আজ ফতোরদার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে হিরো আইএসএল ফাইনালে দুই দলের এগারো বনাম এগারোর লড়াই দেখা যাবে ঠিকই। কিন্তু তার মধ্যেও ফুটবলপ্রেমী ও বিশেষজ্ঞদের নজরে থাকবে কিছু ব্যক্তিগত দ্বৈরথ। এই ‘ডুয়াল’ গুলির ওপর নির্ভর করবে ম্যাচের ভবিষ্যতও। দুই দলের গোল এরিয়ায় ও মাঝমাঠে এই ব্যক্তিগত লড়াইগুলিই হয়ে উঠতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কোন কোন ব্যক্তিগত দ্বৈরথ হিরো আইএসএল ফাইনালের মুখ্য আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে, তারই হদিশ দেওয়া হল এই প্রতিবেদনে।  

বিশাল কয়েথ বনাম গুরপ্রীত সিং সান্ধু

এ বারের হিরো আইএসএল ফাইনালে দেখা যাবে বর্তমান ও প্রাক্তন গোল্ডেন গ্লাভজয়ী গোলকিপারের দ্বৈরথ। দুই দলই তাদের গোলকিপারের ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল এবং দুই গোলকিপারই রয়েছেন দুরন্ত ফর্মে। যদিও শনিবার মাঠে মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই দু’জনের। কিন্তু মানসিক ভাবে একে অপরকে হারাতেই গোলে দাঁড়াবেন দু’জন।

এই মরশুমে জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছেন বিশাল কয়েথ। সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে তিনি ম্যাচের নায়কের সন্মানও অর্জন করে নেন। সেই ম্যাচে টাই ব্রেকারে হায়দরাবাদ এফসি-র হাভিয়ে সিভেরিওর শট আটকে দেন বিশাল ও সবাইকে অবাক করে দিয়ে বার্থোলোমিউ ওগবেচের শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। এই দুই ভুলের জেরেই সে দিন সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে যায় গতবারের চ্যাম্পিয়নরা। তার আগেই অবশ্য সেরা গোলকিপারের সোনালী ব্যান্ড পেয়ে যান সবুজ-মেরুন গোলকিপার। ফাইনালে বাহুতে সেই আর্মব্যান্ড ও বুকভরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামবেন তিনি। মোট ১২টি ক্লিন শিট রেখেছেন তিনি, যা চলতি লিগে সর্বোচ্চ। সেমিফাইনালে বেঙ্গালুরু এফসি ন’টি পেনাল্টি শটের সবক’টি থেকেই গোল করে। ফাইনালও যদি পেনাল্টি শুট আউটে গড়ায় তা হলে কঠিনতম পরীক্ষার সামনে পড়তে হবে ২৬ বছর বয়সি বিশালকে। বেঙ্গালুরুর ধারালো আক্রমণ সামলানোটাও অবশ্য কম বড় পরীক্ষা নয়।

সুনীল ছেত্রী মাঠে না থাকলে যিনি একেবারে পিছন থেকে দলকে নেতৃত্ব দেন, তিনি বেঙ্গালুরু এফসি-র গোলকিপার গুরপ্রীত। ৩১ বছর বয়সি গুরপ্রীত চলতি লিগে সাতটি ক্লিন শিট রাখতে পেরেছেন। মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে দুটি পেনাল্টি বাঁচান তিনি। নির্ধারিত সময়ে গ্রেগ স্টুয়ার্টের শট ও টাই ব্রেকারে মেহতাব সিংয়ের শট আটকান তিনি। এটিকে মোহনবাগানের অ্যাটাকারদের গোলমুখী শট আটকানোই হবে এই ম্যাচে তাঁর বড় পরীক্ষা।

দিমিত্রিয়স পেট্রাটস বনাম সন্দেশ ঝিঙ্গন

বেঙ্গালুরুর গোল এরিয়ায় এই লড়াইটার দিকে শনিবার নজর থাকবে সবার। লিগের প্রায় সব দলকেই এ বার বেঙ্গালুরু এফসি-র দুর্ভেদ্য রক্ষণে চিড় ধরিয়ে গোল করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ একবার তাদের ডিফেন্সের ফাঁক খুঁজে পাওয়ার পর এই রক্ষণকেই বেশ ভঙ্গুর লেগেছে। এটিকে মোহনবাগান যখন বেঙ্গালুরুতে খেলতে গিয়েছিল, তখন এটাই ঘটে। পেট্রাটস যখন প্রায়ই নিজের জায়গা বদলে আক্রমণে ওঠেন, তখন বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের তাদের জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেন। ফাইনালেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। প্রতিপক্ষের গোলের সামনে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড, তার প্রমাণ তিনি একাধিকবার দিয়েছেন। এমনকী বক্সের বাইরে থেকেও তাঁর রকেট গতির দূরপাল্লার শট বিপক্ষকে কী ভাবে বিপদে ফেলেছে, তাও দেখা গিয়েছে।

শনিবার ফাইনালে এই পেট্রাটসকে আটকানোই হবে সন্দেশ ঝিঙ্গনের অন্যতম প্রধান কাজ। প্রাক্তন সবুজ-মেরুন তারকা সারা মরশুমেই বেঙ্গালুরুর রক্ষণকে আগলে রেখেছেন। তাঁর খতিয়ানে এ পর্যন্ত ১৫৫টি ক্লিয়ারেন্স রয়েছে। তাঁদের তিন প্রহরীর ব্যাকলাইনে বাকি দু’জনকেও যদি টেনে বের করে আনতে সমর্থ হন পেট্রাটস, তা হলেও সন্দেশকে নিজের জায়গা থেকে টলানো মোটেই তাঁর পক্ষে সোজা হবে না। সন্দেশের পক্ষেও অবশ্য বাকি দুই ডিফেন্ডারের জায়গা কভার করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এবারের লিগে এটিকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে দু’টি গোল খেয়েছে বেঙ্গালুরু এফসি। দু’বারেই হয় সন্দেশের সতীর্থরা নিজেদের জায়গা থেকে ছিটকে গিয়েছেন, না হলে পেট্রাটসের দূরপাল্লার শটের নাগাল পাননি। ফাইনালেও তাই সন্দেশকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারেন দিমি।

হাভিয়ে হার্নান্ডেজ বনাম কার্ল ম্যাকহিউ     

এক সময় তাঁরা দু’জনেই ছিলেন এটিকে মোহনবাগানের সদস্য। ২০১৯-২০ মরশুমে চ্যাম্পিয়ন এটিকে এফসি দলে ছিলেন দু’জনেই। প্রাক্তন সতীর্থদের মধ্যে এ বার মাঝমাঠের লড়াই দেখা যাবে আজকের ফাইনালে। হাভির কাজ মাঝমাঠ থেকে বেঙ্গালুরুর ফরোয়ার্ডদের জন্য গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। মাঝে মাঝে নিজেই অ্যাটাকিং থার্ডে গিয়ে গোলের চেষ্টা করেন তিনি। চলতি লিগে নিজে যেমন সাতটি গোল করেছেন তিনি। পাঁচটি গোলে অ্যাসিস্টও করেছেন। ম্যাকহিউয়ের কাজ হবে বেঙ্গালুরুর আক্রমণকে মাঝমাঠেই নষ্ট করে দেওয়া।

স্প্যানিশ তারকার খেলার স্টাইল-ই তাঁকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের নিজের দিকে টেনে এনে সতীর্থ অ্যাটাকারদের আক্রমণের জায়গা তৈরি করে দেন তিনি। ফাইনালে তাঁর সতীর্থ দুই স্ট্রাইকার শিবশক্তি ও রয় কৃষ্ণার সঙ্গে হাভির যোগাযোগের রাস্তাটা বন্ধ করে দেওয়াই হবে কার্লের প্রধান কাজ। বেঙ্গালুরুর ৩১টি গোলে অবদান রয়েছে এই তিনজনের। এর মধ্যে ১২টি গোলেই হাভির অবদান রয়েছে। মাঝমাঠে তাঁর দলের গতি নিয়ন্ত্রণ করেন আইরিশ মিডফিল্ডার। এ পর্যন্ত ২০টি ইন্টারসেপশন করেছেন তিনি। ফাইনালে আরও করবেন। দলের প্রয়োজনের সময় গোলও করেছেন একাধিক। তিনটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে জোড়া গোল করে দলকে জেতানও তিনি। ফাইনালে একজনের ব্যর্থতাই হবে অপরজনের সাফল্যের কারণ। কিন্তু কে কাকে ব্যর্থ করে সফল হবেন, সেটাই দেখার।

স্লাভকো দামিয়ানোভিচ বনাম রয় কৃষ্ণা

হিরো আইএসএলের তৃতীয় ফাইনাল খেলতে নামছেন যিনি, সেই রয় কৃষ্ণা যদি সেরা ফর্মে থাকেন, তা হলে তাঁকে আটকানো বেশ কঠিন হবে। ফাইনালে এই কাজটা সম্ভবত দেওয়া হবে স্লাভকো দামিয়ানোভিচকে। মরশুমের মাঝামাঝি দলে যোগ দেওয়ার পর নিজেকে দলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু সময় নিলেও সার্বিয়ান ডিফেন্ডার নিজের দক্ষতার প্রমাণ দেন হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে দু’টি সেমিফাইনালে। দুই ম্যাচেই ক্লিন শিট রাখে সবুজ-মেরুন বাহিনী এবং তাঁর কৃতিত্ব অনেকটাই দাবি করতে পারেন স্লাভকো। প্রথম লেগে ম্যাচের নায়কের পুরস্কারও জিতে নেন তিনি। ফাইনালেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গেলে তাঁকে শিবশক্তি ও রয় কৃষ্ণাদের আটকে রাখতেই হবে। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় তাঁর উপস্থিত থাকা ও তাঁর সময়োপযোগী ট্যাকলই তাঁকে যে ভাবে দলে কার্যকরী করে তুলেছে, সে ভাবেই নিশ্চয়ই তিনি ফাইনালেও সফল হওয়ার চেষ্টা করবেন।

বড় ম্যাচে বরাবরই জ্বলে উঠেছেন ফিজিয়ান তারকা রয় কৃষ্ণা, যিনি এক সময় সবুজ-মেরুন সমর্থকদের কাছে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। সেই রয় আজ তাঁর প্রাক্তন ক্লাবকে হারিয়ে অবশ্যই প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন যে, ফেরান্দো-বাহিনী তাঁকে বিদায় দিলেও তিনি এখনও একই রকম ধারালো আছেন। হিরো আইএসএল প্লে অফে তিনটি গোল করেছেন তিনি। পাঁচটি গোলে অ্যাসিস্টও করেছেন। নক আউট পর্বে এতগুলি গোলে অবদান রাখতে পারেননি আর কোনও ফুটবলারই। এ বারের লিগে শুরুর দিকে তেমন ফর্মে না থাকলেও ক্রমশ নিজেকে ছন্দে ফিরিয়ে আনেন রয় এবং গোলেও ফিরে আসেন। দুই দলের রক্ষণের যা শক্তি, তাতে আজ ফতোরদায় ফাইনাল অতিরিক্ত সময়ে গড়াতে পারে। তখনই দেখা যাবে রয় কৃষ্ণার দম কতটা। আর তখনই তাঁকে আটকে রেখে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করার সুযোগ পাবেন স্লাভকো।