মুম্বই সিটি এফসি-কে প্রথম হারিয়ে প্রথম লিগশিল্ড জয় মোহনবাগান এসজি-র
গত আটবার যা পারেনি তারা, সোমবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সেটাই করে দেখাল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এক নয়, জোড়া অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়ে প্রথমবার আইএসএলে লিগসেরার খেতাব জিতল এবং লিগের ইতিহাসে এই প্রথম তারা হারাল মুম্বই সিটি এফসি-কে।
আট মিনিটের স্টপেজ টাইম দেওয়া হলেও খেলা গড়িয়ে যায় দশ মিনিট পর্যন্ত। নবম মিনিটে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের শট বারের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার পরেই প্রতি আক্রমণে জয়েশ রানে বক্সের বাইরে থেকেই দূরপাল্লার শট নেন, যা অল্পের জন্য পোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন উত্তেজনায় তখন থরথর করে কাঁপছে যুবভারতীর গ্যালারির প্রতিটি সবুজ-মেরুন সমর্থক।
প্রথম লিগশিল্ড জয়ের স্বপ্ন দেখা সবুজ-মেরুন বাহিনী তখন ২-১-এ এগিয়ে। মুম্বই সিটি এফসি আর একটি গোল করলেই তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে। বাড়তি সময় দশ মিনিট গড়িয়ে যাওয়ার পর অশান্ত হয়ে ওঠে গ্যালারি এবং মোহনবাগানের ডাগ আউট। ঠিক তখনই বেজে ওঠে রেফারির শেষ বাঁশি এবং যুবভারতীর আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে মোহনবাগান জনতার উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরণে।
গত আটবার যা পারেনি তারা, সোমবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সেটাই করে দেখাল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এক নয়, জোড়া অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়ে প্রথমবার আইএসএলে লিগসেরার খেতাব জিতল এবং লিগের ইতিহাসে এই প্রথম তারা হারাল মুম্বই সিটি এফসি-কে।
এর আগে দু-দু’বার লিগশিল্ড হাতছাড়া করতে হয়েছিল স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসকে। সবুজ-মেরুন বাহিনী যে বার প্রথম আইএসএলে খেলে, সে বার লিগশিল্ড এবং কাপ দু’টিই তাদের ছোঁয়া হয়নি মুম্বই সিটি এফসি-র জন্য। তিন বছর পর সেই হারের বদলা নিল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী দল। সোমবার যুবভারতীর প্রায় ৬০ হাজার সমর্থকের সামনে আইএসএল ২০২৩-২৪-এর লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়ন মুম্বই সিটি এফসি-কে ২-১-এ হারিয়ে লিগসেরার খেতাব জিতে নিল তারা।
এ দিন ম্যাচের ২৮ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসোর গোলে এগিয়ে যায় মোহনবাগান এসজি। ৮০ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড জেসন কামিংস। সারা ম্যাচে গোলের জন্য মরিয়া মুম্বই সিটি এফসি-কে অবশেষে ৮৯ মিনিটর মাথায় গোল এনে দেন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে। এই ম্যাচ ড্র করলেই লিগশিল্ড উঠত মুম্বইয়ের ফুটবলারদের হাতে। কিন্তু ম্যাচের শেষ ১০ মিনিট দশ জনে খেলেও মুম্বইকে সেই আকাঙ্খিত গোলটি করতে দেয়নি মোহনবাগানের দুর্ভেদ্য রক্ষণ। ২২ ম্যাচে ৪৮ পয়েন্ট পেয়ে লিগের সেরার খেতাব জিতে নিল তারা। যা লিগের ইতিহাসে এক নয়া রেকর্ড। এই সাফল্যের ফলে আগামী মরশুমে এশিয়ার সেরা ক্লাব লিগ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে সরাসরি খেলার যোগ্যতাও অর্জন করল তারা। যে কৃতিত্ব এর আগে এফসি গোয়া ও মুম্বই সিটি এফসি-র ছিল।
মুম্বইয়ের ৪-৩-৩ ছকের বিরুদ্ধে এ দিন মোহনবাগান শুরু করে ৩-২-৪-১-এ, অর্থাৎ তিন ব্যাকে। লিস্টন কোলাসো এই ম্যাচে মোহনবাগানের প্রথম এগারোয় ফিরে আসে এবং মুম্বইয়ের বিক্রম প্রতাপ সিংয়ের জায়গায় প্রথম দলে আসেন বিপিন সিং। লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, জর্জ পেরেইরা দিয়াজ ও বিপিনকে সামনে রেখে দল সাজান মুম্বইয়ের কোচ পিটার ক্রাতকি এবং আরমান্দো সাদিকুকে সবার আগে ও তাঁর পিছনে লিস্টন কোলাসো, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, অনিরুদ্ধ থাপা ও মনবীর সিংকে রেখে দল সাজান বাগান কোচ আন্তোনিও হাবাস, যাঁকে তিন ম্যাচ পর এ দিন ডাগ আউটে দেখা যায়।
শুরু থেকে দুই দলই এ দিন উইং নির্ভর আক্রমণে ওঠে। মুম্বইয়ের বিপিন বাঁ দিক দিয়ে ঘন ঘন আক্রমণ তৈরি করেন এবং মোহনবাগানের বাঁদিকে কোলাসো ও ডানদিকে মনবীর ছিলেন আক্রমণে ওঠার দায়িত্বে। দু’পক্ষেরই রক্ষণ এ দিন সর্বদা সজাগ ছিল। ফলে দুই দলেরই অ্যাটাকারদের বক্সে ঢুকে গোলে শট নেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে প্রথম ১৯ মিনিটের মধ্যে কোনও পক্ষই কোনও শট বা হেড অপর দলের গোলে রাখতে পারেনি।
ম্যাচের প্রথম সুবর্ণ সুযোগটি ২০ মিনিটের মাথায় তৈরি করে নেয় মোহনবাগান, যখন ডানদিক থেকে থাপার অসাধারণ ও নিখুঁত ক্রসে হেড করে গোল করার মরিয়া চেষ্টা করেন কোলাসো, কিন্তু তা পোস্টে লেগে ফিরে আসে। এই সময়ে মোহনবাগানকেই বেশি আক্রমণাত্মক লাগে। তাদের বল পজেশনও ছিল বেশি।
প্রথম চেষ্টায় যা পারেননি কোলাসো, ন’মিনিট পরে দ্বিতীয় চেষ্টায় আর সুযোগ হাতছাড়া করেননি তিনি। ২৯ মিনিটের মাথায় বক্সের সামনে থেকে বাঁদিকের কোণে থাকা কোলাসোকে বল পাঠান দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, তাঁকে আটকাতে আসেন মেহতাব সিং। কিন্তু তাঁকে পরপর দু’বার ইনসাইড-আউটসাইড করে সোজা গোলে নাকল শট নেন কোলাসো এবং ডানদিকের ওপরের কোণ দিয়ে বল জড়িয়ে যায় মুম্বইয়ের গোলে (১-০)।
সমতা আনতে মরিয়া মুম্বই সিটি এফসি পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং ৩৬ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে থেকে সোজা গোলে জোরালো শট নেন তাদের ডাচ মিডফিল্ডার ফান নিফ, যা ডানদিকে ডাইভ দিয়ে সেভ করেন বিশাল। প্রথমার্ধের নির্ধারিত সময়ের একেবারে শেষ মিনিটে ছাঙতে ছ’গজের বক্সের মাথা থেকে ঠিকমতো বলে শট নিতে পারলে অবধারিত গোল পেতেন। বক্সের ডানদিক থেকে গোলের বলটি তাঁকে প্রায় সাজিয়ে দেন পেরেইরা দিয়াজ। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি ছাঙতে। স্টপেজ টাইমে ফের বক্সের বাইরে থেকে শট নেন ফান নিফ, যা বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়।
প্রথমার্ধে মোহনবাগান যেখানে বিপক্ষের বক্সের মধ্যে আটবার বল ছোঁয়, সেখানে মুম্বই ছোঁয় দশবার। মুম্বই যেখানে পাঁচটির মধ্যে তিনটি শট গোলে রাখে, সেখানে মোহনবাগানের আটটি শটের মধ্যে মাত্র একটি ছিল গোলে এবং সেটি থেকেই গোল করে তারা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আগ্রাসী আক্রমণ শুরু করে মুম্বই সিটি এফসি এবং প্রথম মিনিটেই বক্সের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে গোলে শট নেন বিপিন, যা গোলকিপার বিশালের পিছনে ও গোললাইনের সামনে থাকা হেক্টর ইউস্তে আটকান। এই সময়ে মোহনবাগানকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে দেয় মুম্বই। কারণ, এই ম্যাচে ড্র করলেই লিগশিল্ড পেয়ে যেত তারা। কিন্তু মরিয়া হয়ে ডিফেন্স করে কলকাতার দল। বিপিনের চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পরেই নগুয়েরা বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শট নেন, যা বাঁদিকে ডাইভ দিয়ে বাঁচান বিশাল।
এই সময়ে উড়ন্ত বল দখল করতে গিয়ে তিরি ও সাদিকুর মধ্যে সঙ্ঘর্ষে দুজনেরই মাথায় চোট লাগে। যার কিছুক্ষণ পরে তিরিকে মাঠ ছাড়তে হয়। ৫৯ মিনিটে তাঁর জায়গায় স্লোভাকিয়ান ফরোয়ার্ড ইয়াকুব ভোইতুসকে নামায় মুম্বই। আক্রমণে ধার বাড়ানোর জন্যই এই সিদধান্ত নেন ক্রাতকি। তিরির জায়গায় রক্ষণে নেমে আসেন ফান নিফ।
মুম্বই আগ্রাসী হয়ে ওঠার ফলে ৬২ মিনিটে জনি কাউকোর জায়গায় ব্রেন্ডান হ্যামিলকে নামান হাবাস। সমান ভাবে আক্রমণের ঝাঁঝ বজায় রাখার জন্যও সাদিকুর জায়গায় জেসন কামিংসকে নামান তিনি। হ্যামিল মাঠে আসার পর আনোয়ার একটু ওপরে চলে যান, যা বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচেও দেখা গিয়েছিল।
শুরুতে মুম্বই প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখলেও ক্রমশ চাপ সামলে পাল্টা আক্রমণে যেতে শুরু করে মোহনবাগান। ৬৮ মিনিটের মাথায় মুম্বই সিটি এফসি নগুয়েরাকে তুলে নেওয়ার পরে তাদের আক্রমণে কিছুটা হলেও ভাটা আসে এবং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে মোহনবাগান। ৭৮ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে ওঠা মনবীরের কাটব্যাকে বক্সের বাইরে থেকে গোলে দূরপাল্লার শট নেন থাপা, যা সেভ করেন মুম্বইয়ের গোলকিপার ফুর্বা লাচেনপা।
সমতা আনার জন্য মরিয়া মুম্বই সিটি এফসি অল আউট চলে গেলে পাল্টা আক্রমণে ওঠাই ছিল মোহনবাগানের কৌশল এবং তাদের সেই কৌশলই সফল হয় ৮০ মিনিটের মাথায়, যখন দ্বিতীয় গোল করে ব্যবধান বাড়িয়ে নেন জেসন কামিংস। কোলাসোর গোলের মতো এই গোলেও পেট্রাটসের কৃতিত্ব ছিল ৫০ শতাংশ।
বাঁ দিক দিয়ে সেন্টার লাইন পেরিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সের সামনে কামিংসের উদ্দেশ্যে ডানদিকে কোণাকুনি উড়ন্ত ক্রস বাড়ান পেট্রাটস। যা প্রথমে ঠিকমতো রিসিভ করতে না পারলেও এতটা জায়গা ও সময় পান তিনি যে, ভুল শুধরে নিয়ে ফের বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বক্সে ঢুকে ফান নিফকে ডজ করে ডান পায়ে গোলে শট নেন ও জালে বল জড়িয়ে দেন (২-০)।
এ দিন দলের দুটি গোলেই অ্যাসিস্ট করেন পেট্রাটস। সারাক্ষণ মাঠে থেকে প্রতিপক্ষের বক্সে চারবার বল ছোঁন তিনি। দুটি গোলের সুযোগ তৈরি করেন। ফাইনাল থার্ডে ছ’বার ঢোকেন ও দশটি পাস বাড়ান। সব মিলিয়ে তিনিই ছিলেন এই ম্যাচের সেরা ফুটবলার ও মোহনবাগানের প্রথম লিগশিল্ড জয়ের অন্যতম নায়ক।
সারা ম্যাচে যে চেষ্টা করে সফল হতে পারেননি মুম্বইয়ের অ্যাটাকাররা, সেই চেষ্টা অবশেষে সফল হয় নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার দু’মিনিট আগে ছাঙতের গোলে। ফান নিফের ফ্রিকিক বক্সের মধ্যে উড়ে যাওয়ার পর আপুইয়া তা হেড করে বক্সের ডানদিকে থাকা ছাঙতেকে দেন। সম্পুর্ণ অরক্ষিত ছাঙতে কোণাকুনি গ্রাউন্ড শটে জালে বল জড়িয়ে দেন (২-১)।
কিন্তু নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে যে ধাক্কাটা খায় মোহনবাগান, তা ছিল অভাবনীয়। ব্রেন্ডান হ্যামিল লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়ে চলে যান। প্রথমে থ্রো ইনে সময় নষ্ট করার জন্য ও পরে রেফারির সঙ্গে তর্ক করার জন্য তাঁকে মাঠ ছাড়ার নির্দেশ দেন রেফারি। অর্থাৎ, বাড়তি যে আট মিনিট দেন রেফারি, তার পুরোটাই মোহনবাগান খেলে দশজনে।
বাড়তি সময়ে অশান্ত হয়ে ওঠে মাঠের পরিবেশ, যখন কামিংস ও আপুইয়ার মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয় এবং দু’জনেরই সতীর্থরা এসে একে অপরের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। আট মিনিট বাড়তি সময় দিলেও তা দশ মিনিট গড়িয়ে যায়। কিন্তু বাড়তি সময়ে পেয়েও তা মুম্বইকে কাজে লাগাতে দেয়নি মোহনবাগান।
মোহনবাগান এসজি দল (৩-২-৪-১): বিশাল কয়েথ (গোল), আনোয়ার আলি, হেক্টর ইউস্তে, শুভাশিস বোস, অভিষেক সূর্যবংশী (দীপক টাঙরি-৫৭), জনি কাউকো (ব্রেন্ডান হ্যামিল-৬২), লিস্টন কোলাসো (লালরিনলিয়ানা হ্নামতে-৮৭), দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, অনিরুদ্ধ থাপা (আশিস রাই-৮৭), মনবীর সিং, আরমান্দো সাদিকু (জেসন কামিংস-৬২)।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: মোহনবাগান এসজি ৪৪.৬% - মুম্বই সিটি এফসি ৫৫.৪% , সফল পাসের হার: ৭৮%-৮২%, গোলে শট: ৩-৬ ফাউল: ১২-১১, ইন্টারসেপশন: ৭-৫, ক্রস: ১০-২১, কর্নার: ১-২, হলুদ কার্ড: ৪-৪।
ম্যাচের সেরা: দিমিত্রিয়স পেট্রাটস