আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তার পরেই কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে শুরু হয়ে যাবে ভারতের সেরা ফুটবলের আসর ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল)। ২০২৩-২৪ মরশুমের আইএসএল পদার্পন করছে দশম বর্ষে, যা হতে চলেছে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। সারা ভারতের ফুটবলপ্রেমীরা যখন এ দেশে ফুটবলের এক নবজাগরণ দেখতে শুরু করেছে, সেই সময়ে আইএসএলের দশম মরশুমে পা রাখা অবশ্যই এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ, এ বারই ভারতের এক নম্বর লিগ এসে পড়েছে এক নব রূপে, নব কলেবরে।

এ বারই প্রথম দেশের ১২টি সেরা ক্লাব দলকে নিয়ে হচ্ছে আইএসএল। ২০১৪-য় যে লিগের সূচনা হয়েছিল আটটি দলকে নিয়ে, সেই লিগে এখন অংশ নিচ্ছে ১২টি দল। ২০১৬ পর্যন্ত আটটি দলকে নিয়েই চলেছিল আইএসএল। ২০১৭-১৮ মরশুম থেকে দলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০। ২০২০-২১-এ যোগ দেয় কলকাতার দুই প্রধান এবং ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম দুই সেরা ক্লাব। এটিকে এফসি সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এটিকে মোহনবাগান প্রথম অংশ নেয় সে বারই এবং এসসি ইস্টবেঙ্গল তাদের প্রথম আইএসএল খেলে সেবারই।

কঠিন চ্যালেঞ্জ জেতার সাফল্য

সেই থেকে গত মরশুম পর্যন্ত ১১টি দল নিয়েই হয় আইএসএল। এ বারই প্রথম আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে দেশের এক নম্বর লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছে পাঞ্জাব এফসি। এর মাঝখানে দু’টি মরশুম ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ যে ভাবে কোভিডের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জৈব সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে থেকে আইএসএল আয়োজন করা হয়েছে, তার প্রশংসা এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সারা দেশে তথা সারা বিশ্বে কোভিডের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চললেও ভারতীয় ফুটবল কিন্তু থেমে থাকেনি। দুই মরশুমেই দেশের অন্যতম সেরা ফুটবলকেন্দ্র গোয়ায় পরিপূর্ণ রূপে হয়েছে আইএসএলের সব ম্যাচ।

জৈব সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে থেকে কঠিন নিয়ম মেনে গোটা একটা লিগ আয়োজন করতে যে পরিমাণ অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করা হয় এবং যে ভাবে পেশাদারি দক্ষতায় লিগ চালানো হয়েছিল, তা ভারতীয় ক্রীড়া ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের বিভিন্ন খেলার প্রধান আসরগুলিকে সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হলেও ইন্ডিয়ান সুপার লিগকে কিন্তু আটকে রাখা যায়নি। চূড়ান্ত পেশাদারি মানসিকতা ও দক্ষতায় করা হয়েছে এই লিগ।

এত বাধা, বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে দশম বর্ষে পদার্পন করল দেশের এক নম্বর লিগ, যে লিগে সফল দলকেই এশীয় মঞ্চে অংশ নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। আইএসএলের লিগ তালিকায় যে দল এক নম্বরে থেকে মরশুম শেষ করে লিগশিল্ড জেতে, তারা এশিয়ার সেরা ক্লাব লিগ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। অন্যদিকে, যারা নক আউট পর্বে সফল হয়ে কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়, তাদের সামনে এশিয়ার দ্বিতীয় সারির ক্লাব লিগ এএফসি কাপে খেলার রাস্তা পরিস্কার হয়ে যায়। এই জন্যই ইন্ডিয়ান সুপার লিগ ভারতীয় ফুটবলে এতটা গুরুত্বপূর্ণ।

নব প্রজন্মের সেরা মঞ্চ

আন্তর্জাতিক মঞ্চের সঙ্গে ভারতীয় ফুটবলের সেতুনির্মানের কাজটা যেমন করে আইএসএল, তেমনই দেশের তরুণ, প্রতিভাবান ফুটবলারদের বিশাল এক মঞ্চে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগও দেয় এই লিগ। সারা ভারতে যে ফুটবল প্রতিভার মোটেই অভাব নেই, তা প্রমাণ করে দিয়েছে এই লিগ। গত ন’বছরে এই লিগের মাধ্যমে কত তরুণ ফুটবলার পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছে, তা গুনে শেষ করা মোটেই সোজা নয়। এই মুহূর্তে দেশের সিনিয়র দল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে যাঁরা নিয়মিত খেলে থাকেন, তাঁদের বেশিরভাগই আইএসএলে খেলে নিজেদের উন্নত করে তুলেছেন এবং জাতীয় দলের হয়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন আইএসএলে ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়েই।

ভারতে ফুটবলের এমন মঞ্চ, যেখানে খেলার মান থেকে শুরু করে প্রস্তুতির জন্য আন্তর্জাতিক মানের পরিকাঠামো, ফুটবলারদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা, বিপুল আর্থিক পুরষ্কার সব কিছুতেই অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে, এ রকম মঞ্চ কখনও পায়নি ভারতীয় ফুটবলাররা। ভারতীয় ফুটবলাররা যাতে আরও বেশি করে এই লিগে অংশ নিতে পারেন, সে জন্য বিদেশির সংখ্যাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে গত মরশুম থেকে।

ইউরোপ, আমেরিকায় খেলে আসা বিদেশি ফুটবলারদের সঙ্গে মাঠে নামা ও বিভিন্ন নামী ক্লাবে ও দেশে কাজ করে আসা কোচেদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেওয়ার যে সুযোগ এই লিগে পেয়েছেন ভারতীয় ফুটবলাররা, তা দশ বছর আগে কেউ ভাবতেও পারত না। তাই অতীতের বহু ভারতীয় তারকা ফুটবলারকে আফসোস করতে শোনা যায়, কেন তাদের সময় আইএসএলের প্রচলন হল না।

সারা বিশ্বের দরবারে, সঙ্গে বিনোদন

শুধু মাঠের খেলা বা প্রস্তুতির বিশ্বায়ন নয়, এই লিগকে কী ভাবে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, কী ভাবে তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া যায়, তারও একাধিক অভিনব উপায় উদ্ভাবন করেছেন আইএসএলের প্রধান আয়োজক সংস্থা ফুটবল স্পোর্টস ডেভলপমেন্ট লিমিটেড (এফএসডিএল)। গত ন’বছর ধরে আইএসএলের টিভি সম্প্রচার হত ভারতের অন্যতম সেরা স্পোর্টস চ্যানেল স্টার স্পোর্টস-এ। তাদেরই জনপ্রিয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ডিজনি-হটস্টার-এ সারা দেশের কয়েক লক্ষ মানুষের মোবাইলে, কম্পিউটরে পৌঁছে দেওয়া হত সব ম্যাচের টাটকা অ্যাকশন।

এ বার দশম মরশুমে সেই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে এ দেশের আর এক জনপ্রিয় ক্রীড়া সম্প্রচার সংস্থা ভায়াকম ১৮। এ বারের আইএসএলে বিস্তৃত টিভি সম্প্রচার হতে চলেছে আটটি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। এ ছাড়া জিও সিনেমা অ্যাপে সব ম্যাচের লাইভ স্ট্রিমিং দেখা যাবে একেবারে নিখরচায়। সারা দেশের ফুটবলপ্রেমীরা ইংলিশ, হিন্দি, বাংলা ও মালয়ালাম ভাষায় ম্যাচগুলির ধারাভাষ্য শুনতে পাবেন। স্পোর্টস ১৮ খেল, স্পোর্টস ১৮ ১ এসডি ও এইচডি, ভিএইচ ১ এসডি ও এইচডি, সূর্য মুভিজ ও কালার্স বাংলা সিনেমা-য়। ডিডি বাংলাতেও সরাসরি সম্প্রচার করা হবে আইএসএলের ম্যাচগুলি। সঙ্গে থাকবে বাংলা ধারাবিবরণীও। এ ছাড়াও এফএসডিএলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় ওয়ানফুটবল (OneFootball) আইএসএলের সব ম্যাচের লাইভ স্ট্রিমিং ও হাইলাইটস দেখাবে বিশ্বের ১৯০টি দেশে। এই বিপ্লব আইএসএল ছাড়া ভাবাই যায় না।

এ ছাড়াও আইএসএলের দশম মরশুম উদযাপন উপলক্ষ্যে এ বার থেকেই শুরু করা হয়েছে ‘আইএসএল ফ্যান্টাসি’ গেম, যাতে অংশ নিতে পারবেন সবাই। পুরো লিগে বা ক্লাব ভিত্তিক লিগে অংশ নিয়ে আকর্ষণীয় পুরষ্কার জেতার সুযোগ থাকছে এই গেমে। অংশগ্রহনকারীরা এখানে যে যাঁর বন্ধুদের নিয়ে ব্যক্তিগত লিগ তৈরি করতে পারবেন বা অন্যের তৈরি লিগে অংশ নিতে পারবেন। ১০০ জন সেরা খেলোয়াড়কে দেওয়া হবে আকর্যণীয় পুরষ্কার। যার মধ্যে থাকছে একটি Sony PlayStation®5 gaming console, EA Sports FC 24, আপনার প্রিয় ক্লাবের সই করা স্মারক এবং ২০ হাজার টাকার গিফট কার্ড।

তীব্র প্রতিদ্বন্দিতা, অনিশ্চয়তা

গতবার থেকেই নিয়ম করা হয়েছে, লিগ তালিকায় থাকা সেরা ছ’টি দল প্লে অফে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। তার আগে পর্যন্ত সেরা চারটি দলকে নক আউটে খেলার অধিকার দেওয়া হত। কিন্তু লিগে প্রতিযোগিতার তীব্রতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সেরা ছ’টি দলকে নক আউটে খেলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ভাবে সফল হয়েছে।

লিগে প্রতিযোগিতার তীব্রতা তো বেড়েছেই, সেই সঙ্গে বেশিরভাগ দলগুলির মধ্যে এখন আর বেশি ফারাক নেই। সব দলের কোচেরাই স্বীকার করেন, এই লিগে যে কোনও দল, যে কোনও সময়ে যে কোনও প্রতিদ্বন্দীদের হারানোর ক্ষমতা রাখে। তাই এই লিগে প্রতিদ্বন্দিতার মান গত কয়েক মরশুমে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। লিগের শেষ রাউন্ড না হলে বোঝার উপায় থাকে না, লিগ তালিকায় কোন দল কত নম্বরে থেকে অভিযান শেষ করল।

দক্ষিণের তিনটি দল চেন্নাইন এফসি, বেঙ্গালুরু এফসি ও হায়দরাবাদ এফসি যেমন এই লিগের অংশ তেমনই পূর্ব ভারতের মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, ইস্টবেঙ্গল এফসি, নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি ও জামশেদপুর এফসি এই লিগে অংশগ্রহনকারী চার দল। পশ্চিম ভারতের মুম্বই সিটি এফসি ও এফসি গোয়া তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য সমানে তৈরিই থাকে। গত কয়েক মরশুমে উত্তর ভারতের কোনও ক্লাব এই লিগে ছিল না। এ বার পাঞ্জাব এফসি অংশ নেওয়ায় ভারতের সব প্রান্তের দলই এখন আইএসএলের অঙ্গ। সারা দেশকে একত্রিত করার যে মহান ব্রত পালন করে চলেছে আইএসএল, তা সব দিক থেকেই প্রশংসনীয়।

চেনা শত্রুতা, সেরা দ্বৈরথ

সব শেষে আসা যাক আইএসএলের সেরা প্রতিদ্বন্দিতার কথায়। কলকাতার দুই শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের অংশগ্রহন আইএসএল-কে এক বাড়তি মাত্রা এনে দিয়েছে। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্লাবের দ্বৈরথই এই লিগের সেরা আকর্ষণ, যাকে ঘিরে সারা বাংলায় উন্মাদনা ওঠে চরমে, যাকে নিয়ে হইচই হয় সারা দেশ জুড়ে। এমনকী সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সারা বিশ্বে এই ম্যাচ নিয়ে আগ্রহ ওঠে চরমে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, গত তিন মরশুম ধরে দুই প্রধানের লড়াই হয়েছে একপেশে। ফলও হয়েছে সেরকমই। আইএসএলে এ পর্যন্ত দুই চিরপ্রতিদ্বন্দীর মধ্যে হওয়া ছ’টি কলকাতা ডার্বিতেই জিতেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট।

তবে এ বার যে রকম শক্তিশালী দল গড়েছে দুই পক্ষই, তাতে এ বার কলকাতা ডার্বিতে তুমুল লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সেই লড়াই, যা যুগযুগ ধরে চলে আসছে বাংলার ফুটবলে, সেই লড়াই যার ফলে বাংলার মানুষ সাময়িক ভাবে ভাগ হয়ে যায় দুই দলে, সেই লড়াই, যা নিয়ে উত্তেজনা, উন্মাদনা উঠেছে চরমে এমনকী কেড়ে নিয়েছে বহু প্রাণও। যদিও আইএসএলের মতো সুসংগঠিত লিগে সে সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এই লিগে কলকাতা ডার্বি মানে ফুটবলের আনন্দকে ভরপুর উপভোগ করা। সে স্টেডিয়ামে বসেই হোক, বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসেই হোক বা পাড়ার ক্লাবের মাঠে জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে।

কলকাতা ডার্বি যেমন শতবর্ষের ঐতিহ্য নিয়ে বারবার ফিরে আসে ফুটবলপ্রেমীদের সামনে, তেমনই আইএসএল-ও বারবার ফিরে আসুক ভারতীয় ফুটবলকে প্রতি বছর আরও ধনী, আরও গৌরবময় করে তোলার জন্য। আজ রাত আটটায় যখন কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে শুরু হবে আইএসএল ১০-এর প্রথম ম্যাচ, তখন বরং সবাই মিলে একটাই শপথ নিন, এ মরশুমে যারাই সেরা হোক না কেন, আসল জয়ী যেন হয় ভারতীয় ফুটবল।