লড়াকু হায়দরাবাদকে হারিয়ে ঘরের মাঠে জয়ের ‘ডাবল হ্যাটট্রিক’ মোহনবাগানের
গোলের লক্ষ্যে থাকা তাদের আটটি শটের মধ্যে পাঁচটিই ছিল লিস্টন কোলাসোর। কিন্তু এ দিন তাঁর সাফল্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান হায়দরাবাদের গোলকিপার অর্শদীপ সিং।

ঘরের মাঠে সবুজ-মেরুন বাহিনীর বিজয়রথ থামানোর ক্ষমতা বোধহয় কারও নেই। বৃহস্পতিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের জয় দেখে সে রকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এ বারের আইএসএলে তারা ঘরের মাঠে ছ’নম্বর জয় অর্জন করল হায়দরাবাদ এফসি-কে ৩-০-য় হারিয়ে। সাতটি হোম ম্যাচের মধ্যে ছ’টিতেই জয় পেয়েছে তারা। লিগের প্রথম ম্যাচে ড্রয়ের পর এই নিয়ে যুবভারতীতে টানা ছ’টি জয়। অর্থাৎ ঘরের মাঠে জয়ের ডাবল হ্যাটট্রিক করে ফেলল হোসে মোলিনার দল।
অপ্রতিরোধ্য মোহনবাগানের দুর্ভেদ্য রক্ষণের জন্য এ দিন তুমুল লড়াই করেও গোলের মুখ খুলতে পারেনি মরিয়া হায়দরাবাদ এফসি। বল দখলে মোহনবাগানের চেয়ে এগিয়ে (৪৫-৫৫) ছিল তারা। সারা ম্যাচে সাত-সাতটি শট লক্ষ্যে ছিল তাদের, যেখানে মোহনবাগানের আটটি শট ছিল গোলে। গোলের সুযোগ তৈরিতেও এগিয়ে (১০-৯) ছিল নিজামের শহরের দল। তা সত্ত্বেও তাদের রক্ষণের দুর্বলতাকে দারুণ ভাবে কাজে লাগিয়ে পরপর গোল তুলে নেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী, যা একেবারেই পারেনি হায়দরাবাদ এফসি। এখানেই দুই দলের মধ্যে ফারাক তৈরি হয়ে যায়।
ম্যাচের ন’মিনিটের মাথায় এক অনিচ্ছাকৃত ভুলে প্রতিপক্ষের গোলের খাতা খুলে দেন হায়দরাবাদের সার্বিয়ান ডিফেন্ডার স্তেফান সাপিচ। ৪১ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়ান বাগান ডিফেন্ডার টম অলড্রেড। ৫১ মিনিটের মাথায় কামিংসের গোলে জয় সুনিশ্চিত করে গতবারের শিল্ড চ্যাম্পিয়নরা। তবে যতগুলি সুযোগ এ দিন তৈরি করেছিল বাগান-বাহিনী, তাতে আরও বড় ব্যবধানে জিততে পারত তারা।
গোলের লক্ষ্যে থাকা তাদের আটটি শটের মধ্যে পাঁচটিই ছিল লিস্টন কোলাসোর। কিন্তু এ দিন তাঁর সাফল্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান হায়দরাবাদের গোলকিপার অর্শদীপ সিং, যিনি এ দিন ছ’টি প্রায় অবধারিত গোল সেভ করে দলকে বড় হারের হাত থেকে বাঁচান। ১৪ ম্যাচে ৩২ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবলের শীর্ষে বহাল রইল তারা। ১৬-র গোল পার্থক্য তাদের, যার ধারে-কাছে আপাতত কেউ নেই। আর কোনও আইএসএল মরশুমে কখনও ১৪ ম্যাচের পর ১৬-র গোলপার্থক্য অর্জন করতে পারেনি মোহনবাগান। এই নিয়ে সাতটি ম্যাচে গোল অক্ষত রাখল তারা। যা এ মরশুমে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
প্রত্যাশা অনুযায়ীই এ দিন দুটি পরিবর্তন করে দল নামান মোহনবাগান কোচ হোসে মোলিনা। মনবীর সিংয়ের জায়গায় সহাল আব্দুল সামাদ ও আপুইয়ার জায়গায় দীপক টাঙরি। হায়দরাবাদ এফসি অবশ্য দলে কোনও পরিবর্তন করেনি।
ঘরের মাঠে শুরু থেকে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলাই নিয়ম হয়ে উঠেছে মোহনবাগানের। এ দিনও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। তবে দশ মিনিটের মধ্যেই যে গোল ‘উপহার’ পেয়ে যাবে তারা, তা বোধহয় ভাবতেই পারেনি সবুজ-মেরুন বাহিনী। বাঁদিক দিয়ে ওঠা লিস্টন কোলাসোর স্কোয়ার পাস থেকে বল পেয়ে বক্সের মাথা থেকে সোজা গোলে শট নেন সহাল আব্দুল সামাদ, যা গোলকিপার অর্শদীপের হাতে লেগে সামনে ছিটকে আসে। তাঁর সামনে থাকা ডিফেন্ডার স্তেফান সাাপিচের গায়ে লেগে বল ফের গোলে ফিরে যায় ও গোল লাইন পেরিয়েও যায় (১-০)।
এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর চাপ ক্রমশ বাড়াতে থাকে হোম টিম। ১৭ মিনিটের মাথায় জেমি ম্যাকলারেনের শট পোস্টে লেগে ফিরে না এলে তখনই ব্যবধান বাড়িয়ে নিতে পারত মোহনবাগান। জেসন কামিংসের কাছ থেকে বল পেয়ে বক্সে ঢুকে ডানদিক থেকে কোণাকুনি শট নেন ম্যাকলারেন, যা সোজা পোস্টে ধাক্কা খায়। ২৬ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসোর দূরপাল্লার শট ফের সেভ করেন অর্শদীপ। ৪০ মিনিটের মাথায় বিপজ্জনক জায়গা থেকে নেওয়া কোলাসোর ফ্রি কিকও বাঁচান হায়দরাবাদের গোলকিপার।
হায়দরাবাদও মাঝে মাঝে পাল্টা আক্রমণ উঠতে থাকে। গোল খাওয়ার পরেই বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া রামলুনচুঙ্গার জোরালো শট দুর্দান্ত দক্ষতায় আটকান বিশাল কয়েথ। ১৯ মিনিটের মাথায় সাপিচের গোলমুখী হেডও বাঁচান তিনি। তারা যে পয়েন্ট টেবলের একেবারে নীচের দিকে থাকা দল, তাদের পারফরম্যান্স দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না।
তা সত্ত্বেও মোহনবাগানের মরিয়া আক্রমণ চলতে থাকে এবং ৪১ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন স্কটিশ ডিফেন্ডার টম অলড্রেড। বাঁ দিক থেকে কোলাসোর ক্রস দূরের পোস্টের সামনে পৌঁছলে তা ডাইভ দিয়ে হেড করে গোলে পাঠান অলড্রেড (২-০)। প্রথমে সহকারী রেফারি অফসাইডের পতাকা তুললেও পরে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত বদলান রেফারি।
দ্বিতীয়ার্ধেও ছবিটা একটুও বদলায়নি। শুরু থেকেই মোহনবাগানের আধিপত্যই ছিল এবং ছ’মিনিটের মধ্যেই ফের গোল পেয়ে যায় তারা। এ বার দুর্দান্ত গোল করেন কামিংস, যিনি বক্সের বাইরে উড়ে আসা বলের দখল নিয়ে ম্যাকলারেনের কাছে পাঠিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন। ম্যাকলারেন তাঁকে ফের বল বাড়ালে প্রথম টাচেই কাছের পোস্টের দিক দিয়ে গোলে বল পাঠান কামিংস (৩-০)।
এর চার মিনিট পরেই আলবার্তো রড্রিগেজকে কার্যত গোল সাজিয়ে দেন কামিংস। বক্সের ডানদিক থেকে উড়ে আসা তাঁর ক্রসে ছ’গজের বক্সের মধ্যে ঠিকমতো হেড করতে পারলেই গোল পেতেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার। কিন্তু সিটার মিস করেন তিনি। ৫৮ মিনিটের মাথাতেও কর্নার থেকে হেডে গোল করার সুযোগ পান রড্রিগেজ। এবারও লক্ষ্যভ্রষ্ট হন তিনি। প্রতিপক্ষের এলাকায় প্রায় দাপিয়ে বেড়ানো কোলাসো ৬০ মিনিটের মাথায় ফের গোলে শট নেন, যা ফের আটকান অর্শদীপ।
তুমুল চাপ কাটাতে মাঝে মাঝে প্রতি আক্রমণে উঠছিল হায়দরাবাদ এফসি। ৬৪ মিনিটের মাথায় এমনই এক আক্রমণে বক্সের বাইরে থেকেই গোলে শট নেন মহম্মদ রফি। কিন্তু বরাবরের মতোই সেই শটের দখল নিয়ে নেন বিশাল কয়েথ। বিরতির পরেই এমনই এক শটে গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন এডমিলসন কোরেয়া। কিন্তু সে বারও দলকে বাঁচান বিশাল। ৮৪ মিনিটের মাথায় অবধারিত গোলের সুযোগ পান হায়দরাবাদের ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড অ্যালান ডিসুজা। সামনে বিশাল ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। কিন্তু এ বারও বিশালের দুর্ভেদ্য প্রাচীরে তাঁর শট আটকে যায়। সারা ম্যাচে সাতটি সেভ করেন তিনি।
তিন গোলে এগিয়ে যাওয়ায় রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়দের পরখ করে নিতে দ্বিতীয়ার্ধের ড্রিঙ্কস ব্রেকের ঠিক আগে সহালকে তুলে সুহেল ভাটকে নামান বাগান-কোচ। নামেন সৌরভ ভানওয়ালা, অভিষেক সূর্যবংশীও। শেষ দিকে গ্রেগ স্টুয়ার্ট, মনবীর সিংদেরও মাঠে নামতে দেখা যায়। এমনিতেই গোলপার্থক্যে সবার চেয়ে এগিয়ে মোহনবাগান। এ দিন সুযোগ পেয়ে তাতে আরও উন্নতি আনার চেষ্টা শুরু করেন কোলাসোরা। নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে ফের বক্সের সামনে থেকে গোলে শট নেন কোলাসো। এবারও তা সোজা গোলকিপারের হাতে আটকে যায়। ভাগ্য দিন কোলাসোকে সঙ্গ না দিলেও ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাবটি তিনিই জেতেন।
মোহনবাগান এসজি দল (৪-৪-২): বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই (সৌরভ ভানওয়ালা-৯১), টম অলড্রেড, আলবার্তো রড্রিগেজ, শুভাশিস বোস, সহাল আব্দুল সামাদ (সুহেল ভাট-৬৯), দীপক টাঙরি, অনিরুদ্ধ থাপা (অভিষেক সূর্যবংশী-৭৮), লিস্টন কোলাসো (মনবীর সিং-৯১), জেসন কামিংস (গ্রেগ স্টুয়ার্ট-৭৮), জেমি ম্যাকলারেন।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: - মোহনবাগান এসজি ৪৫% - হায়দরাবাদ এফসি ৫৫%, সফল পাসের হার: ৭৪%-৮০%, গোলে শট: ৮-৭, ফাউল: ১১-৬, ইন্টারসেপশন: ২০-১৪, ক্রস: ১৭-১৮, কর্নার: ৫-২, হলুদ কার্ড: ২-৩।
ম্যাচের সেরা: লিস্টন কোলাসো (মোহনবাগান এসজি)