ডুরান্ড সেমিফাইনালে সামনে এফসি গোয়া, দাপটে ফেরার আত্মতুষ্টি নিয়ে সতর্ক মোহনবাগান এসজি
টানা সাত ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে জয় অধরা ছিল তাদের। চার দিন আগেই সেই খরা কাটিয়ে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে জয়ে ফিরেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট।


টানা সাত ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে জয় অধরা ছিল তাদের। চার দিন আগেই সেই খরা কাটিয়ে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে জয়ে ফিরেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। তাও রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে। এ রকম সময়ে শিবিরের মধ্যে আত্মতুষ্টির অনুপ্রবেশের সম্ভাবনাই থাকে বেশি। কিন্তু পরের ম্যাচ যেখানে মুম্বই সিটি এফসি-র মতোই আরও এক শক্তিশালী দল এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে, সেখানে এই আত্মতুষ্টির প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়াই উচিত।
সবুজ-মেরুন শিবিরেও তাই ‘আত্মতুষ্টি নিষিদ্ধ’ বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছেন তাদের স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো। তাঁর স্পষ্ট ইঙ্গিত, মুম্বই সিটি এফসি-কে হারিয়েছ, অর্ধেক তৈরি অবস্থাতেও দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছ, এ সব ঠিকই আছে। কিন্তু তাই বলে নিজেদের এখন থেকেই চ্যাম্পিয়ন ধরে নেওয়ার কোনও কারণই নেই। ফুটবলে কখন যে কী হবে, তা মঙ্গলবার ডুরান্ড কাপের প্রথম সেমিফাইনালেই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। তাই দ্বিতীয় সেমিফাইনালে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার কথা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার প্রশ্নই ওঠে না।
ডুরান্ড কাপের গ্রুপ পর্ব থেকে তাদের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে হয় নিজেদের গোলসংখ্যা ও অন্য দলের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে। তখন অবশ্য এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে ওঠার চিন্তাও ছিল সবুজ-মেরুন শিবিরে। এখন আপাতত আর সে চিন্তা নেই। কারণ, এএফসি কাপের খেলা আবার সেই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। তাই ফেরান্দো-বাহিনীর ফোকাস আপাতত ডুরান্ডের ম্যাচেই রয়েছে। সত্যিই যে তা রয়েছে, তা বোঝা যায় মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচেই।
প্রথম মুম্বই-জয়ের আত্মবিশ্বাস
সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের বিচারে মুম্বই সিটি এফসি গত রবিবার এগিয়ে থেকে মাঠে নামলেও মোহনবাগান এসজি-র দাপটে তাদের সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। এক ডজন গোল দিয়ে ও একটিমাত্র গোল খেয়ে গ্রুপ পর্বে অপরাজিত থাকা গ্রেগ স্টুয়ার্টরা সে দিন তাদের সবুজ-মেরুন প্রতিপক্ষের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন এবং ১-৩-এ হেরে ডুরান্ড কাপে গতবারের রানার্সরা এ বার শেষ আট থেকেই ছিটকে যায়।
দুই দলই সে দিন অসাধারণ দলগত পারফরম্যান্স দেখালেও গোলের সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে মোহনবাগান এগিয়ে থাকায় তারাই জয়ের হাসি নিয়ে মাঠ ছাড়ে। সারা ম্যাচে মুম্বই যেখানে পাঁচটি শট গোলে রাখে, সেখানে তিনটি গোলমুখী শট নেয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। বল দখলের লড়াইয়ে মুম্বই অনেকটাই এগিয়ে (৬১-৩৯) থাকলেও প্রতিপক্ষের গোলের সামনে ব্যর্থতার জন্যই তাদের শেষ পর্যন্ত হারের মুখ দেখতে হয়।
সাত মিনিটের মাথাতেই পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন মোহনবাগানের অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার জেসন কামিংস। কিন্তু সেই গোল শোধ করেন মুম্বইয়ের আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড জর্জ পেরেইরা দিয়াজ। দু’মিনিটের মধ্যেই ফের ব্যবধান তৈরি করেন মনবীর সিং এবং দ্বিতীয়ার্ধে জয় নিশ্চিত করার গোলটি করেন এ ডিফেন্ডার আনোয়ার আলি, যিনি এই নিয়ে ডুরান্ডে তিন গোল করে ফেললেন।
‘আত্মতুষ্টির জায়গা নেই’
এ রকম জয়ের পর দলের আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফোটাই উচিত। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাস যাতে আত্মতুষ্টিতে পরিণত না হয়, সে দিকে যথেষ্ট সতর্ক রয়েছেন বলে জানান সবুজ-মেরুন কোচ। বুধবার ক্লাবের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে আইএসএলের নক আউট চ্যাম্পিয়নদের কোচ বলেন, “আমাদের সামনে এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচ আছে। তাই এফসি গোয়ার মতো শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে খেললে সেই ম্যাচের ভালই প্রস্তুতি সারা হবে। মুম্বইকে হারিয়েছি বটে। কিন্তু আরও উন্নতি করতে হবে আমাদের। মুম্বইয়ের মতো দলকে হারিয়েছি বলে গোয়াকেও হারাতে পারব, দলের ছেলেদের এমন আত্মতুষ্টিতে ভুগতে দিতে রাজি নই। আমরা আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু আত্মতুষ্ট নই”।
কলকাতায় এসে এ পর্যন্ত চার ম্যাচে তিন গোল দেওয়া বিশ্বকাপার জেসন কামিংসের গলাতেও প্রত্যয়ের সুর। বলছেন, “মুম্বইকে হারিয়ে আমরা বাড়তি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। গোয়াকে হারানোর ব্যাপারেও তাই আমি আশাবাদী। ডুরান্ড ফাইনালে যাওয়ার দিকেই এখন আমাদের যাবতীয় ফোকাস। আইএসএল ও এএফসি কাপের আগে প্রস্তুতি টুর্নামেন্টে যদি একটা ট্রফি আসে, তা হলে দলের মনোবল বাড়ে। সেই চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব”। দলের অন্যদের গলাতেও একই সুর শোনা যাচ্ছে।
নিজেকে এখনও সেরা জায়গায় নিয়ে আসতে পারেননি বলে মনে করেন কামিংস। বলেন, “অস্ট্রেলিয়ায় আমি প্রচুর গোল করেছি। এখানেও গোল পেতে শুরু করেছি। তবে নিজের সেরা খেলাটা এখনও মেলে ধরতে পারিনি। সেরাটা দেওয়ার জন্য পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। আরও কয়েকটা ম্যাচ লাগবে নিজের একশো শতাংশ দেখাতে। সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটাতে গেলে গোল করতে হবে, জিততে হবে, ট্রফি পেতে হবে”।
লড়াইয়ের জন্য তৈরি
এই ম্যাচে অস্ট্রেলীয় ডিফেন্ডার ব্রেন্ডান হ্যামিলকে ছাড়া পুরো দলই হাতে পাচ্ছেন ফেরান্দো। এফসি গোয়ার সাম্প্রতিক ম্যাচগুলির ময়না তদন্ত করে তাদের শক্তি-দুর্বলতার আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে সবুজ-মেরুন শিবির এবং সেগুলোর ভিত্তিতেই নিজেদের প্রস্তুতি সারছে তারা। পাশাপাশি মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে তারা যে ভুলগুলি করেছেন, সেগুলি সংশোধনের কাজও হচ্ছে মোহনবাগান শিবিরে। চারদিনের মধ্যে দু’টি কঠিন ম্যাচ। তাই দলে ও রণনীতিতে পরিবর্তন আসতেই পারে।
গত ম্যাচের আগে পর্যন্ত সাত গোল দিয়ে এক গোল খাওয়া সবুজ-মেরুন শিবিরের পারফরম্যান্স সমর্থকদের মন ভরাতে পারেনি। বিশেষ করে ডার্বির খেলা তো নয়ই। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের পারফরম্যান্সে ফের সেই চেনা ছন্দ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। দলের নির্ভরযোগ্য অস্ট্রেলিয়ান অ্যাটাকার দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে রিজার্ভ বেঞ্চে রেখে দিয়েও দল নামাতে পারছেন ফেরান্দো, এটাই সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাপার। গত ম্যাচে দল ৩-১-এ এগিয়ে যাওয়ার পর আরমান্দো সাদিকুকে তুলে পেট্রাটসকে নামান তিনি। হুগো বুমৌস তাঁর চেনা ছন্দে ফিরেছেন। কামিংস, সাদিকু প্রতি ম্যাচেই যে উন্নতি করছেন, তা বোঝাই যাচ্ছে। আশিক কুরুনিয়ান, সহাল আব্দুল সামাদ, মনবীর সিংদের সঙ্গে ক্রমশ বোঝাপড়া গড়ে তুলছেন তাঁরা। ফলে দলের আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে।
রবিবারের মতো রক্ষণকে আঁটোসাঁটো রেখে পেট্রাটস, বুমৌস, কামিংস ও সাদিকুরা যদি নিজেদের মধ্যে ঠিকমতো বোঝাপড়া বজায় রেখে আক্রমণ শানিয়ে যেতে পারেন, তা হলে এফসি গোয়াকে হারানো সম্ভব। রক্ষণে যে ভরসা জোগাতে পারেন, গত দুই ম্যাচে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন নবনিযুক্ত বিদেশি ডিফেন্ডার হেক্টর ইউস্তে। তাঁর সঙ্গে আনোয়ার আলি, শুভাশিস বোসরাও ভাল ছন্দে রয়েছেন। ফলে গোয়ার দলের পক্ষে গোল করাটা মোটেই সহজ হবে না।
তবে সেটপিস মুভে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে দু’পক্ষকেই। কারণ, দুই দলেরই সেট পিস মুভ থেকে গোল করার প্রবণতা যথেষ্ট এবং সফলও হয়েছে তারা। সবুজ-মেরুন শিবিরে সেট পিস থেকে যেমন প্রায়ই বিপজ্জনক হয়ে উঠছেন আনোয়ার, তেমনই সন্দেশ ঝিঙ্গনকেও নজরে না রাখলে বিপদ হতেই পারে।
শক্তিশালী গোয়া, বিপজ্জনক নোয়া
গ্রুপ পর্বে শিলং লাজং এফসি-কে ছ’গোলে হারায় এফসি গোয়া। মরক্কোর ফরোয়ার্ড নোয়া সাদাউই সেই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন। এ ছাড়াও স্কোরশিটে নিজেদের নাম তোলেন রাওলিন বোর্জেস, ভিক্টর রড্রিগেজ ও কার্লোস মার্টিনেজ। দ্বিতীয় ম্যাচে জয়ের ধারা বজায় রাখতে পারেনি তারা, ২-২-এ নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে ড্র করে। সে দিন প্রথম দলে সাতটি পরিবর্তন করে মাঠে নামে গোয়া। এক গোলে পিছিয়ে থাকার পর বিরতির ঠিক আগে কর্নার থেকে গোল পান রাওলিন। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে সন্দেশের নিজগোলে ফের পিছিয়ে পড়ে। ম্যাচের শেষ দিকে নোয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে ম্যাচ ড্র করেন।
গ্রুপের শেষ ম্যাচে ডাউনটাউন হিরোজের বিরুদ্ধে হাফ ডজন পরিবর্তন করে দল নামায় গোয়া এবং মুহাম্মাদ নেমিল, কার্লোস মার্টিনেজ ও দেবেন্দ্র মুরগাওকরের গোলে ৩-০-য় জেতে। কোয়ার্টার ফাইনালে রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে চেন্নাইন এফসি-কে ৪-১-এ হারায় তারা। এক গোলে পিছিয়ে থেকেও সদ্যনিযুক্ত কার্ল ম্যাকহিউয়ের গোলে সমতা ফেরায় তারা। মার্টিনেজ ও নোয়া বাকি দুটি গোল করেন। পাঁচ গোল করে সর্বোচ্চ স্কোরারদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন নোয়া। যিনি গত মরশুমে ক্লাবের হয়ে ১১ গোল করেন ও ন’টি অ্যাসিস্ট দেন। মার্টিনেজও তিন গোল করে ফেলেছেন। রাওলিন ও রড্রিগেজ দু’টি করে গোল করেছেন। এঁদের প্রত্যেককেই নজরে না রাখলে সমস্যায় পড়তে পারে সবুজ-মেরুন বাহিনী।
প্রতিপক্ষ সম্পর্কে তাদের প্রাক্তন কোচ ফেরান্দো বলেন, “মুম্বইয়ের মতো এফসি গোয়াও যথেষ্ট ব্যালান্সড দল। গতবারের গোয়ার সঙ্গে এবারের গোয়ার অনেক পার্থক্য রয়েছে। ওদের নতুন কোচ। নোয়া, বরিস, উদান্ত সন্দেশ, কার্ল ম্যাকহিউ-র মতো ফুটবলার রয়েছে। ফলে ওদের বাড়তি গুরুত্ব দিতেই হবে। ওরা ফাইনালে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ঝাঁপাবে। ফলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। জেতার জন্য ম্যাচের শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়তে হবে। বাড়তি সময়েরও প্রতি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ”। ফেরান্দোর এই কথাগুলি কামিংসরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারলে রবিবার ফের কলকাতা ডার্বি আসন্ন।
অন্যদিকে, গোয়ার নতুন কোচ মানোলো মার্কেজ বলছেন, “মোহনবাগানের মতো দলের সঙ্গে ওদের ঘরের মাঠে খেলা, আমাদের অনেক কিছু শেখাতে পারে। আমাদের প্রাক মরশুম প্রস্তুতির শেষ পর্ব শুরু হয়েছে সবে। এরকম কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়ায় আমাদেরই আইএসএলের প্রস্তুতিতে অনেক সুবিধা হবে। মোহনবাগান খুবই শক্তিশালী। ওরা খুব ভাল দল গড়েছে। ভারতের সেরা ফুটবলাররা ওদের দলে রয়েছে। আমাদের কাছে বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ এটা”।
ডুরান্ড কাপ, ২০২৩ সেমিফাইনাল
ম্যাচ- মোহনবাগান এসজি বনাম এফসি গোয়া
ভেনু- যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা
কিক অফ- ৩১ অগাস্ট, সন্ধ্যা ৬.০০
সম্প্রচার- সোনি টেন ১, সোনি লিভ অ্যাপ