে ২১টিতে প্রথম এগারোয় ছিলেন তিনি। ১২টি গোল করেছেন ও দু’টি অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। অর্থাৎ দলের ১৪টি গোলে তাঁর অবদান রেখেছেন ম্যাকলারেন। ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে তাঁর গোলই দলকে ইতিহাস গড়তে সাহায্য করে।
তবে তাঁর মতো এত গোল না করেও যিনি দলের ১৩টি গোলে অবদান রাখেন. সেই জেসন কামিংসকেও সেরার শিরোপা দিতে পারে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। নিজে যেমন সাতটি গোল করেছেন তিনি, ছ’টি গোলে অ্যাসিস্টও করেছেন। যখন নিজে গোল করতে পারছিলেন না, তখন নিজের ভূমিকা বদল করে অ্যাসিস্টে বেশি মন দেন কামিংস এবং সফলও হন। দলের ঐতিহাসির সাফল্যে তাঁরও অবদান রয়েছে যথেষ্ট। ২৫টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১১টিতে শুরু থেকে খেলেন তিনি। ১৪টিতে বেঞ্চ থেকে নেমে কম সময় পেয়েও বাজিমাত করেন তিনি। ফাইনালে তাঁর গোলেই সমতা আনে সবুজ-মেরুন বাহিনী।
সেরা তরুণ খেলোয়াড়
২১ বছর বয়সী ডিফেন্ডার দীপেন্দু বিশ্বাস এ মরশুমে যে ভাবে সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন, সাধারণত সে ভাবে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন না ভারতীয় তরুণ ফুটবলাররা। যেমন ভরসা জুগিয়েছেন দলের রক্ষণকে, তেমনই গোলও করেছেন তিনি। তা সত্ত্বেও অবশ্য ফাইনালে খেলার সুযোগ পাননি। নর্থস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে অসাধারণ একটি গোলও করেন দীপেন্দু। পেট্রাটসের লম্বা ফ্রি কিকে অনেকটা লাফিয়ে উঠে হেড করে বল জালে জড়িয়ে দেন তিনি। ১৪টি ম্যাচে তিনি দলে ছিলেন, যার মধ্যে ১১টিতে শুরু থেকে খেলেন। দুটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন তিনি। কোচ, অধিনায়ক দুজনেই এ মরশুমে দীপেন্দুর পারফরম্যান্সের প্রশংসা করেছেন। শুভাশিস বোস তাঁর উত্তরসূরী নিয়ে এতদিনে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন বোধহয়।
আগামী মরশুমে যা প্রয়োজন
যে দলটা এ মরশুমে খেলল, সেই দলের বেশিরভাগ ফুটবলারকে দলে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, সবই করা উচিত মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ম্যানেজমেন্টের। তবে দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও গ্রেগ স্টুয়ার্টকে তারা ধরে রাখতে পারবে কি না, সেটাই দেখার। দু’জনের কেউই এ বার সেরা ছন্দে ছিলেন না। গ্রেগ যেমন একটি ম্যাচে পাঁচ মিনিটের জন্য মাঠে নেমে ম্যাচের সেরার খেতাব জিতে নেন, তেমনই দিমির শেষ মুহূর্তের গোলেই শিল্ড জিতে নেয় মোহনবাগান। কিন্তু সারা মরশুমে নিজেদের সেরা ছন্দে ছিলেন না। দীপেন্দু ছাড়াও আরও দু-একজন ভাল তরুণ ডিফেন্ডার প্রয়োজন তাদের। আপুইয়াকে যোগ্য সঙ্গত দেওয়ার জন্য ভাল মিডফিল্ডারও দরকার। আর পরবর্তী মরশুমে গোলের সুযোগকে আরও বেশি হারে গোলে পরিণত করার জন্য বিশেষ অনুশীলন প্রয়োজন।