এই মরশুম শুরুর আগে কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন ছিল তাঁর ঘরের মাঠ। এখন আর তা নেই। পেশাদার ফুটবলারদের জীবনে যা হয়ে থাকে। এক সময় যা থাকে তাদের ঘর, পরে সেই ঘরেই তারা হয়ে যান অতিথি। তেমন ভাবেই গত শনিবার প্রীতম কোটাল তাঁর দীর্ঘদিনের ঘরের মাঠে খেলতে নেমেছিলেন অতিথি দলের অধিনায়ক হিসেবে। কেরালা ব্লাস্টার্সের রক্ষণ বিভাগকে তিনি নেতৃত্ব দেন ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণকে প্রতিহত করতে। এবং সফলও হন। একাধিক ইন্টারসেপশন, ট্যাকল, আচরণ এবং দলের সতীর্থদের সমানে নির্দেশ দিয়ে নিজের উপস্থিতিকে উজ্জ্বল করে তোলেন।

সে দিন কেরালা ব্লাস্টার্সের কাছে ১-২-এ হারে ইস্টবেঙ্গল। কেরালার দল ৩২ মিনিটের মাথায় এগিয়ে যায় দাইসুকে সাকাইয়ের সুযোগসন্ধানী গোলে। ৮৮ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস। এই গোলের আগেই পেনাল্টি থেকে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন যিনি, সেই ক্লেটন সিলভাই স্টপেজ টাইমের একেবারে শেষ দিকে ফের পেনাল্টির সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি গোল শোধ করেন। কিন্তু হার বাঁচাতে পারেননি।

এই ম্যাচে যুবভারতীর মাঠে নামা প্রীতমের কাছে ছিল বিশেষ ব্যাপার। সেই ম্যাচে জয় ছিনিয়ে নিয়ে বর্তমান ঘরে ফিরতে পেরেছেন তিনি। ইস্টবেঙ্গলকে ২-১-এ হারানোর পরে প্রীতম indiansuperleague.com কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাইরের মাঠে গিয়ে জিতলে দারুন লাগে। বিশেষ করে নিজের ঘরের মাঠে। কলকাতায় ফিরে ইস্টবেঙ্গলের মতো দলকে হারিয়ে তিন পয়েন্ট অর্জন করাটা আমার কাছে দারুন ব্যাপার। আমরা খুশি। এখন আমাদর সামনে লম্বা ছুটি। এই ছুটিতে পরের ম্যাচের প্রস্তুতি নেব আমরা”।

গত মরশুমে এই আইএসএলেই যাদের ঘরের মাঠে ৫-১ গোলে হারিয়ে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন, সেই কেরালা ব্লাস্টার্সই এই মরশুমে তাঁর ক্লাব এবং কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামই তাঁর ঘরের মাঠ। পেশাদার ফুটবল এ রকমই। কবে যে কাকে কোথায় নিয়ে যায়, কেউ জানে না। যত না দেয়, কেড়েও নেয় অনেক কিছু। কিন্তু পেশাদার মানসিকতা দিয়ে সে সব মানিয়ে নিতে হয়।

মোহনবাগান তথা বাংলার ফুটবলের সঙ্গে তাঁর এত বছরের আত্মীয়তা কাটিয়ে ভিনরাজ্যে যাওয়া। অনেকটা বাপের বাড়ি ছেড়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার মতো। আবেগ ধরে রাখা কঠিন। বুকের ভিতরের কষ্ট বাধ মানতে চায় না। মাঝে মাঝে হয়তো ভিজে আসে চোখের কোণ। সবার সামনে সংযত থাকতে হয়। এটাই পেশাদার ফুটবলারের জীবন।

মানিয়ে তো নিয়েছেনই। বরং দলের জুনিয়র খেলোয়াড়দের কাছে তিনি এখন কার্যত অবিভাবকও হয়ে উঠেছেন। তাঁর কথাবার্তা শুনে অন্তত সে রকমই মনে হল। যখন বললেন, “আমার এই ভূমিকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নিজেদের মধ্যে প্রচুর কথা বলি। শুধু ম্যাচে নয়, অনুশীলনেও”।

গত ম্যাচে ব্লাস্টার্সের ডিফেন্সে কোনও বিদেশি ছিলেন না। সাসপেন্ড থাকা মিলোস দ্রিনচিচের জায়গায় প্রীতমের সঙ্গে সেন্টার ব্যাক হিসেবে ছিলেন হরমিপাম রুইভা। গোলকিপার শচীন সুরেশও সে দিন অসাধারণ খেলে ম্যাচের সেরার খেতাব জিতে নেন। রুইভা, সুরেশদের মতো জুনিয়রদের আত্মবিশ্বাস জোগানোর কাজটুকু যে তিনি করে থাকেন, তা নিজেই জানান প্রীতম।

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হরমিপাম দুর্দান্ত ফুটবলার। ওকে আত্মবিশ্বাস জোগানো প্রয়োজন। শচীন এই প্রথম আইএসএল খেলছে। ওরও আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন। অধিনায়ক হিসেবে আমার কাজ ওদের আত্মবিশ্বাস জুগয়ে যাওয়া। ওরা খুবই প্রতিভাবান খেলোয়াড়। সে জন্যই তো ওরা এখানে খেলছে”।

চলতি আইএসএলে এ পর্যন্ত ১৬টি সেভ করেছেন শচীন সুরেশ। তাঁর গোল বাঁচানোর শতকরা হার ৭২.৭৩ শতাংশ। মোট তিনটি পেনাল্টির মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সেভ করেছেন দু’টি। ক্লিয়ারেন্সের সংখ্যা আট। শনিবারের ম্যাচের শেষ দিকে যখন তাঁরই ভুলে ইস্টবেঙ্গল পেনাল্টি পায়, তখন প্রথম সুযোগে পেনাল্টি শট নেওয়ার সময় শচীন লাইন থেকে এগিয়ে এসে সেই শট বাঁচান বলে রেফারি ক্লেটন সিলভাকে আবার পেনাল্টি মারার সুযোগ দেন। কিন্তু এবার ক্লেটনের শট শচীন লাইনে থেকেই দুর্দান্ত ভাবে আটকে দেন।

তার আগের সপ্তাহে দিয়েগো মরিসিওর পেনাল্টি শটও বাঁচিয়েছিলেন সুরেশ। সেই ম্যাচেও ওডিশাকে ২-১-এ হারিয়ে দলকে জয়ে ফিরতে দারুন ভাবে সাহায্য করেন তিনি। এখন ব্লাস্টার্স ছ’টি ম্যাচে চারটি জয় ও একটি ড্র করে লিগ টেবলে দু’নম্বরে রয়েছে।

দলের তরুণ গোলকিপারের প্রশংসা করে প্রীতম বলেন, “শচীন সুযোগ পেলে চারটের মধ্যে চারটে পেনাল্টিই বাঁচাতে পারে। ওর ওপর আমার পুরোপুরি আস্থা রয়েছে। ও ভাল খেলছে। তবে আরও ভাল খেলতে হবে ওকে। আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেলে ও আরও উন্নতি করবে বলে আমার বিশ্বাস”।