ইন্ডিয়ান সুপার লিগ ২০২৩-২৪-এর লিগ পর্ব শেষ। যেখানে এক নম্বরে থেকে এই প্রথমবার লিগ শিল্ড জিতে নিয়েছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এ বার শুরু হতে চলেছে প্লে অফ পর্ব। যেখানে খেলবে লিগ তালিকার সেরা ছ’টি দল।

ইতিমধ্যে সবাই জেনে গিয়েছে, কারা সেই ছয় দল। তবে আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে এ বারের লিগ পর্যায়ে ২২ ম্যাচে ৪৮ পয়েন্ট অর্জন করে আইএসএলে নজির গড়ে এক নম্বরে ছিল গতবারের নক আউট কাপ চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান এসজি। যারা ১৫টি ম্যাচ জিতেছে ও তিনটি ড্র করেছে এবং ৪৭টি গোল দিয়ে ২৬টি গোল খেয়েছে। তাদের চেয়ে এক পয়েন্ট কম (৪৭) পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে গতবারের শিল্ডজয়ী মুম্বই সিটি এফসি। ৪২ গোল দিয়ে ১৯ গোল খেয়েছে তারা। পরের চারটি স্থানে রয়েছে যথাক্রমে এফসি গোয়া (৪৫), ওডিশা এফসি (৩৯), কেরালা ব্লাস্টার্স (৩৩) ও চেন্নাইন এফসি (২৭)

আইএসএলের প্লে অফ ফরম্যাট অনুযায়ী প্রথম দু’টি দল সরাসরি দু’টি সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। পরের চারটি দলকে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার জন্য দু’টি নক আউট ম্যাচ খেলতে হয়। একটি ম্যাচে মুখোমুখি হয় তৃতীয় ও ষষ্ঠ স্থানাধিকারী দল ও অপর নক আউট ম্যাচে খেলে লিগ তালিকায় থাকা চার ও পঞ্চম দল। অর্থাৎ, দুই নক আউট ম্যাচে ওডিশা এফসি-র মুখোমুখি হবে কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি, যেটি হবে ভুবনেশ্বরে এবং এফসি গোয়ার মুখোমুখি হবে চেন্নাইন এফসি, যেটি হবে ফতোরদায়।

১৯ এপ্রিল ভুবনেশ্বরের ম্যাচের জয়ী দল আগামী ২৩ ও ২৮ এপ্রিল খেলবে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে প্রথম সেমিফাইনালের দুই লেগে এবং ফতোরদার ম্যাচের জয়ী দল সেমিফাইনালে খেলবে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ২৪ ও ২৯ এপ্রিল। দু’টি সেমিফাইনালই হবে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে। প্রথম লেগে মোহনবাগান ও মুম্বই প্রতিপক্ষের মাঠে নামবে। দ্বিতীয় লেগে তারা খেলবে ঘরের মাঠে। দুই সেমিফাইনালে দুই লেগে হওয়া মোট গোলের বিচারে বিজয়ী নির্ধারিত হবে, যারা মুখোমুখি হবে ৪ মে-র ফাইনালে।

নক আউট-১, ওডিশা এফসি বনাম কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি, ১৯ এপ্রিল, ভুবনেশ্বর

নক আউটের প্রথম ম্যাচে শুক্রবার ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে ওডিশা এফসি ও কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি। লিগ তালিকায় পয়েন্টের দিক থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের দিক থেকে কিন্তু একেবারে সমান জায়গায় রয়েছে দুই পক্ষই। শেষ পাঁচ ম্যাচে দুই দলই একটি করে ম্যাচে জিতেছে ও ড্র করেছে এবং বাকি তিনটি ম্যাচেই হেরেছে। লিগের শেষ ম্যাচে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের কাছে ০-৩-এ হারে ওডিশা। তার আগে মুম্বই সিটি এফসি-র কাছেও ১-২-এ হারে তারা। তার আগের দুই ম্যাচে পাঞ্জাব এফসি-কে ৩-১-এ হারালেও বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করে ওডিশা। কিন্তু চেন্নাইন এফসি-র কাছে হেরে যায় ১-২-এ।

অন্য দিকে, কেরালা ব্লাস্টার্সও গত পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচ জিতেছে। লিগের শেষ ম্যাচে তারা হারায় লিগ টেবলের একেবারে নীচে থাকা হায়দরাবাদ এফসি-কে। তার আগের চারটি ম্যাচের কোনওটিতেই জিততে পারেনি তারা। শুধু জামশেদপুরের বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে। কিন্তু মোহনবাগান এসজি (৩-৪), ইস্টবেঙ্গল এফসি (২-৪) ও নর্থইস্ট ইউনাইটেডের (০-২) কাছে হেরে যায়। তাদের গত দশটি ম্যাচের দিকে তাকালে জয়ের সংখ্যা মাত্র দুই। সেখানে ওডিশা আইএসএলের শেষ দশটি ম্যাচের মধ্যে জিতেছে চারটিতে।

চলতি লিগে দুই দলের দুই মুখোমুখিতে প্রথমবার কেরালার দল জেতে ২-১-এ এবং পরেরবার ওডিশা জেতে একই ফলাফলে। সব মিলিয়ে অবশ্য দুই দলের দশবার দেখা হয়েছে। তার মধ্যে ব্লাস্টার্স জিতেছে চারবার ও ওডিশা জিতেছে তিনবার। ড্র হয়েছে তিনবার। ওডিশার দুই স্ট্রাইকার রয় কৃষ্ণা ও দিয়েগো মরিসিও এ বার দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন। রয় ২২ ম্যাচে ১২ গোল করেছেন ও মরিসিওর গোলসংখ্যা ২০টি ম্যাচে ১০। তবে অ্যাসিস্টে কেউই তেমন সফল নন। দুজনেই একটি করে অ্যাসিস্ট করেছেন। তাদের দলে সবচেয়ে বেশি গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন ডিফেন্ডার অময় রানাওয়াডে (৬)। তবে ওডিশার রক্ষণ তাদের প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি সাফল্য দেখিয়েছে। ওডিশা যেখানে ২২ ম্যাচে ২৩ গোল খেয়েছে, সেখানে ব্লাস্টার্স ৩১ গোল খেয়েছে। চলতি লিগে সবচেয়ে কম গোল খাওয়া দলের তালিকায় দুই নম্বরে রয়েছে ওডিশা, মুম্বইয়ের পরেই।

নক আউট-২, এফসি গোয়া বনাম চেন্নাইন এফসি, ২০ এপ্রিল, ফতোরদা

সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের বিচারে দ্বিতীয় নক আউট ম্যাচের দুই দলই বেশ ভাল জায়গায় রয়েছে বলা যায়। তাই আগামী শনিবার তারা যখন গোয়ার মাঠে খেলতে নামবে, তখন লড়াইটা বেশ জমে উঠতে পারে। যদিও গোয়া সামান্য এগিয়ে। কারণ, গত পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে শেষ চারটিতেই জিতেছে তারা, একটিতে ড্র করেছে। চেন্নাইন এফসি শেষ ম্যাচে হারে। কিন্তু তার আগের তিনটিতেই জেতে। টানা তিন জয়ের আগেও হারের মুখ দেখতে হয় তাদের। সত্যি বলতে, এফসি গোয়া গত সাতটি ম্যাচেই অপরাজিত রয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্লাস্টার্সের কাছে ২-৪ হারের পর আর তারা হারেনি। কিন্তু হায়দরাবাদ এফসি এ বার লিগে যে একটিমাত্র জয় পায়, তা চেন্নাইনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা ক্রমশ ফর্মে ফিরে আসে এবং নক আউটে যথেষ্ট লড়াই করবে, এমনই ধরে নেওয়া যায়।

চলতি লিগে প্রথম মুখোমুখিতে এফসি গোয়া ৩-০-য় হারায় চেন্নাইনকে। পরের বারও তারা ৪-১-এ জেতে। গোয়ার দলের এই দাপটের বিরুদ্ধে কতটা লড়াই করবে চেন্নাইন, সেটাই আকর্ষণীয় বিষয়। আইএসএলে দুই দলের মধ্যে ২৫ বার দেখা হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র দুবার ড্র হয়েছে। ১৪বার জিতেছে এফসি গোয়া ও ৯বার জিতেছে চেন্নাইন এফসি।

গোয়ার দলের দুই অ্যাটাকার নোয়া সাদাউই ও কার্লোস মার্তেনেজ দশটি করে গোল করেছেন। অ্যাসিস্টেও সবার আগে (৫) নোয়া। মার্তিনেজ দুটি অ্যাসিস্ট দিয়েছেন। ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ চারটি গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন। গোলের জন্য মূলত এদের দিকেই তাকিয়ে থাকেন কোচ মানোলো মার্কেজ। অন্য দিকে, চেন্নাইনের জর্ডন মারে (৫ গোল), রাফায়েল ক্রিভেলারো (৪) বেশি গোল করতে পারেননি এই মরশুমে। বরং তাদের দলের ভারতীয় ফুটবলাররাও এ বারে গোলের সামনে বেশ তৎপর। বাংলার ফুটবলার রহিম আলি তিনটি গোল করেছেন ও দুটি করিয়েছেন। চেন্নাইনের এ বার মোট গোলের সংখ্যাও কম। ২২ ম্যাচে ২৬টি গোল করেছে তারা। সেরা ছয় দলের মধ্যে সবচেয়ে কম গোল তাদেরই। এমনকী শেষ ছয়ে থাকা চারটি দল তাদের চেয়ে বেশি গোল করেছে। আরও ভাল করে বলতে গেলে, সবচেয়ে কম গোল দেওয়া দলের তালিকায় তারা রয়েছে তিন নম্বরে।

সেমিফাইনালের দুই দল

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট

শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই জিতেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এই পাঁচটি ম্যাচে তারা ১৩টি গোল করেছে এবং সাতটি গোল খেয়েছে। শেষ দু’টি ম্যাচে ছ’গোল দিয়ে এক গোল খেয়েছে তারা। লিগের শেষ ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে অসাধারণ ও সাহসী ফুটবল খেলেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, জনি কাউকো, লিস্টন কোলাসো, মনবীর সিং, জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকুরা। রক্ষণে হেক্টর ইউস্তে, শুভাশিস বোস, আনোয়ার আলিরা ছিলেন অসাধারণ। মরশুমের শুরু থেকেই এ বার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে কলকাতার দল। শুরুতে তারা টানা পাঁচটি ম্যাচে জেতে। কিন্তু তার পরের পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জেতে এবং টানা তিনটি ম্যাচে হারে। এর পরেই দলের কোচ বদল হয়। হুয়ান ফেরান্দোর জায়গায় আসেন আন্তোনিও হাবাস এবং তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা আটটি ম্যাচে অপরাজিত মোহনবাগান, যার মধ্যে ছিল ছ’টি জয় ও দু’টি ড্র। ঘরের মাঠে চেন্নাইন এফসি-র কাছে তাদের হার ছিল তাদের কাছে বড় ধাক্কা। এই ধাক্কাই তাদের উজ্জীবিত করে তোলে এবং এরপর টানা তিনটি ম্যাচ জিতে লিগশিল্ড অর্জন করে কলকাতার দল।

মুম্বই সিটি এফসি

গতবারের লিগশিল্ডজয়ীদের এ বারেও প্লে অফে জায়গা পাকা করে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। শেষ ম্যাচেও ড্র করলেই তারা লিগসেরার খেতাব ধরে রাখতে পারত। কিন্তু তা পারেনি তারা। শেষ ম্যাচে হারার আগে টানা ন’টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল তারা, যার মধ্যে আটটিতেই ছিল জয়। সারা লিগে তারা মাত্র তিনটি ম্যাচে হেরেছে। মোহনবাগান ছাড়াও তারা হারে জামশেদপুর এফসি ও কেরালা ব্লাস্টার্সের কাছে। পাঁচটি ম্যাচে ড্র করে তারা। শুরুতে টানা ন’টি ম্যাচে অপরাজিত থাকার পরে দশ নম্বর ম্যাচে তাদের গতিরোধ করে ব্লাস্টার্স। এর পরে ১১টি ম্যাচের মধ্যে ন’টিতেই জেতে মুম্বই সিটি, একটিতে হারে ও একটি ড্র করে (গোয়া)। এমন সাফল্যের হার যাদের, প্লে-অফেও তাদের আটকানো নিশ্চয়ই কঠিন হবে।