ম্যাকলারেনের গোলে ফের ডার্বিজয়, শীর্ষে অটল মোহনবাগান
এই জয়ে ৩৫ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বেঙ্গালুরু এফসি-র চেয়ে আট পয়েন্টে এগিয়ে গেল গতবারের লিগশিল্ড জয়ীরা। ক্রমশ ফের খেতাব দখলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।

ঘরের বাইরে অন্য ঘরে ডার্বি জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। শনিবার গুয়াহাটিতে তারা ইস্টবেঙ্গলকে হারায় ১-০-য়। তবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বৈরথের মধ্যে যে আগুন দেখার আশায় ছিলেন দুই দলের সমর্থকেরা, তা একেবারেই দেখা যায়নি বললেই চলে।
প্রায় তীব্রতাহীন এমন ডার্বি আইএসএলে কখনও দেখা গিয়েছে বলে মনে পড়ে না। এর আগে লিগের কোনও মোহন-ইস্ট ডার্বির ফয়সালা মাত্র এক গোল হয়নি। শনিবার দু’মিনিটের মাথায় যে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার জেমি ম্যাকলারেন, সেই গোলেই তিন পয়েন্ট জিতে নেয় গতবারের শিল্ড চ্যাম্পিয়নরা।
ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কথা বাদই দেওয়া যায়, সবুজ-মেরুন বাহিনীও তাদের সমর্থকদের মন ভরিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি শনিবর। আরও নিষ্প্রভ লাল-হলুদ ব্রিগেড। ম্যাচের শুরুতে তারা গোল খেয়ে যাওয়ায় এবং শৌভিক চক্রবর্তী লাল কার্ড দেখায় শেষের প্রায় আধ ঘণ্টা তাদের দশ জনে খেলতে হওয়ায় তাদের যাবতীয় মরিয়া ভাব প্রায় উবে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তারা।
সারা ম্যাচে একটিও শট গোলের লক্ষ্যে রাখতে পারেননি ক্লেটন সিলভা, দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসরা। মোহনবাগান মোট ১৪টি শটের মধ্যে চারটি গোলে রাখে এবং প্রথমটি থেকেই গোল পেয়ে যায়। এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট দুই দলের পারফরম্যান্সে কতটা ফারাক ছিল এদিন।
চলতি লিগে এগারো নম্বর জয়ের ফলে ৩৫ পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষে বহাল রইল বাগান-বাহিনী। এ দিন তাদের ম্যাচ শুরুর আগে কলকাতার আর এক দল মহমেডান এসসি-র বিরুদ্ধে টেবলের দ্বিতীয় স্থানে থাকা বেঙ্গালুরু এফসি হেরে যাওয়ায় আট পয়েন্টে এগিয়ে গেল মোহনবাগান এসজি। ক্রমশ ফের লিগশিল্ড দখলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। ম্যাকলারেন, লিস্টন কোলাসোরা এ দিন ফর্মে থাকলেও জেসন কামিংস, মনবীর সিং-রা চেনা ছন্দে না থাকায় একটির বেশি গোল দিতে পারেনি তারা। না হলে ইস্টবেঙ্গল রক্ষণের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হয়তো গোলের সংখ্যা আরও বাড়াতে পারত তারা।
এ দিন মোহনবাগান যেখানে ১১টি গোলের সুযোগ তৈরি করে, সেখানে পাঁচটির বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করতেই পারেনি ইস্টবেঙ্গল। প্রতিপক্ষের বক্সে যেখানে ২৯ বার বলে পা দিয়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী, সেখানে প্রতিপক্ষকে নিজেদের বক্সে ১৪বারের বেশি বল ছুঁতে দেয়নি তারা।
এ দিন দ্বিতীয় মিনিটেই গোল করে মোহনবাগান স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে রাখে, তারা ঠিক কী রকম মেজাজ নিয়ে মাঠে নেমেছে। মাঝমাঠের ডানদিক থেকে আশিস রাইয়ের লম্বা থ্রু পেয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন জেমি ম্যাকলারেন। তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন হেক্টর ইউস্তে। তবে কার্যত দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন লালচুঙনুঙ্গা। গোলকিপার প্রভসুখন গিলকে পরাস্ত করে গোলে বল ঠেলতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার (১-০)।
শুরুতেই গোল খেয়ে কোণঠাসা হয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। এই সুযোগে তাদের আরও চেপে ধরার চেষ্টা শুরু করে সবুজ-মেরুন বাহিনী। ১২ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসোর গোলমুখী শট ইউস্তের গায়ে লেগে গোললাইন পেরিয়ে যায়। ২১ মিনিটের মাথায় মনবীর যে সুযোগ হাতছাড়া করেন, তা থেকে অনায়াসে দ্বিতীয় গোল পেতে পারত তারা। বক্সের বাইরে থেকে কামিংসের দেওয়া পাস পেয়ে ডানদিক থেকে তা গোলের সামনে পাঠান ম্যাকলারেন। কিন্তু মনবীরের টোকা দেওয়া বলের দখল নিয়ে নেন গিল।
ঘুরে দাঁড়াতে কিছুটা সময় নেয় ইস্টবেঙ্গল। এর মধ্যে অবশ্য ছ’মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে ওঠা পিভি বিষ্ণু বক্সের মধ্যে বল পাঠান, যা গোলের দিকে ঠেলেন ক্লেটন সিলভা। কিন্তু তা বিপদসীমার বাইরে পাঠান টম অলড্রেড। প্রথম আধঘণ্টার মধ্যে আর কোনও ভাল সুযোগ তৈরি করে নিতে পারেনি তারা। এই আধঘণ্টায় বেশিরভাগ খেলাই হয় লাল-হলুদ বাহিনীর অঞ্চলে। আক্রমণাত্মক প্রতিপক্ষকে সামলাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন ইউস্তে, হিজাজিরা। এই সময়ে চারটি শট নেয় মোহনবাগান, যার মধ্যে দু’টিই ছিল লক্ষ্যে এবং একটি থেকে গোল হয়। ইস্টবেঙ্গলের চারটি শটই ছিল লক্ষ্যের বাইরে।
বিরতির আগের ১৫ মিনিটে গতি কমিয়ে খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে আনার চেষ্টা দেখা যায় ইস্টবঙ্গলের পারফরম্যান্সে। কিন্তু মোহনবাগান তাদের পা থেকে বল কেড়ে ফের আক্রমণে উঠতে চাইছিল। বল দখলের এই লড়াইয়ে দুই দলের ফুটবলারদের মেজাজও হারাতে দেখা যায় এবং শৌভিক চক্রবর্তী প্রথম হলুদ কার্ড দেখেন।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কোনও পক্ষকেই তেমন আক্রমণাত্মক মেজাজে দেখা না গেলেও শুরুতেই বিষ্ণুর পাঠানো বলে ঠিকমতো শট নিতে পারলে হয়তো গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারতেন ক্লেটন সিলভা। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। দ্বিতীয় চেষ্টাতেও শট নেন তিনি, কিন্তু তা ছিল দিশাহীন। বিষ্ণুকে এ দিন সম্ভবত আক্রমণের চেয়ে রক্ষণের, বিশেষ করে মনবীরকে নজরে রাখার ভূমিকা পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন কোচ। তাই লাল-হলুদ আক্রমণে তেমন আগ্রাসন দেখা যায়নি এ দিন।
মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণের মরিয়া চেষ্টা শুরু করে ইস্টবেঙ্গল, যা পুরোপুরি পেরে ওঠেনি তারা। বারবার তাদের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে সবুজ-মেরুন বাহিনীও। তবে এই লড়াইয়ে ক্রমশ খেলার গতি কমতে শুরু করে। কিন্তু ৬৩ মিনিটের মাথায় যে ঘটনা ঘটে, তা ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে বড়সড় দুঃসংবাদ বয়ে আনে।
তাদের একটি কর্নারকে পাঞ্চ করে বের করে দেন মোহনবাগান গোলকিপার বিশাল কয়েথ, যা পেয়ে মাঝমাঠের এ পার থেকে স্প্রিন্ট শুরু করেন লিস্টন কোলাসো। তখন ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে শৌভিক ছাড়া কেউই ছিলেন না। বক্সে ঢোকার আগেই লিস্টনকে অবধারিত ভাবে থামাতে যান তিনি, কিন্তু তা করতে গিয়ে ফাউল করে ফেলেন তিনি। এর আগেই হলুদ কার্ড দেখা শৌভিককে এই ঘটনার জন্য দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়। ফলে ম্যাচের বাকি সময়টা দশ জনে খেলতে হয় মশাল-বাহিনীকে।
এই সুযোগই কাজে লাগায় মোহনবাগান এবং ফের আক্রমণ শুরু করে তারা। ৬৭ মিনিটের মাথায় সহালের সঙ্গে বল দেওয়া-নেওয়া করে বক্সের ডানদিক থেকে এক কোণাকুনি শটে গোলের চেষ্টা করেন আশিস, যা অল্পের জন্য বারের ওপর দিয়ে চলে যায়। এর পরেই সমতা আনার উদ্দেশে ডেভিড লালনসাঙ্গাকে তুলে নাওরেম মহেশকে নামায় ইস্টবেঙ্গল।
ম্যাকলারেন ও কোলাসো সচল থাকলেও এ দিন জেসন কামিংস, মনবীররা তেমন তৎপর ছিলেন না বলেই ইস্টবেঙ্গল রক্ষণকে সারাক্ষণ প্রবল চাপে থাকতে হয়নি। এ তাদের সৌভাগ্য বলা যায়। ৭৫ মিনিটের মাথায় কামিংসকে তুলে গ্রেগ স্টুয়ার্টকে নামায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। তিনি নামার পরেই ফের চাঙ্গা হয়ে ওঠে তাঁর দল। ৭৮ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে কোলাসো খুব কঠিন কোণ থেকে গোলে শট নিলেও তা ব্লক হয়ে যায়। ফিরতি বলে বক্সের মাথা থেকে সহাল জোরালো শট নিলেও তা লক্ষ্যে ছিল না।
মরিয়া ইস্টবেঙ্গল হিজাজির বদলে নামায় নন্দকুমার শেকরকে। ফলে তিন ব্যাকে চলে যায় তারা। ইউস্তেকে উঠে গিয়ে খেলতে দেখা যায়। ফলে তাদের রক্ষণে জায়গা আরও বেড়ে যায়। এই জায়গাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু করেন ম্যাকলারেন, স্টুয়ার্টরা। তবে হয়তো এক গোলে এগিয়ে থাকায় বাগান-আক্রমণে সেই মরিয়া ভাব দেখা যায়নি। স্টুয়ার্ট দু’বার গোলে শট নিয়েও ব্যর্থ হন। শেষ দিকে ম্যাকলারেন ও সহালকে তুলে নেওয়ায় তাদের আগ্রাসন আরও কমে যায়। পেট্রাটস, সুহেল ভাট এসেও যা ফিরিয়ে আনতে পারেননি।
এই পরিস্থিতিতে সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠার কথা যাদের, সেই ইস্টবেঙ্গলের মধ্যেও সেই তাগিদ দেখা যায়নি। দশজনে হয়ে যাওয়ার পর থেকে কোনও কিছুই ঠিক হয়নি তাদের। বলের দখল বাড়ানোর চেষ্টা করলেও প্রতিপক্ষের গোল এলাকায় ঢুকতে পারেনি তারা। ফলে পাঁচ মিনিট সংযুক্ত সময়েও তেতে ওঠেনি পরিবেশ।
মোহনবাগান এসজি দল (৪-৪-২): বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, টম অলড্রেড, আলবার্তো রড্রিগেজ, শুভাশিস বোস, মনবীর সিং, সহাল আব্দুল সামাদ (দীপক টাঙরি-৮৮), আপুইয়া, লিস্টন কোলাসো (সুহেল ভাট-৯৩), জেসন কামিংস (গ্রেগ স্টুয়ার্ট-৭৫), জেমি ম্যাকলারেন (দিমিত্রিয়স পেট্রাটস-৮৭)।
ইস্টবেঙ্গল এফসি দল (৪-৪-২): প্রভসুখন সিং গিল (গোল), লালচুঙনুঙ্গা, হেক্টর ইউস্তে, হিজাজি মাহের (নন্দকুমার শেকর-৮০), নিশু কুমার, ডেভিড লালনসাঙ্গা (নাওরেম মহেশ-৬৯), শৌভিক চক্রবর্তী, জিকসন সিং, পিভি বিষ্ণু, ক্লেটন সিলভা, দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: - মোহনবাগান এসজি ৫৩.৫% - ইস্টবেঙ্গল এফসি ৪৬.৫%, সফল পাসের হার: ৭৯%-৭৮%, গোলে শট: ৪-০, ফাউল: ৬-৯, ইন্টারসেপশন: ৬-১৮, ক্রস: ১৯-২১, কর্নার: ৬-৪, হলুদ কার্ড: ১-২, লাল কার্ড: ০-১।
ম্যাচের সেরা: জেমি ম্যাকলারেন (মোহনবাগান এসজি)