সেমিফাইনালের প্রথম লেগে হেরে ধাক্কা খেল সদ্য লিগশিল্ডজয়ী মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। মঙ্গলবার ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে তিন মিনিটের গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হেরে মাঠ ছাড়ে তারা। ওডিশা এফসি ২-১-এ প্রথম লেগ জিতে এগিয়ে রইল। মোহনবাগানকে ফাইনালে উঠতে গেলে রবিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অন্তত দু’গোলের ব্যবধানে জিততে হবে। তারা এক গোলের ব্যবধানে জিতলে টাই ব্রেকারে খেলার নিষ্পত্তি হবে।

এ দিন তৃতীয় মিনিটে কর্নার থেকে হেডের গোলে দলকে এগিয়ে দেন মোহনবাগানের তারকা উইঙ্গার মনবীর সিং। কিন্তু এর পর আর কোনও গোল করতে পারেনি তারা। সারা ম্যাচে আটটি গোলের সুযোগ কিন্তু তৈরি করেছিল তারা। ১১ মিনিটের মাথায় কার্লোস দেলগাদো ও ৩৯ মিনিটের মাথায় মোহনবাগানের প্রাক্তনী রয় কৃষ্ণা গোল করে দলকে জয়ের রাস্তা দেখান। এই নিয়ে টানা ১৩টি হোম ম্যাচে অপরাজিত রইল ওডিশা এফসি। এর মধ্যে এটি তাদের দশ নম্বর জয়। বাকি তিনটি ড্র হয়েছে।

এ দিন মোহনবাগানের দুই বিদেশী দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও জনি কাউকো সেরা ছন্দে না থাকায় পুরো দলটারই ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়। দুই উইঙ্গার লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংও সেরা পারফরম্যান্স দিতে পারেননি। স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হেক্টর ইউস্তের ব্যর্থতা কাজে লাগিয়ে জয়সূচক গোলটি করেন রয়। পেট্রাটস এদিন দুটি গোলের সুযোগ তৈরি করেন। তাঁর ছ’টি শটের মধ্যে দু’টি লক্ষ্যে ছিল। ফাইনাল থার্ডে ২২টি পাস বাড়ান। দলের একমাত্র গোলটিও হয় তাঁর কর্নার থেকেই। কিন্তু একটিও গোল নিজে করতে পারেননি তিনি। ম্যাচে তুমুল অশান্তি না হলেও দুই দলেরই একজন করে খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখেন। মোহনবাগানের সাদিকু ও ওডিশার দেলগাদো।

অপরিবর্তিত দল নিয়ে মাঠে নামে মোহনবাগান এসজি। ছকেও কোনও পরিবর্তন করেননি তাদের কোচ আন্তোনিও হাবাস। ওডিশা এফসি-র কোচ সের্খিও লোবেরাও তাঁর প্রথম এগারোয় কোনও পরিবর্তন করেননি। দিয়েগো মরিসিওকে রিজার্ভ বেঞ্চে রেখেই দল নামান তিনি। তাঁকে ৮৫ মিনিটে নামানো হয়।

দুই শক্তিশালী দল ও দুই কৌশলী কোচের লড়াই যে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে চলেছে, তা বোঝা যায় প্রথম ১১ মিনিটের মধ্যেই, যখন দু’পক্ষই একটি করে গোল করে। প্রথমে মনবীর সিং তৃতীয় মিনিটে গোল করে এগিয়ে দেন মোহনবাগানকে। এর আট মিনিট পরেই সমতা আনেন কার্লোস দেলগাদো। দু’জনেই কর্নার থেকে গোল করেন।
আইএসএলের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম গোল দিয়ে এ দিন ম্যাচ শুরু করেন মনবীর। দু’মিনিট ১৯ সেকেন্ডে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের কর্নারে হেড করে গোল করেন তিনি (১-০)। ছ’গজের বক্সের মধ্যে সম্পুর্ণ অরক্ষিত ছিলেন মনবীর। গোলকিপার অমরিন্দর সিং-কেও কার্যত দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায় তখন।

শুরুতেই গোল খাওয়ার ধাক্কা সামলে ঘন ঘন পাল্টা আক্রমণে উঠতে বেশি সময় নেননি রয় কৃষ্ণারা। প্রথম এগারো মিনিটের মধ্যেই ছ-ছ’টি কর্নার হয়ে যায়, যার মধ্যে পাঁচটিই আদায় করে কলিঙ্গবাহিনী। ছ’নম্বর কর্নারটি থেকে গোল করে সমতা এনে ফেলেন দেলগাদো। আহমেদ জাহুর মাপা কর্নারে গোলের সামনে থেকে বাঁ পায়ের টোকায় জালে বল জড়িয়ে দেন তিনি (১-১)। তাঁর কাছে বল পৌঁছনোর আগে অবশ্য উড়ন্ত বল দখলের সুযোগ পেয়েছিলেন বিশাল কয়েথ। কিন্তু তিনি তা করতে না পারায় গোল খেতে হয় সবুজ-মেরুন বাহিনীকে।

গোল খাওয়ার পর পেট্রাটসকে সামনে রেখে নাগাড়ে আক্রমণ চালিয়ে যায় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। তবে ওডিশাও বারবার প্রতি আক্রমণে উঠতে থাকে। ১৪ মিনিটের মাথায় রেফারি সিদ্ধান্ত না বদলালে হয়তো তখনই পিছিয়ে যেত তারা। বিশাল গোলমুখী রয় কৃষ্ণাকে বাধা দেওয়ায় পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও সহকারী রেফারির সঙ্গে আলোচনা করে তা প্রত্যাহার করেন, ইশাক রালতে তখন অফ সাইডে থাকায়।

রয় কৃষ্ণা ও দিমিত্রিয়স পেট্রাটস এই সময় একাধিক সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেন। না হলে স্কোরলাইন বদলে যেতে পারত। ইশাক রালতেও এ দিন ওডিশার আক্রমণে ভাল রকম তৎপর ছিলেন। ৩৪ মিনিটের মাথায় পেট্রাটসের কর্নার থেকে অলিম্পিক গোল হওয়ার ঠিক আগেই সেভ করেন অমরিন্দর।

রেফারির পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বদলানোয় যে গোল থেকে বঞ্চিত হন রয়, সেই গোল তিনি পেয়ে যান ৩৯ মিনিটের মাথায়। তবে পেনাল্টি থেকে নয়, বরং বেশ কষ্টার্জিত গোল ছিল সেটি। মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বলে হেড করে মোহনবাগানের বক্সের দিকে পাঠান রয় এবং দ্রুত বল তাড়া করে বক্সে ঢুকেও পড়েন। তাঁকে বাধা দিলেও ব্যর্থ হন হেক্টর ইউস্তে। গোল ছেড়ে এগিয়ে আসেন বিশালও। দু’জনকেই ধোঁকা দিয়ে সোজা গোলে শট নেন রয় এবং বল জালে জড়িয়ে দেন (১-২)। এ মরশুমে এটি তাঁর ১৩ নম্বর গোল ও এই গোলের সঙ্গে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় এক নম্বরে চলে এলেন তিনি।

সারা মাঠজুড়ে এদিন খেলেন রয়। দুটি গোলের সুযোগ তৈরি করেন, দুটির মধ্যে তাঁর একটি শট ছিল গোলে এবং সেটি থেকেই গোল পান। বিপক্ষের বক্সে পাঁচবার বল স্পর্ষ করেন তিনি। ফাইনাল থার্ডে ১৪টি পাস বাড়ান। তাঁকেই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় বাছা হয়।

দ্বিতীয় গোল খাওয়ার পর খেলা থেকে ক্রমশ যেন হারিয়ে যায় কলকাতার দল এবং সেই সুযোগে আক্রমণ চালিয়ে যান রয়, জাহুরা। এর পরে একবার সাদিকু প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় ঢুকে পড়লেও তাঁর ক্রস ব্লক হয়ে যায়। ফলে এক গোলে পিছিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় মোহনবাগান এসজি। প্রথমার্ধে সাতটির মধ্যে চারটি শট গোলে রাখে ওডিশা এবং মোহনবাগানের ছ’টির মধ্যে তিনটি শট ছিল লক্ষ্যে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ম্যাচের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে ওডিশা। প্রতিপক্ষকে বল বা জায়গা কোনওটাই দিতে রাজি ছিল না তারা। প্রথমার্ধে লিস্টন কোলাসোকে যে ভূমিকায় দেখা যায়নি, সেই বাঁ দিকের উইং দিয়ে আক্রমণে তিনি প্রথম ওঠেন দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে এবং বক্সের সামনে একটি ফ্রি কিকও আদায় করে নেন তিনি। কিন্তু গত ম্যাচের মতো নাকল শট নিয়ে তা কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। কোলাসো বাঁ দিক দিয়ে উঠলেও দ্বিতীয়ার্ধে ডানদিকে মনবীরের তৎপরতা অনেক কমে যায়। জনি কাউকো এ দিন ছন্দে না থাকায় তাদের মাঝমাঠকেও তেমন গোছানো মনে হয়নি।

৫৯ মিনিটের মাথায় ওডিশার বক্সের অনেকটা দূর থেকে নেওয়া পেট্রাটসের দূরপাল্লার ফ্রি কিক গোলে ঢোকার ঠিক আগেই সেভ করেন অমরিন্দর সিং। ফিরতি বলে বক্সের মধ্যে থেকে শট মারলেও তা বারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেন আনোয়ার আলি।

৬৭ মিনিটের মাথায় বড় ধাক্কা খায় মোহনবাগান, যখন দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যান আরমান্দো সাদিকু। মাঝমাঠে বল দখলের সময় আহমেদ জাহুকে পিছন থেকে আঘাত করে এই লাল কার্ড দেখেন সাদিকু। ফলে দশজনে খেলা শুরু করে পিছিয়ে থাকা মোহনবাগান এবং আরও চাপে পড়ে যায় তারা।

তবে এই চাপ বেশিক্ষণ থাকেনি তাদের। কারণ, ৭২ মিনিটের মাথায় নিজেদের বক্সের মাথায় হ্যান্ডবল করে দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখেন কার্লোস দেলগাদোও। ফলে দশজনের সঙ্গে দশজনের লড়াই শুরু হয়। তবে এই ঘটনায় বক্সের ঠিক সামনে পাওয়া ফ্রি কিক কাজে লাগাতে পারেননি পেট্রাটস। তাঁর শট ওয়াল-এ ধাক্কা খেয়ে বিপদসীমার বাইরে ছিটকে আসে।

ছন্দে না থাকা জনি কাউকোকে তুলে জেসন কামিংসকে মোহনবাগান নামায় ৭৮ মিনিটের মাথায়। অর্থাৎ, তখন নির্ধারিত সময়ে আর মাত্র ১২ মিনিট বাকি। তবে এই পরিবর্তনের পরেই যে সুযোগ তৈরি করেন রয় কৃষ্ণা, তা বিশাল এগিয়ে এসে না বাঁচালে জেরির গোলে মোহনবাগান আরও পিছিয়ে যেত। ৮২ মিনিটের মাথায় আরও সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেন অনিরুদ্ধ থাপা। বাঁ দিক থেকে বক্সে ঢুকে গোলের সামনে ক্রস পাঠান কোলাসো, যা ক্লিয়ার করতে গিয়ে ফস্কান নরেন্দ্র গেহলট। তাঁর পা থেকে ছিটকে আসা বলে পা লাগান থাপা, যা বারে লেগে ফিরে আসে।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে রয় কৃষ্ণাকে তুলে দিয়েগো মরিসিওকে নামান ওডিশার কোচ লোবেরা। তাতে অবশ্য তাদের আক্রমণের তেজ খুব একটা বাড়েনি। বরং মোহনবাগান শেষ দিকে কলকাতার দলই সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন কোলাসোর জায়গায় কিয়ান নাসিরি নামেন। তিনি নামার পর মনবীর বাঁ দিকে চলে আসেন। তবে এই পরিবর্তনেও কোনও ভাবে লাভবান হয়নি মোহনবাগান।

মোহনবাগান এসজি দল (৩-২-৪-১): বিশাল কয়েথ (গোল), আনোয়ার আলি, হেক্টর ইউস্তে, শুভাশিস বোস, অভিষেক সূর্যবংশী (দীপক টাঙরি-৪৫), জনি কাউকো (কামিংস-৭৮), মনবীর সিং, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, অনিরুদ্ধ থাপা, লিস্টন কোলাসো (কিয়ান নাসিরি-৮৪), আরমান্দো সাদিকু।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: ওডিশা এফসি ৩৮.৮% - মোহনবাগান এসজি ৬১.২%, সফল পাসের হার: ৬৬%-৭৮%, গোলে শট: ৪-৫ ফাউল: ১৩-১০, ইন্টারসেপশন: ১২-১৭, ক্রস: ১৪-২৬, কর্নার: ৬-৯, হলুদ কার্ড: ২-১, লাল কার্ড: ১-১।

ম্যাচের সেরা: রয় কৃষ্ণা (ওডিশা এফসি)