এমন একটা সময়ে খালিদ জামিলকে ভারতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব দেওয়া হল, যখন ভারতীয় ফুটবলে এক কঠিন সময় চলছে। ১৩ বছর পরে কোনও ভারতীয় কোচকে জাতীয় দলের দায়িত্ব পাওয়াটা যেমন এক ঐতিহাসিক ঘটনা, তেমনই ভারতীয় দলকে এই জায়গা থেকে তিনি যদি টেনে তুলতে পারেন, তা হলে তা হবে আর এক ঐতিহাসিক সাফল্য।

এএফসি প্রো লাইসেন্স অর্জনকারী জামিল আই-লিগ, আই-লিগ ২ এবং ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল)-এ কোচিং করিয়েছেন। আইজল এফসি-কে আই-লিগ জেতানোর সময় থেকেই কোচ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন তিনি। এই ক্লাবের একমাত্র শীর্ষস্থানীয় শিরোপা ছিল সেটি। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় সাফল্য হিসেবে লেখা থাকবে তাদের এই কীর্তি।

তিনি ২০২৩–২৪ মরশুমের মাঝপথে জামশেদপুর এফসির দায়িত্ব নিয়ে দলকে সুপার কাপের সেমিফাইনালে নিয়ে যান এবং পরবর্তী মরশুমে রানার্স আপ ও আইএসএল সেমিফাইনাল পর্যন্তও পৌঁছে দেন। তার আগে ২০২০-২১ মরশুমে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কেও সেমিফাইনালে তোলেন তিনি।

বিভিন্ন দলকে তৈরি করে তাদের সাফল্যের দোরগোড়ায় এনে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি যেমন লড়াই করেছেন, তেমনই সফলও হয়েছেন। তবে এটা এটাও মনে রাখতে হবে, ক্লাব ফুটবলের এই লড়াইয়ে তিনি পেয়েছেন বিদেশি ফুটবলারদের এবং সেই লড়াইয়ে তিনি যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সামনে পেয়েছেন, আন্তর্জাতিক ফুটবলে জামিলকে আরও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দল নামাতে হবে।

যেমন ভারতীয় দলের কোচ হিসেবে জামিলের প্রথম পরীক্ষাই বেশ কঠিন হতে চলেছে। এ মাসের শেষ দিকে কাফা নেশনস কাপে তাঁর দল মুখোমুখি হবে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইরান, ফিফার ক্রমতালিকায় যারা আছে ২০ নম্বরে, ২০২৩ এশিয়ান কাপ কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট তাজিকিস্তানের, যারা রয়েছে ১০৬-এ এবং আফগানিস্তানের (১৬১)।

বর্তমানে ফিফা ক্রমতালিকায় ১৩৩ নম্বরে থাকা ভারতের সামনে বেশ কঠিন লড়াই। ইগর স্টিমাচ যখন ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন, সেই সময়, ২০২৩-এর জুলাইয়ে ভারত ক্রমতালিকায় ৯৯ নম্বরে উঠে গিয়েছিল। সেই বছরই ডিসেম্বরে ১০২-এ নেমে আসে। পরের ১৯ মাসে ভারত ৩১ ধাপ নেমে গিয়েছে, যা এক নেতিবাচক নজির বলা যায়।

এই জায়গা থেকে ভারতকে ফের টেনে তুলতে পারবেন কি না জামিল, সে প্রশ্ন অনেকেরই। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলে সুদিন আনার জন্য জামিলকে কোন কোন হার্ডল অতিক্রম করতে হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

চাই আরও গোল

ভারতের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল গোল করার সক্ষমতা বাড়ানো। ভারত শেষ তিনটি ম্যাচে একটিও গোল করতে পারেনি। এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৭-এর বাছাইপর্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তারা গোলশূন্য ড্র করে। হংকংয়ের কাছে ১-০-য় হেরে যায়। এই দুই ম্যাচের মাঝখানে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে তারা ২-০-য় পরাজিত হয়।

তারা শেষ গোল করে মার্চ মাসে ঘরের মাঠে মলদ্বীপের বিপক্ষে ৩-০-য় জেতা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে, যা এখন পর্যন্ত চলতি বছরে ভারতের একমাত্র জয়। এর আগে মানোলো মার্কেজের অধীনে ভারত আটটি ম্যাচে মাত্র পাঁচটি গোল করেছে, যার মধ্যে মাত্র তিনটিতে তারা গোলের দরজা খুলতে পেরেছে।

এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলিকে সামনে রেখে ভারতের এখন আক্রমণ বিভাগে ছন্দ ফিরে পাওয়া জরুরি। যদিও রক্ষণে তারা অনেকটাই শক্তিশালী এবং মাঝে মাঝে আক্রমণেও ইতিবাচক মুহূর্ত তৈরি করেছে, তবে সুযোগ কাজে লাগানো ও শেষ মুহূর্তে ধৈর্য্য বজায় রেখে ঠাণ্ডা মাথায় গোল করা— এই দুই দিকেই নজর দিতে হবে জামিলকে। দলের আক্রমণ বিভাগের ফুটবলারদের আরও নিখুঁত হয়ে উঠতে সাহায্য করতে হবে তাঁকে। ভারতে ভাল ফরোয়ার্ডের অভাব নেই। কিন্তু প্রতিভাকে গোলে পরিণত করার মন্ত্র দিতে হবে তাঁদের। এই কাজটা কোচকেই করতে হবে।

আইএসএলে জামিলের দলগুলি সাধারণত পাল্টা আক্রমণে গোল করার দক্ষতা এবং সীমিত সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের কার্যকরী করে তুলেছে। কিন্তু সেই সব দলে জামিল পেয়েছেন মূলত বিদেশি ফরোয়ার্ডদের। এ বার এই গুণগুলি যদি ভারতীয় দলের মধ্যেও সঞ্চারিত করতে পারেন খালিদ জামিল, তা হলে দলের উপকারই হবে।

এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ

এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৭-এর বাছাইপর্ব এখন জাতীয় দলের প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি। যে জায়গায় রয়েছে তারা, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে তাদের যথেষ্ট লড়াই করতে হবে। গ্রুপ সি-তে দু’টি ম্যাচ খেলে বর্তমানে মাত্র এক পয়েন্ট নিয়ে লিগ টেবলের একেবারে নীচে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে ড্র করেছে এবং হংকংয়ের কাছে হারের পর এমনই অবস্থা সুনীল ছেত্রীদের।

অক্টোবরে সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে পরপর দু’টি ম্যাচ রয়েছে ভারতের, যা এই অভিযানের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তার আগে আগে, কাফা নেশনস কাপের লড়াই। এই ম্যাচগুলি শুধুমাত্র দলের মধ্যে সঠিক রসায়ন তৈরির জন্য নয়, এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের আগে কৌশলগুলি পুরোপুরি ভাবে গুছিয়ে নেওয়ার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এর আগে দেশের ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম টানা দু’বার এএফসি এশিয়ান কাপের মূলপর্বে যোগ্যতা অর্জন করেছিল ভারত। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামিলের কাজ হবে বাছাইপর্বের অভিযানকে স্থিতিশীল করা এবং ভারতকে আবারও মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের যোগ্যতা অর্জনের দৌড়ে ফিরিয়ে আনা।

দলের খেলায় গঠন ও দক্ষতা জরুরি

খালিদ জামিলের অন্যতম বড় দায়িত্ব হবে তাঁর দলের মধ্যে এক স্পষ্ট কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্টিমাচ ভারতীয় দলকে মূলত বল দখল-ভিত্তিক খেলার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেই পদ্ধতিতে মাঝে মাঝে ইতিবাচক মুহূর্ত এলেও কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। দলটি প্রায়ই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা বল দখলের সুফল হিসেবে সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। একই ছবি দেখা গিয়েছে সদ্য প্রাক্তন কোচ মার্কেজের অধীনেও। তিনি পিছন থেকে আক্রমণ তৈরির ওপর জোর দিয়েছিলেন।

কিন্তু জামিলের প্রশিক্ষণের দর্শন একেবারেই আলাদা। তিনি ভারতীয় ফুটবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন বাস্তববাদী কৌশলবিদ হিসেবে। তাঁর দলকে দমানো কঠিন এবং পাল্টা আক্রমণে তাঁর দল অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ২০২০-২১ আইএসএল মরশুমে তাঁর প্রশিক্ষণে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র নজরকাড়া পারফরম্যান্স এবং ২০২৪-২৫ মরশুমে জামশেদপুর এফসি-কে আইএসএল প্লে-অফে তোলার মাধ্যমেই তাঁর সেই দক্ষতা প্রমাণিত হয়েছে।

ভারতের প্রয়োজন একটি স্পষ্ট রূপরেখা, বিশেষ করে সেই ম্যাচগুলিতে, যেখানে খুব ছোট ব্যবধানে ফলাফল নির্ধারিত হয়। জামিল যদি এমন একটি দল গড়ে তুলতে পারেন, যারা বল-সহ ও বল ছাড়া, দুই পরিস্থিতিতেই তাদের কী করণীয় তা ঠিকমতো বুঝতে পারে, তা হলে তিনি ভারতীয় ফুটবল দলের সমস্যার একটি বড় অংশের সমাধান করে ফেলতে পারবেন। এই কাজটা কী ভাবে করবেন তিনি, তা তাঁকেই ঠিক করতে হবে।