কলকাতার দুই প্রধানে না খেলেও হিরো আইএসএলের দরজা খুলে ফেলাটা বাংলার যে কোনও ফুটবলারের কাছেই কঠিনতম হার্ডল। সেই হার্ডল পেরিয়ে এখন জামশেদপুর এফসি-র অন্যতম নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় ঋত্বিক দাস। গত মরশুমে তাঁর দেওয়া গোলেই এটিকে মোহনবাগানের লিগ শিল্ড জেতার স্বপ্ন ভেঙে যায়। আসানসোলে ছোটবেলা থেকে ফুটবলজীবন শুরু করার পরে এই জায়গায় আসতে ঋত্বিককে যে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে, সেই কাহিনী এ দেশের যে কোনও উঠতি ফুটবলারের কাছেই অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

গত হিরো আইএসএলের শেষ দিকে পরপর গোল করতে শুরু করেন তিনি। মুম্বই সিটি এফসি ও চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে পরপর দুই ম্যাচে গোল করার পরে শেষ দুই ম্যাচেও ওডিশা এফসি ও এটিকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গোল করেন ২৫ বছর বয়সি অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। । মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে শুধু গোল নয়, একটি অ্যাসিস্টও করেন। কোচ আওয়েন কোইল তাঁর ভূয়ষী প্রশংসা করেন।

তাঁর এই পারফরম্যান্স দেখে ভারতীয় কোচ ইগর স্টিমাচও ঋত্বিককে ভারতীয় শিবিরে ডেকে নেন এবং জাতীয় দলের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে নিয়ে যান কাতারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় দেশে ফিরে আসতে হয় ঋত্বিককে। তবে স্টিমাচের নজর তাঁর ওপরে রয়েছে। আসন্ন মরশুমে ভাল খেললে ফের ডাক পেতে পারেন এই প্রতিভাবান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।

Indiansuperleague.com -কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতীয় শিবিরে তাঁর অভিজ্ঞতা, গত হিরো আইএসএলে তাঁর পারফরম্যান্স ও আসন্ন মরশুমে তাঁর লক্ষ্য-সহ আরও নানা প্রসঙ্গে বলেছেন ঋত্বিক। সেই সাক্ষাৎকারেরই উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হল।          

এ বছর থেকে ফুটবল ক্যালেন্ডার আরও দীর্ঘ হচ্ছে। এ বার আরও পরিশ্রম বাড়বে, আরও ওয়ার্কলোড বেশি পড়বে। এ সব কি সহজেই সামলে নেওয়া যাবে বলে মনে করো? ভারতীয় দল ও ভারতীয় ফুটবলারদের উন্নতিতে এই পরিবর্তন কী ভাবে সাহায্য করবে বলে মনে হয়?

এটা আমাদের, অর্থাৎ ফুটবলারদের জন্য খুব ভাল খবর। একটা লম্বা মরশুম পাওয়া সবসময়ই ভাল, যেমন বিদেশে হয়। সারা বছর নিজেদের ফিট রাখার তাগিদ থাকে। এত দিন ধরে প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকা মানে ছন্দেও থাকা, যেটা খুব ভাল প্রভাব ফেলবে এবং ভারতীয় ফুটবলে ও জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ওপরও এর যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বছরের বেশির ভাগ সময়ই যদি আমরা ফুটবলের মধ্যে থাকতে পারি, তা হলে প্রত্যেক ফুটবলারই ব্যক্তিগত ভাবে উন্নতি করতে পারবে। মরশুম বড় হওয়া মানে আমাদের ফুটবল সংস্কৃতিতেও উন্নতি আসা, যেটা এখন খুবই দরকার। পরিশ্রম, ওয়ার্কলোড

যে রকম বাড়বে, সে রকম ম্যাচের মাঝের সময়ও নিশ্চয়ই বাড়বে। তাতে রিকভারির যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। ভারতীয় দলের ফুটবলাররাও এর ফলে যথেষ্ট উপকৃত হবে।  

হিরো আইএসএলে ভাল পারফরম্যান্সের পরে ভারতীয় দল থেকে ডাক পাওয়ার আশায় ছিলে? ডাক পাওয়ার পর ঠিক কী রকম লেগেছিল?

সত্যি বলতে, আমার কাছে এটা খুব প্রত্যাশিত ছিল না। আইএসএলে ভাল পারফরম্যান্স করেছিলাম ঠিকই। সে জন্য মনের মধ্যে একটা আশা ছিল যে হয়তো এ বার ভারতীয় দলের কোচ আমাকে শিবিরে ডাকবেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়িই যে সেটা আসবে ভাবিনি। তাই এটা আমার কাছে একটা সারপ্রাইজের মতোই ছিল বলতে পারেন। যখন শুনলাম যে আমাকে ভারতীয় দলের শিবিরে যোগ দিতে বলা হয়েছে, যে দল এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে খেলবে, তখন প্রথমে একটু অবাকই লেগেছিল। কারণটা তো বললামই। পরে যখন বুঝতে পারি, সত্যিই এমনটা হয়েছে, তখন নিজেকে প্রস্তুত করা শুরু করি। শারীরিক ও মানসিক সব দিক থেকেই প্রস্তুতি শুরু করি।     

চিকেনপক্সের জন্য তোমাকে ভারতীয় শিবির ছেড়ে চলে আসতে হল যখন, সেই সময়ে নিশ্চয়ই খুব হতাশ হয়েছিলে? ফের খুব তাড়াতাড়ি ভারতীয় দলে ডাক পাওয়ার আশায় আছ?

খুবই হতাশ হয়েছিলাম। কারণ, অনেক আশা নিয়ে দলের সঙ্গে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন বুঝতে পারি যে, আমাকে দু-তিন সপ্তাহ ঘরবন্দী থাকতে হবে, দলের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে পারব না, ম্যাচ খেলা তো দূরের কথা, তখন তো খারাপ লেগেছিলই। তাই ফিরে আসারই সিদ্ধান্ত নিই। এখন আমার লক্ষ্য, সামনে টুর্নামেন্টগুলোতে (ডুরান্ড কাপ, হিরো আইএসএল) প্রচুর পরিশ্রম করে, নিজের সেরাটা দিতে পারি এবং আবার ভারতীয় দলে ডাক পাই।

পরপর তিনটি ম্যাচ জিতে এশিয়ান কাপ ২০২৩-এ খেলার যোগ্যতা অর্জন করল ভারতীয় দল। দলের পারফরম্যান্স দেখার পরে কী বলবে? মূলপর্বে আমাদের দল কেমন করবে বলে তোমার মনে হয়?  

ওদের সাফল্য দেখে আমার দারুন লেগেছে। অসাধারণ খেলেছে আমাদের দল। আগে যখন ভারতীয় দলের খেলা দেখতাম, তখন একরকম লাগত। এখন ভারতীয় দলের সঙ্গে থাকার পরে অনুভূতিটা সম্পুর্ণ অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। যখন দেখলাম, দুর্দান্ত খেলে পরপর তিনটি ম্যাচ জিতে এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল আমাদের জাতীয় দল, তখন আগের চেয়ে যেন বেশিই খুশি হয়েছে। একটা নতুন ইতিহাস তৈরি করল আমাদের দল। এখনকার এই দলটার মধ্যে খুব ভাল একটা বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়া রয়েছে। পরষ্পরের মধ্যে বোঝাপড়া খুবই ভাল। জুনিয়র ও সিনিয়রদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল। তাই পারফরম্যান্সও খুব ভাল হচ্ছে।

আরও এক বছর হাতে আছে। এর মধ্যে সবাই ভাল খেলে, পরিশ্রম করে নিজেদের সেরাটা যদি দিতে পারে প্রত্যেকে, তা হলে আশা করি, এশিয়ান কাপে ভাল ফল হবে। আমাদের দলের প্রত্যেক পজিশনেই বেশ উঁচু মানের খেলোয়াড় আছে। সবাই এককাট্টা থাকে। এটা একটা বড় শক্তি। প্রত্যেকের মধ্যেই ভাল কিছু করার আগ্রহ আছে। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলেও তাদের শুরু থেকেই চাপে রাখার ও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল না ছাড়ার প্রবণতাটাও এই ভারতীয় দলের প্লাস পয়েন্ট।

তা ছাড়া ভারতীয় দলের ট্রেনাররাও খেলোয়াড়দের প্রচন্ডরকম ভাবে উৎসাহিত করেন ও প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ফিটনেসের দিক থেকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে চলে এসেছেন যে, কলকাতার গরমে, আর্দ্র আবহাওয়ার মধ্যেও ৯০ মিনিট সমান স্ট্যামিনা বজায় রেখে খেলতে পারছি আমরা। যতদিন আমি শিবিরে ছিলাম, তখন আমাদের দু’বেলা প্র্যাকটিস হত। সকালে জিম, বিকেলে ট্রেনিং। সব মিলিয়ে দলটা এমন জায়গায় এসেছে।         

হিরো আইএসএলের প্রসঙ্গে আসা যাকএ বার। আওয়েন কোইলের পরে এ বার নতুন কোচ আসতে চলেছে জামশেদপুর এফসি-তে। কোইলের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তোমার কেমন?

তাঁর অধীনে খেলা আমার কাছে আশীর্ব্বাদ। দলের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে উনি চলতেন। উনি চাইতেন, আমরা প্রত্যেকে রোজই আরও ভাল কিছু করে দেখাই। অনুশীলনেও সেরাটা বার করে আনতেন। চাইতেন প্রতি ম্যাচ জিততে হবে। আমাদের মধ্যে সেই ইচ্ছাটা প্রবল ভাবে ঢুকিয়ে দিতে পারেন তিনি। ফলে আমরা প্রত্যকেই সব ম্যাচে জেতার মনোভাব নিয়েই নেমেছি। আমাকে ব্যক্তিগত ভাবেও উনি খুব প্রভাবিত করেছিলেন। আমারও খেলার মান অনেকটা উঁচুতে উঠেছে ওঁর জন্যই। ভুলগুলো শুধরে দেওয়া, কোন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, আমার কোথায় ভুল হচ্ছে, এগুলো খুব ভাল ভাবে বুঝিয়ে দিতেন উনি। আমি ওঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। মানুষ হিসেবেও নিজেকে অনেক পাল্টাতে পেরেছি। দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। তবে কারও পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট হতেন না। বলতেন, আরও ভাল করতে হবে। সে জন্যই আমরা লিগে ক্রমশ উন্নতি করেছি। প্রতি ম্যাচে আগের ম্যাচের চেয়ে ভাল খেলেছি। আমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উন্নতি এনে দিয়েছেন ফিনিশিংয়ে।

গত মরশুমে তুমি এবং তোমার দল যথেষ্ট ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়েছ। এই মরশুমে তোমার দলের কাছ থেকে যেমন প্রত্যাশা বেশি থাকবে, তেমন তোমার কাছ থেকেও। এ বার কি তাই বেশি চাপ সামলাতে হবে তোমাকে ও দলকে?

চাপের কথা এখন থেকেই বলতে পারছি না। তবে আমার নিজের পারফরম্যান্সে উন্নতি আনতেই হবে। নিজের প্রতি সেই দায়বদ্ধতা রয়েছে আমার। গতবার যতটুকু খেলতে পেরেছি, তার চেয়েও যাতে ভাল খেলতে পারি, নিজেকে যাতে আরও ভাল জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, সেই চেষ্টাটা অবশ্যই থাকবে। আগের চেয়ে যেন এক কিলোমিটার আরও বেশি দৌড়তে পারি। আরও বেশি গোলের জায়গায় পৌঁছতে পারি ও গোল করতে পারি। এটা আমার নিজের কাছে প্রত্যাশা থাকবে এ বার।

 আর দলের কথা যদি বলেন, গত মরশুমে প্রথমবার জামশেদপুর এফসি-কে লিগশিল্ড জিতিয়ে যে খুশি ও আনন্দ আমরা পেয়েছিলাম, সেই আনন্দ এ বারও আমরা পেতে চাই। আমি তো বটেই সতীর্থরাও এটাই চাইবেন নিশ্চয়ই। গতবার সবাই যেমন একশো শতাংশ দিয়েছিল, এ বার বোধহয় আরও দশ শতাংশ বেশি দেবে। বাড়তি মোটিভেশনও থাকবে এবার, গতবারের সাফল্যের জন্য।