বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলকাতার ঐতিহাসিক যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন শুধুই সুনীল ছেত্রীর বিদায়ী ম্যাচের মঞ্চ হয়ে উঠল, ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস গড়ার মঞ্চ হয়ে উঠল না। এ দিন বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ভারত বনাম কুয়েত ম্যাচে তাঁর আন্তর্জাতিক ফুটবল জীবন শেষ করলেন ঠিকই। কিন্তু কুয়েতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ডের দোরগোড়ায় পৌঁছনো হল না ভারতের। গোলশূন্য ড্র করে তৃতীয় রাউন্ডের দোরগোড়া থেকে দূরেই রইল ইগর স্টিমাচের দল।

বৃহস্পতিবারের ম্যাচে, যা দেখতে যুবভারতীর গ্যালারিতে জমায়েত হয়েছিল প্রায় ৫৯ হাজার সমর্থকের, তাতে পুরো ৯০ মিনিটে একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি ভারত। সেখানে কুয়েত তিনবার গোলে শট নেয়, যা প্রতিবারই আটকে দিয়ে দলের হার বাঁচান গোলকিপার গুরপ্রীত সিং।

এই ড্রয়ের ফলে এশীয় বাছাই পর্বে গ্রুপ ‘এ’ তে ভারত পাঁচ ম্যাচে পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে দু’নম্বরে রয়ে গেল। পাঁচ ম্যাচে চার পয়েন্ট পেয়ে তিন নম্বরে কুয়েত। চার নম্বরে থাকা আফগানিস্তানেরও সংগ্রহ চার পয়েন্ট। আগামী সপ্তাহে একদিকে যখন ভারত ও কাতার মুখোমুখি হবে, তখন কুয়েত ও আফগানিস্তানও একে অপরের বিরুদ্ধে খেলবে। তৃতীয় রাউন্ডে পৌঁছতে হলে সে দিন ভারতের সামনে জয় ছাড়া কোনও উপায় নেই, যা বেশ কঠিন। ভারত জিততে না পারলে অন্য ম্যাচের জয়ী দল পৌঁছে যাবে তৃতীয় রাউন্ডে।

দলের এই ব্যর্থতার ফলেই বোধহয় বিদায়ী ভাষণে বেশি কিছু বলতে পারেননি সুনীল। শুধু সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “সবাইকে ধন্যবাদ। আপনাদের ছাড়া এই দীর্ঘ ফুটবল সফর সম্ভব হত না। সবাই ভাল থাকবেন”। ভারতের হয়ে শেষ ম্যাচে নেমে এ দিন খুব একটা তৎপরও হয়ে উঠতে পারেননি সুনীল ছেত্রী। প্রতিপক্ষের গোলের সামনে গিয়ে তাঁর সতীর্থদের খেই হারিয়ে ফেলার পুরনো রোগও এ দিন ভুগিয়েছে ভারতীয় দলকে। সারা ম্যাচে যেখানে গোলে কোনও বলই রাখতে পারেনি তারা, সেখানে গোল করবে কী করে?

এ দিন গুরপ্রীত ক্লিন শিট বজায় রাখলেও ম্যাচের শুরুতেই তাঁর গোল খাওয়ার উপক্রম হয়, যখন কুয়েতের মহম্মদ আবদুল্লা ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে গোলের সুযোগ পান। গুরপ্রীতের পায়ে লেগে সেই শট অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়।

শুরুতেই এই ধাক্কা খেয়ে নড়েচড়ে বসে ভারতীয় দল এবং পাল্টা আক্রমণ শুরু করে তারা। ১১ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসোর ক্রস সুনীল ছেত্রী পর্যন্ত পৌঁছতেই দেননি হাসান আলেনিজি, তার আগেই বল বিপদসীমার বাইরে পাঠিয়ে দেন তিনি।

কিন্তু এর পরবর্তী মিনিটেই অনিরুদ্ধ থাপার কর্নার থেকে হেডে গোল করার যে সুযোগ তৈরি করেছিলেন আনোয়ার আলি, সেই সুযোগই এ দিনের ম্যাচের সেরা। কিন্তু আনোয়ারের হেড বারের একটু ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

১৪ মিনিটের মাথায় নিখিল পূজারীর ক্রস থেকে বল পেয়ে গোলে শট নেন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, যা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কুয়েতের রক্ষণ এ দিন বেশ সঙ্ঘবদ্ধ ছিল। ভারতীয় অ্যাটাকারদের যেখানে যেখানে রোখা দরকার, সেখানেই রুখেছে তারা। যথেষ্ট শেপে ছিল তারা। যা ভারতের রক্ষণে তেমন দেখা যায়নি। এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করে কুয়েত, যা কাজে লাগাতে পারলে এ দিন জয়ের হাসি মুখে নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারতেন ইউসেফ আলসুলেইমানরা।

আক্রমণে ব্যর্থতা তো ছিলই। এ ছাড়াও বলের দখল হারানোর পর তা পুনর্দখল করার ক্ষেত্রে খুব একটা সফল হতে পারেনি তারা। এই সুযোগও কাজে লাগানোর প্রবল চেষ্টা করে কুয়েত। ২৫ মিনিটে আল রাশিদি লক্ষ্যভ্রষ্ট না হলে অবধারিত গোল পেত কুয়েত। গুরপ্রীত অনেকটা এগিয়ে আসায় গোল প্রায় ফাঁকা ছিল। তা সত্ত্বেও গোলে বল রাখতে পারেনি তারা।

পরমুহূর্তেই বাঁ দিক থেকে ওঠা ভারতের জার্সি গায়ে প্রথম নামা জয় গুপ্তার ক্রস বক্সে সহাল আব্দুল সামাদের কাছে পৌঁছনোর আগেই তা ক্লিয়ার করে দেন হাসান আলেনিজি। দেশের হয়ে প্রথম ম্যাচে এ দিন প্রশংসা পাওয়ার মতোই খেলেন ডিফেন্ডার জয় গুপ্তা। কিন্ত দেশকে জয় এনে দিতে পারেননি তিনি।

৩০ মিনিটের মাথায় ফের সুযোগ তৈরি করে ভারত। থাপার ফ্রিকিক থেকে সহাল গোলে শট নেন, যা ব্লক করা হয়। কিন্তু বল ছিটকে আসে কোলাসোর পায়ে, যিনি বক্সের মাথা থেকে গোলে জোরালো শট নিলেও তা সাইড নেটে লাগে।

ড্রিঙ্কসের পর ভারতের আক্রমণে ধার কিছুটা বাড়ে। ফলে কুয়েতের রক্ষণ আরও চাপে পড়ে যায়। কিন্তু দুর্দান্ত দক্ষতায় অবস্থা সামলে নেয় তারা। ফলে ভারত গোলের মুখ খুলতে পারেনি। ৪৫ মিনিটের মাথায় পাওয়া কর্নার থেকেও কিছু করতে পারেনি ভারতীয় দল। চার মিনিটের বাড়তি সময়েও গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি কোনও দল।

বিরতির পর রহিম আলি ও ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ মাঠে নামেন থাপা ও সহালের জায়গায়। কিন্তু তাতেও যে ভারতীয় দলের খেলায় পরিবর্তন এসেছে, তা নয়।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে, যখন আধ মিনিটের মধ্যে দুই গোলকিপারই দুটি দুর্দান্ত সেভ করেন। ফয়জল আল হারবির কোণাকুনি শট বাঁচান গুরপ্রীত ও পরের মিনিটেই রহিম আলির শট বাঁচান সুলেইমান আব্দুলগফর। এই দুই গোলই খেলার ছবিটা পাল্টে দিতে পারত।

ম্যাচের প্রথম গোল পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে দুই দলই। প্রথমে ৫২ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে আল রশিদির জোরালো গোলে শট বাঁচান গুরপ্রীত। তার আগেই মাঠে নেমে তৎপর হয়ে ওঠা বাংলার ফরোয়ার্ড রহিম আলি ফের গোলের সুযোগ পেয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন। কিন্তু রক্ষণের প্রবল বাধায় তিনি বল গোলে রাখতে পারেননি।

৭০ মিনিটের মাথায় আক্রমণে গতি আনতে মাঠে নামেন মনবীর সিং। কিন্তু ৭৪ মিনিটে ফের গোল খাওয়ার উপক্রম হয় ভারতের। বক্সের মাথায় গোলমুখী মহম্মদ আল সুলেইমানকে বাধা দিয়ে বল ক্লিয়ার করার চেষ্টায় সফল হন আনোয়ার। না হলে বিপদে পড়ত ভারত।

৮৪ মিনিটে জয় গুপ্তাকে বসিয়ে ফরোয়ার্ড এডমন্ডকে নামিয়ে তিন ব্যাকে চলে যায় ভারত। পাঁচ বছর পর আই লিগের কোনও খেলোয়াড় ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামতে দেখা গেল। তিন ব্যাকে গিয়ে চাপ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিলেও ভারত তা কাজে লাগাতে পারেনি।

যদিও সাত মিনিটের স্টপেজ টাইমের প্রথম মিনিট থেকেই শেষ মুহূর্তে গোল পাওয়ার জন্য চাপ বাড়াতে শুরু করেন রহিম, মনবীররা, কিন্তু কুয়েতের খেলোয়াড়দের প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে ওঠে। ফলে আর গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি ভারত। ম্যাচ ড্র করলে যে তারা বাছাইপর্বের তৃতীয় রাউন্ডে ওঠার ক্ষেত্রে সুবিধা পেতে পারে, তা মাথায় রেখেই এ দিন ভারতকে সমানে আটকে রেখেছে তারা। স্টপেজ টাইমের টাইমের ছমিনিটের মাথায় প্রায় ৩৫ গজ দূরে ফ্রি কিক পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি ভারত।

ম্যাচের পর টিভি ইন্টারভিউয়ে এই ড্রয়ের জন্য আফসোস করে ভারতীয় দলের ক্রোয়েশীয় কোচ বলেন, “কুয়েতের বিরুদ্ধে এর আগেও কঠিন ম্যাচ খেলেছি, হাফ চান্স থেকে গোল করেছি। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে আজ আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। গোলের সামনে গিয়ে সুযোগ নষ্ট করার সমস্যা তো রয়েই গিয়েছে। গুরপ্রীত অসাধারণ কিছু সেভ করেছে। তবে সবাই একশো শতাংশ দিতে পারেনি। রহিম আলি ভাল স্ট্রাইকার, কিন্তু গোল করতে পারছে না। মনবীর, লিস্টনরাও ভাল। কিন্তু ওদের গোল করতে হবে। সুনীল ছেত্রী আজ সুনীল ছেত্রী হয়েছে তার গোলের দক্ষতা আর নেতৃত্বের ক্ষমতার জন্য। ওর বিকল্প অত সহজে পাওয়া যাবে না”।

সুনীল ছেত্রীকে এ দিন ম্যাচের পর বিদায় সংবর্ধনা জানায় সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, আইএফএ, কলকাতার তিন প্রধান ক্লাব মোহনবাগান এসজি, ইস্টবেঙ্গল এফসি ও মহমেডান স্পোর্টিং এবং আইএম বিজয়ন-সহ তাঁর প্রাক্তন সতীর্থ ফুটবলারদের অনেকে।

ভারতীয় দল: গুরপ্রীত সিং সান্ধু (গোল), রাহুল ভেকে, আনোয়ার আলি, জয় গুপ্তা (এডমন্ড লালরিন্দিকা- ৮৪), নিখিল পূজারী, অনিরুদ্ধ থাপা (রহিম আলি-৪৫), সুরেশ ওয়াংজাম, লিস্টন কোলাসো (মনবীর সিং- ৭০), লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, সহাল আব্দুল সামাদ (ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ- ৪৬), সুনীল ছেত্রী।