অ্যাওয়ে ম্যাচে এমন দাপট এই মরশুমের হিরো আইএসএলে কোনও দল দেখাতে পেরেছে কি? সম্ভবত না। শনিবার বিপক্ষের ঘরের মাঠে নেমে যে আধিপত্য দেখালেন কলকাতার দলের ফুটবলাররা, তাতে তারা ছ’গোলে নর্থইস্ট ইউনাইটেডকে হারালেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু কয়েকটা সহজ সুযোগ নষ্ট ও নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র গোলকিপার সুভাশিস রায়ের অসাধারণ কিপিংয়ে এই লিগের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়টি পেল না এটিকে এফসি।

আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের দলের দুই গোলমেশিন ডেভিড উইলিয়ামসের একটি ও রয় কৃষ্ণার দেওয়া জোড়া গোলে এটিকে গুয়াহাটির ইন্দিরা গান্ধী অ্যাথলেটিক স্টেডিয়ামের মাঠ ছাড়ল ৩-০ গোলে জিতে তিন পয়েন্ট নিয়ে। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের দুর্ভাগ্য, তাদের সেরা তারকা ঘানাইয়ান বিশ্বকাপার আসামোয়া জিয়ান চোট পেয়ে ম্যাচের দশ মিনিটের মধ্যেই মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান। ফলে এটিকে ফুটবলাররা ম্যাচের বেশির ভাগ সময়েই বাড়তি চাপ ছাড়াই খেলেন এবং তাতেই আসে এই দাপুটে জয়। বল পজেশন, পাসের সংখ্যা, পাসিং অ্যাকিউরেসি, গোলে শট— এই পরিসংখ্যানগুলিতে নর্থইস্ট এগিয়ে থাকলেও গোলের খাতাই খুলতে পারল না তারা। উল্টে বিপক্ষের চাপ সহ্য করতে না পেরে তাদের রক্ষণের দৈন্যদশা প্রকাশ হয়ে গেল এই ম্যাচে।

নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র ঘরের মাঠে টানা দশ ম্যাচে অপরাজিত থাকার নজির শনিবার থামিয়ে দিয়ে ফের লিগ টেবলের শীর্ষে উঠে পড়ল এটিকে এফসি। সাত ম্যাচে চারটি জয় ও দু’টি ড্র-সহ ১৪ পয়েন্ট নিয়ে যাদের এখন অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছে। নর্থইস্ট ইউনাইটেড এ দিন এ বারের লিগের প্রথম হারের মুখ দেখলেও চার নম্বর জায়গা থেকে নেমে যায়নি। তবে ৯ গোল খেয়ে তাদের গোল পার্থক্য এখন -১ দাঁড়াল।

  • চার মিনিটের মাথাতেই আসামোয়া জিয়ান বক্সের মধ্যে বুক দিয়ে রিসিভ করলেও বলের নাগাল ঠিকমতো পাননি। বুটের সামনে দিয়ে হাল্কা শট নেন। এটিকে গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্য তা আটকে দেন।
  • ৯ মিনিটে ঊরুর চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন আসামোয়া। তাঁর পরিবর্তে নামেন ম্যাক্সিমিলিয়ানো বারেইরো।
  • ১১ মিনিটে ডান দিক থেকে ওঠা প্রবীর ক্রস থেকে নিখুঁত হেডে গোল করেন ডেভিড উইলিয়ামস।
  • ৩৫ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে উইলিয়ামসের থ্রু ধরে নিয়ে বক্সে এক ডিফেন্ডারকে ধোঁকা দিয়ে ইনসাইড কাট করে গোলকিপারের ডানদিক দিয়ে বল ঠেলে দেন গোলে।
  • ৯৩ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে জবি জাস্টিনের বাড়ানো থ্রু ধরে বিপক্ষের অর্ধে পুরো দৌড়ে গিয়ে নিজের ছনম্বর গোল করে আসেন কৃষ্ণা।

ম্যাচের ন’মিনিটের মাথায় আসামোয়া জিয়ানের মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং তার দু’মিনিট পরেই এটিকে-র গোল, দুটো ব্যাপারের মধ্যে কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকলেও প্রথম ঘটনায় যে এটিকে ফুটবলারদের ওপর থেকে মানসিক চাপের বোঝা যে অনেকটা কমে যায়, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

গুয়াহাটি রওনা হওয়ার আগে কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস বলেইছিলেন, ঘানার তারকা ফুটবলারের প্রতি বিশেষ নজর দিতেই হবে তাঁদের। সাধারণত এমন কথা বলতে চান না কলকাতার কোচ। বিপক্ষের কোনও একজনকে নিয়ে বেশি কথা বলা তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু এই খেলোয়াড়টি যেহেতু তিনটি বিশ্বকাপ খেলা আসামোয়া জিয়ান, তাই আলাদা করেই বলেছিলেন তাঁর কথা।

চার মিনিটের মাথায় আসামোয়া যে ওয়ান টু ওয়ান সুযোগটা পেয়েছিলেন, তাতে যদি ঠিকমতো শট নিতে পারতেন, তা হলে ম্যাচের ছবিটা কিন্তু একেবারে অন্য রকম হত। রাকেশ প্রধানের লব আসামোয়ার মাথার ওপর দিয়ে ল্যান্ড করছিল। তিনি বুক দিয়ে বলটা নামালেও বলের নাগাল ঠিকমতো পাননি। বুটের সামনে দিয়ে শট নেওয়ার চেষ্টা করায় তা জোরালো ছিল না। এটিকে-র গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যের তা আটকাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

কিন্তু এই ঘটনায় নর্থইস্ট ইউনাইটেড দু-রকম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একে তো গোলের সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট হয়। তার ওপর এই ঘটনার পর থেকেই আসামোয়ার ডানপায়ের ঊরুর পেশীতে সমস্যা শুরু হয়। যার জেরে তাঁকে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হয়। তাঁর পরিবর্তে নামেন আর্জেন্টিনার ৩৪ বছর বয়সি ফরোয়ার্ড ম্যাক্সিমিলিয়ানো বারেইরো। কিন্তু তিনি আর যেই হোন, আসামোয়া জিয়ান তো নন।

বিপক্ষের সবচেয়ে বিপজ্জনক ফুটবলারটি ম্যাচের শুরুতেই চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়াই যে তাদের পক্ষে এই ম্যাচে সবচেয়ে বড় খুশির খবর ছিল এবং এই খবরেই যে এটিকে বেশ চাঙ্গা হয়ে যায়, তা বোঝা যায় ১১তম মিনিটে চমৎকার মুভটি দেখে। এডু গার্সিয়ার লম্বা ও নিখুঁত ফ্রি-কিক থেকে পাওয়া বল ডান দিক থেকে ওঠা প্রবীর ক্রস করেন গোলের সামনে থাকা ডেভিড উইলিয়ামসকে। নিখুঁত হেডে তা গোলে লাইন পার করিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা গোলমেশিন ডেভিড উইলিয়ামস।

এর পর থেকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগই ছিল এটিকে-র ফুটবলারদের পায়ে। দু’পক্ষই বেশিরভাগ সময়টা লং বলে খেলার চেষ্টা করছিল। তবে কাউন্টার অ্যাটাকে প্রায়ই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিলেন কলকাতার ফুটবলাররা। ডেভিড উইলিয়ামস ও রয় কৃষ্ণাদের সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন নর্থইস্ট ডিফেন্ডাররা। এতটাই চাপে ছিলেন তাঁরা যে, শেষ পর্যন্ত তাদের রক্ষণ পুরো ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অন্যদিকে এটিকে-র রক্ষণ বিভাগ কিন্তু এ দিন আগোগোড়া ছিল ইস্পাতকঠিন।

বারবার তাঁদের আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে বিধ্বস্ত নর্থইস্ট ডিফেন্ডাররা ৩৫ মিনিটে ভুল করে বসেন কৃষ্ণাকে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে। মাঝমাঠ থেকে উইলিয়ামসের থ্রু ধরে নিয়ে ফিজির অলিম্পিয়ান স্প্রিন্ট টানেন ডিফেন্ডারদের পিছনে ফেলে। এক ডিফেন্ডারকে ধোঁকা দিয়ে ইনসাইড কাট করে বিপক্ষের গোলকিপার সুভাশিস রায়ের ডানদিক দিয়ে বল ঠেলে দেন গোলে। দ্বিতীয় গোলটার পরেই মোটামুটি জয় থেকে বিপক্ষকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয় এটিকে।

এর ১২ মিনিট আগেই গোলের একেবারে সামনে থেকে মিস করেছিলেন কৃষ্ণা। তিনি যে এ দিন সেরা ফর্মে ছিলেন, তা তাঁর বারবার আক্রমণে ওঠা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও কৃষ্ণাকে এতটা জায়গা ছেড়ে দেওয়ার ভুলের মাশুল দিতে হল কেই হিরিংসদের।

গোলের ব্যবধান আরও বাড়ত, যদি এডু গার্সিয়া ৩৭ মিনিটে বাঁ দিক দিয়ে ওঠা উইলিয়ামসের নিখুঁত মাইনাস থেকে গোল করার সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাতে পারতেন হাভিয়ে হার্নান্ডেজ। কিন্তু বক্সের বাঁ দিক থেকে হাভি গোলের মধ্যে বল রাখতে পারেননি। ৫৩ মিনিটে ডান দিক থেকে উইলিয়ামসের পাস থেকে ফাঁকা গোল পেয়েও তা বাইরে পাঠান কৃষ্ণা। ওই সময় এটিকে-র দুই ফরোয়ার্ডকে সামলাতে বক্সের মধ্যে ছিলেন শুধু এক ডিফেন্ডার ও গোলকিপার। এমন অবিশ্বাস্য মিস বোধহয় এ বারের হিরো আইএসএলে আর দেখতে পাওয়া যায়নি।

৬৪ মিনিটেও গোলে মাপা শট নিয়েছিলেন উইলিয়ামস। কিন্তু প্রাক্তন এটিকে তারকা সুভাশিসের অসাধারণ সেভে সে যাত্রা বেঁচে যায় নর্থইস্ট। ৭৮ মিনিটে ফের বক্সের মধ্যে তিন ডিফেন্ডারে ঘিরে ধরা উইলিয়ামস বনাম সুভাশিস যুদ্ধে জেতেন বাংলার গোলকিপারই।

নর্থইস্টকে তৃতীয় ধাক্কা দেন সেই কৃষ্ণা। ম্যাচের শেষ মিনিটে উইলিয়ামসের জায়গায় নামা জবি জাস্টিন মাঝমাঠ থেকে যে বল বাড়িয়েছিলেন, সেই বল নিয়েই বিপক্ষের প্রায় ফাঁকা অর্ধ পুরোটা দৌড়ে নিজের ছ’নম্বর নম্বর গোল’টি করে আসেন কৃষ্ণা। শুধু পয়েন্টের দিক থেকেই নয়, গোলসংখ্যাতেও সবার চেয়ে এগিয়ে রইল এটিকে।