এএফসি এশিয়ান কাপের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ার আগ্রাসন রোখার চ্যালেঞ্জ ভারতের সামনে
মানের বিচারে অস্ট্রেলিয়া যে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে, তা সম্প্রতি ভারতের কোচ ইগর স্টিমাচ ও অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী, দুজনেই স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে যদি অন্তত এক পয়েন্ট ছিনিয়ে নিতে পারে ভারত, তা হলে শুধু তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে না, টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় রাউন্ডের দিকেও কিছুটা পা বাড়িয়ে রাখবে তারা।

অবশেষে কঠিন পরীক্ষার সেই দিন এসে পড়ল। রাত পোহালেই এএফসি এশিয়ান কাপের প্রথম ম্যাচে নামতে চলেছে ভারত। প্রতিপক্ষ বিশ্বের ২৫ নম্বর ও এশিয়ার চার নম্বর অস্ট্রেলিয়া, চার বছর আগে এশিয়ান কাপে যারা কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেও হেরে গিয়েছিল এবং গত বছর বিশ্বকাপে যারা শেষ ১৬-র রাউন্ডে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে ছিটকে যায়।
এই অস্ট্রেলিয়াই শনিবার আল রায়ানের আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামে ভারতের সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের দিক থেকে দুই দলই ভাল জায়গায় রয়েছে। ফলে দু’পক্ষেরই ফুটবলাররা আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামবেন।
বিশ্ব ক্রমতালিকায় ২৫ নম্বরের সঙ্গে ১০২-এর লড়াই যখন, তখন অস্ট্রেলিয়াই এই ম্যাচে ফেভারিট। কিন্তু ফুটবলে অঘটন নতুন কোনও ঘটনা নয়। ভারত যদি গোল না খাওয়ার সংকল্প নিয়ে নামে এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই কার্যকরী ফুটবল খেলতে পারে, তা হলে অস্ট্রেলিয়াকে রুখে দিয়ে অঘটন ঘটাতে পারে তারা।
অস্ট্রেলিয়া যেমন তাদের শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই জিতে কাতারে এশিয়ান কাপের আসরে এসেছে, তেমন ভারতও পাঁচটির মধ্যে তিনটিতে জিতে তার পরে কাতারের মাটিতে পা রেখেছে। তাই কোনও দলেরই যে আত্মবিশ্বাসের অভাব হবে না, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
মানের বিচারে অস্ট্রেলিয়া যে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে, তা সম্প্রতি ভারতের ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্টিমাচ ও অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী, দুজনেই স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে যদি অন্তত এক পয়েন্ট ছিনিয়ে নিতে পারে ভারত, তা হলে শুধু তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে, তা নয়, টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় রাউন্ডের দিকেও পা বাড়িয়ে রাখবে তারা। এশিয়ান কাপের ইতিহাসে ভারতীয় ফুটবল দল কখনও প্রথম রাউন্ডের গণ্ডী পেরোতে পারেনি। এ বার পারলে এক নতুন ঐতিহাসিক মাইলফলক তৈরি করবে। এই তথ্যটুকুই তাদের উজ্জীবিত করার পক্ষে যথেষ্ট।
সাম্প্রতিক সাফল্যে আত্মবিশ্বাসী
ভারতের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সই দেশের ফুটবলপ্রেমীদের এই ভাবনা ভাবার সাহস জুগিয়েছে। ২০২৩-এ ভারত ঘরের মাঠে ১১টি ম্যাচ খেলে। তার মধ্যে ন’টিতে জেতে এবং দু’টিতে ড্র করে। অর্থাৎ গত বছরে ঘরের মাঠে হারের মুখে দেখেনি ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্টিমাচের প্রশিক্ষণাধীন ভারত। টানা আটটি ম্যাচে গোল খায়নি তারা। তিনটি চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবও জেতে। ভারতীয় ফুটবলে এমন ধারাবাহিকতা অনেকদিন দেখা যায়নি।
এই ধারাবাহিকতার ফলে ফিফার বিশ্ব ক্রমতালিকায় ৯৯ নম্বরেও উঠে আসে ভারত। কিন্তু দেশের বাইরে বেরিয়ে তাদের দুর্বলতা ফের ফুটে ওঠে। প্রথমে সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে কিংস কাপে ও পরে কুয়ালালামপুরে অক্টোবরে মারডেকা কাপে কোনও ম্যাচেই জিততে পারেনি তারা। দুর্দান্ত লড়াই করে ইরাকের বিরুদ্ধে জয়ের দোরগোড়ায় গিয়েও ফিরে আসতে হয় ভারতকে।
কিংস কাপ সেমিফাইনালে ভারতকে টাই ব্রেকারে হারায় বিশ্ব ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ২৯ ধাপ এগিয়ে থাকা ইরাক। এই টুর্নামেন্টে তৃতীয় স্থান নির্ধারক ম্যাচেও তাদের চেয়ে একধাপ পিছিয়ে থাকা লেবাননের কাছে ০-১-এ হারে ভারত। মারডেকা কাপে ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ৩২ ধাপ পিছিয়ে থাকা আয়োজক মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করেও জয়ের হাসি হাসতে পারেনি ভারত। সেই ম্যাচে ৪-২-এ জেতে মালয়েশিয়া। এশিয়ান গেমসের ফুটবলে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলেও সৌদি আরবের কাছে ০-২-এ হেরে ছিটকে যায় ভারত।
বিদেশের মাটিতে দলের পারফরম্যান্সই চিন্তায় রেখেছিল কোচ স্টিমাচকে। তবে নভেম্বরে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বের ইতিহাসে দেশের বাইরে প্রথম জয় অর্জন করে ফের আশা জাগায় ভারতীয় দল। কুয়েত সিটিতে রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে কুয়েতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের অভিযান শুরু করে ভারত। সারা ম্যাচে প্রতিপক্ষকে চাপে রেখে একাধিক সুযোগ তৈরির পর ৭৫ মিনিটের মাথায় মনবীর সিংয়ের অসাধারণ গোলে জয় পায় ভারত।
আনোয়ার আলি, আশিক কুরুনিয়ান ও জিকসন সিংয়ের মতো নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ভারত যে এত ভাল খেলা দেখাবে, তা অনেকেই ভাবতে পারেননি। এমন পারফরম্যান্স তাদের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে ঠিকই। কিন্তু শুধু আত্মবিশ্বাস দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মতো কঠিন প্রতিপক্ষকে হারানো সম্ভব না। চাই যথেষ্ট দক্ষতা, উপযুক্ত পরিকল্পনা ও সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী নিখুঁত পারফরম্যান্স। এই তিনটি দিক ঠিকঠাক হলে অজিদের বিরুদ্ধে আশাতীত ফল করতে পারেন সুনীল ছেত্রীরা। যা তারা ঘরের মাঠে কাতারের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে পারেনি।
অথচ চার বছর আগে সেপ্টেম্বরে এই দোহায় বিশ্বকাপ ২০২২ বাছাই পর্বের ম্যাচে স্মরণীয় পারফরম্যান্স দেখিয়েছিল ভারত। কাতারের একের পর এক আক্রমণ সামলে তাদের একটিও গোল করতে দেয়নি তারা। ম্যাচ শেষ হয়েছিল গোলশূন্য ড্রয়ে। যে কোনও ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীর কাছেই তা ছিল অপ্রত্যাশিত। তার তিন মাস আগেই জাপানকে তিন গোলে হারিয়ে গত বারের এশিয়ান কাপ জয় করেছিল কাতার। সেই কাতারকে একটিও গোল করতে না দিয়ে রুখে দেওয়া ভারতের মতো ক্রমতালিকায় একশোর বাইরে থাকা একটা দেশের পক্ষে ছিল দুর্দান্ত ফল। শনিবার সে রকমই বা তার চেয়েও ভাল খেলে তাক লাগিয়ে দেওয়াই এই ভারতীয় দলের লক্ষ্য।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়া যে কুয়েত বা কাতারের চেয়েও শক্তিশালী দল, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই তাদের বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত ফল করতে গেলে ভারতকে যতটা না দক্ষতা ও শারীরিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করতে হবে, তার চেয়েও বেশি কাজে লাগাতে হবে কৌশল ও মানসিক শক্তিকে।
অপ্রতিরোধ্য ‘সকারু’-দের গতি
শনিবার যে মাঠে ভারতের বিরুদ্ধে নামবে তারা, সেই মাঠেই গত বছর ফিফা বিশ্বকাপে পেরুকে হারিয়ে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল। সেটাই ছিল বিশ্বকাপে তাদের সেরা পারফরম্যান্স। এশিয়ান কাপের আগে টানা চার ম্যাচে জিতেছে তারা। অক্টোবরে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে এক গোলে হারার পর তারা হারায় নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ, প্যালেস্টাইন ও বাহরিনকে। দলের কোচ গ্রাহাম আর্নল্ড তবু দলকে ভারতের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছেন। কারণ, আন্ডারডগদের অঘটন ঘটানো ফুটবলে একেবারেই নতুন ঘটনা নয়।
আর্নল্ডের দলে একাধিক তরুণ ফুটবলার রয়েছেন, যাঁরা নিজেদের প্রমাণ করার জন্য মুখিয়ে থাকবেন। যেমন গোলকিপার জো গওচি, প্যাট্রিক ইয়াজবেক ও জন আয়ারডেল। তরুণ ফুল ব্যাক গেথিন জোন্স এই দলের রক্ষণে বড় ভরসা। বাহরিনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ম্যাচে অসাধারণ ফর্মে ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গী লরেন্স থমাসও ভাল ফর্মে রয়েছেন। তবে অধিনায়ক ও গোলকিপার ম্যাথু রায়ান যেহেতু সদ্য মুখের হাড়ে গুরুতর চোট সারিয়ে ফিরছেন, তাই তিনিই গোলে থাকবেন কি না, তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।
আক্রমণে মিচেল ডিউক ও কুসিনি ইয়েঙ্গি নিজেদের মধ্যে দুর্দান্ত বোঝাপড়ার জন্য বিখ্যাত। তাঁদের সঙ্গে এ লিগে দশ ম্যাচে ১৩ গোল করা ব্রুনো ফোর্নারোলি যে কোনও প্রতিপক্ষের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। উইঙ্গার মার্টিন বয়েল সকারুদের দলে নিয়মিত সদস্য। তবে গত এশিয়ান কাপে হাঁটুর চোটের জন্য খেলতে পারেননি তিনি। এ বারের টুর্নামেন্টে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা অবশ্যই করবেন তিনি। এই আক্রমণ বাহিনীকে কড়া পাহাড়ায় রাখাটাই ভারতের পক্ষে বড় চ্যালেঞ্জ।
কোচ স্টিমাচের ভরসা
আনোয়ারের অনুপস্থিতি ভারতের রক্ষণকে কিছুটা হলেও দুর্বল করে দিয়েছে। তাই সন্দেশ ঝিঙ্গন, শুভাশিস বোসের মতো অভিজ্ঞ ডিফেন্ডারদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার আগ্রাসী অ্যাটাকারদের আটকানোর দায়িত্ব নিতে হবে নিখিল পূজারি, রাহুল ভেকে-দের। তাঁদের সঙ্গে অবশ্যই রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করতে হবে সুরেশ ওয়াংজাম, লালেংমাওইয়া রালতে, অনিরুদ্ধ থাপাদের।
সহাল আব্দুল সামাদ সদ্য চোট সারিয়ে মাঠে ফিরেছেন। অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে তাঁকে শুরু থেকে নামানোর ঝুঁকি নেবেন কি না স্টিমাচ, সেটাই দেখার। তবে নাওরেম মহেশ সিং ও লিস্টন কোলাসোকে দুই উইংয়ে ব্যবহার করতে পারেন তিনি। যাঁরা তারকা ফরোয়ার্ড ও অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে আক্রমণে উঠতে পারেন। বিপক্ষের আক্রমণের চাপ সামলে ভারতকে মূলত প্রতি আক্রমণের ওপরই নির্ভর করতে হতে পারে। সে জন্য গতিময় ও নিখুঁত ট্রানজিশন খুবই জরুরি।
২০১১-র এশিয়ান কাপেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে চার গোলে হেরে অভিযান শুরু করেছিল ভারত। তবে সেবারের চেয়ে এ বার তাঁদের অবস্থা অন্য রকমের বলে জানিয়েছেন ভারত অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। তিনি বলেন, “এখন অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে যতটা বিস্তারিত ভাবে জানি, সেই তুলনায় তখন কিছুই জানতাম না আমরা। প্যালেস্টাইন ও বাহরিনের বিরুদ্ধে ওদের ফ্রেন্ডলি ম্যাচগুলো দেখেছি আমরা। প্রত্যেকের ক্লিপিং আলাদা করে দেখেছি আমরা। স্বীকার করতেই হবে, ওরা খুবই ভাল দল। আমরা আইএসএলে যে ফুটবল খেলি, তার চেয়ে ওরা অন্তত দু’ধাপ এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু আমরা অন্তত জানি যে ঠিক কীসের মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা”।
এই হোমওয়ার্ক ও আত্মবিশ্বাসের জোরে কতটা লড়াই করতে পারে ছেত্রী-বাহিনী, সেটা অবশ্যই আকর্যণের বিষয়। তবে এই ম্যাচে কোনও অঘটন ঘটাতে পারলে যে ভারত ফুটবল বিশ্বে আরও সন্মান অর্জন করে নিতে পারবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ভারতীয় স্কোয়াড:
গোলরক্ষক: অমরিন্দর সিং, গুরপ্রীত সিং সান্ধু, বিশাল কয়েথ।
ডিফেন্ডার: আকাশ মিশ্র, লালচুংনুঙ্গা, মেহতাব সিং, নিখিল পূজারি, প্রীতম কোটাল, রাহুল ভেকে, সন্দেশ ঝিঙ্গন, শুভাশিষ বোস।
মিডফিল্ডার: অনিরুদ্ধ থাপা, ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ, দীপক টাংরি, লালেংমাওইয়া রালতে, লিস্টন কোলাসো, নাওরেম মহেশ সিং, সহাল আব্দুল সামাদ, সুরেশ সিং ওয়াংজাম, উদান্ত সিং।
ফরোয়ার্ড: ইশান পন্ডিতা, লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে, মনবীর সিং, রাহুল কানোলি প্রবীণ (কেপি), সুনীল ছেত্রী, বিক্রম প্রতাপ সিং।
ম্যাচ: ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া
টুর্নামেন্ট: এএফসি এশিয়ান কাপ, গ্রুপ পর্ব
ভেনু: আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়াম, আল রায়ান
কিক অফ: ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪, বিকেল ৫.০০
টিভি সম্প্রচার: স্পোর্টস ১৮
অনলাইন স্ট্রিমিং: জিও সিনেমা