‘চেনা শত্রু’ কুয়েতের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব অভিযান শুরু ভারতের
বিদেশের মাটিতে খারাপ পারফরম্যান্সই ভাবাচ্ছে ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচকে। অচেনা পরিবেশে, অনভ্যস্ত মাঠে ভারতীয় দলের বেশিরভাগ ফুটবলারই বোধহয় ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারছেন না।

রাত পোহালেই শুরু হবে ভারতের বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের অভিযান। আগামী ফিফা বিশ্বকাপ ও এএফসি এশিয়ান কাপের মূলপর্বের দিকে কতটা এগোতে পারবে ভারত, তা বাছাই পর্বে তাদের এই অভিযান থেকেই বোঝা যাবে। যার সূচনা হতে চলেছে বৃহস্পতিবার। কুয়েত সিটির জাবের আল আহমাদ স্টেডিয়ামে কুয়েতের বিরুদ্ধে এ দিন খেলতে নামবে ভারত। যার প্রস্তুতি সেরে এসেছে দুবাইয়ে।
ভারতের গ্রুপে কাতার ও কুয়েত ছাড়াও রয়েছে আফগানিস্তান। ভারতের গ্রুপে তাদের চেয়ে ক্রমতালিকায় ওপরে থাকা একমাত্র দল কাতার। বাকি দু’টি দল ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে নীচে রয়েছে। প্রতি গ্রুপ থেকে দুটি করে দল তৃতীয় রাউন্ডে উঠবে। যদি তারা তাদের সেরা পারফরম্যান্স দেখাতে পারে, তা হলে ভারতের তৃতীয় রাউন্ডে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ রকম হলে ভারতীয় ফুটবলে বেনজির ঘটনা ঘটবে। গত বিশ্বকাপ ও আসন্ন এশিয়ান কাপের আয়োজক কাতার এখন বিশ্ব ক্রমতালিকায় ৬১ নম্বরে রয়েছে। ভারত রয়েছে ১০২ নম্বরে। কুয়েত ১৩৬-এ এবং আফগানিস্তান ১৬০ নম্বরে রয়েছে।
বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা জানিয়েছে, ২০২৬-এ বিশ্বকাপের মূলপর্ব হবে ৪৮টি দেশকে নিয়ে। এশিয়া থেকে আটটি দল খেলবে সেই বিশ্বকাপে। এ ছাড়াও আরও একটি এশীয় দেশ প্লে-অফের গণ্ডী পেরিয়ে মূলপর্বে উঠতে পারে। ফলে ধারাবাহিক ভাবে ভাল পারফরম্যান্স দেখাতে পারলে ভারতের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু বাস্তবে তা কতটা সম্ভব হবে, তার খুব সামান্য ইঙ্গিত পাওয়া যাবে এই ম্যাচে।
দেশে সাফল্য, বিদেশে ব্যর্থতা
চলতি বছরে ভারত ঘরের মাঠে ১১টি ম্যাচ খেলে। তার মধ্যে ন’টিতে জেতে এবং দু’টিতে ড্র করে। অর্থাৎ এই বছরে ঘরের মাঠে হারের মুখে দেখেনি ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্টিমাচের প্রশিক্ষণাধীন ভারত। টানা আটটি ম্যাচে গোল খায়নি তারা। তিনটি চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবও জেতে। এমন ধারাবাহিকতা অনেকদিন দেখেনি ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা। এই ধারাবাহিকতার ফলে ফিফার বিশ্ব ক্রমতালিকায় ৯৯ নম্বরেও উঠে আসে ভারত। কিন্তু দেশের বাইরে বেরিয়ে তাদের দুর্বলতা ফের ফুটে ওঠে। প্রথমে সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে কিংস কাপে ও পরে কুয়ালালামপুরে অক্টোবরে মারডেকা কাপে কোনও ম্যাচেই জিততে পারেনি তারা।
দুর্দান্ত লড়াই করে ইরাকের বিরুদ্ধে জয়ের দোরগোড়ায় গিয়েও ফিরে আসতে হয় ভারতকে। কিংস কাপ সেমিফাইনালে ভারতকে টাই ব্রেকারে হারায় বিশ্ব ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ২৯ ধাপ এগিয়ে থাকা ইরাক। কিংস কাপের তৃতীয় স্থান নির্ধারক ম্যাচেও তাদের চেয়ে একধাপ পিছিয়ে থাকা লেবাননের কাছে ০-১-এ হারে ভারত। মারডেকা কাপে ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ৩২ ধাপ পিছিয়ে থাকা আয়োজক মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করেও জয়ের হাসি হাসতে পারেনি ভারত। সেই ম্যাচে ৪-২-এ জেতে মালয়েশিয়া। এশিয়ান গেমসের ফুটবলে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলেও সৌদি আরবের কাছে ০-২-এ হেরে ছিটকে যায় ভারত। বিদেশের মাটিতে এই খারাপ পারফরম্যান্সই ভাবাচ্ছে ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচকে।
যথেষ্ট অভিজ্ঞতার অভাবে অচেনা পরিবেশে, অনভ্যস্ত মাঠে ভারতীয় দলের বেশিরভাগ ফুটবলাররাই যে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারছেন না, সেটাই দেখা যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার কুয়েত সিটির আরামদায়ক আবহাওয়ায় অবশ্য ভারতীয়দের তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সন্ধ্যার তাপমাত্রা ২০-২১ ডিগ্রি সেলসিয়স থাকতে পারে বলে জানিয়েছে পূর্বাভাষ। আর্দ্রতা ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। এমন আবহাওয়ায় ভাল ফুটবল খেলাই যায়। তবে বজ্রবিদ্যূৎ-সহ বৃষ্টির যে পূর্বাভাষ আছে ওই দিন, তাতে মাঠের অবস্থা কী হতে পারে, তা আগে থেকে আন্দাজ করা কঠিন।
ভাল-মন্দয় মেশানো বছর
সেপ্টেম্বরে বেঙ্গালুরুর কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে এই কুয়েতকে হারিয়েই সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। সেই ম্যাচে আল খলিদি ও লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের গোলে নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময় ১-১ থাকার পর ম্যাচ গড়ায় টাই ব্রেকারে। পাঁচটি করে শটের পর ৪-৪ থেকে যাওয়ায় ম্যাচ গড়ায় সাডেন ডেথে। প্রথম শটে কোনও ভুল করেননি নাওরেম মহেশ সিং। কিন্তু কুয়েতের অধিনায়ক এল এব্রাহিম হাজিয়ার শট বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেভ করে শেষ রাতে ওস্তাদের মার দেখান বহু যুদ্ধের নায়ক গোলকিপার গুরপ্রীত সিং।
তার কয়েকদিন আগেই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে প্রায় জেতা ম্যাচ হাতছাড়া করে কুয়েতের বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে। প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ে দুর্দান্ত গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ভারতীয় অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবধান বজায় রেখেছিল ভারত। কিন্তু ৯২ মিনিটের মাথায় প্রতিপক্ষের আক্রমণ ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজেদের গোলেই বল ঠেলে দেন আনোয়ার আলি।
চলতি বছরে এই দু’বারই ফুটবল মাঠে দেখা হয়েছে দুই দেশের। তার আগে ভারতের বিরুদ্ধে যে তিনটি ম্যাচ খেলে কুয়েত, তার মধ্যে দুটিতে জেতে তারা, একটিতে হারে। সাফের আগে দুই দল শেষ মুখোমুখি হয়েছিল ২০১০-এর নভেম্বরে, আবুধাবিতে এক ফ্রেন্ডলি ম্যাচে। সেই ম্যাচে ৯-১-এ জিতেছিল কুয়েত। চলতি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের বিরুদ্ধে একটি গোল খাওয়া ছাড়া আর কোনও ম্যাচে গোল খায়নি, কিন্তু করেছে সাতটি। বছরের শুরুতে তারা গালফ কাপে খেলে। সেখানে কাতারের কাছে ০-২-এ হারে, আরব আমিরশাহীকে ১-০-য় হারায়, বাহরিনের সঙ্গে ১-১ ড্র করে। মার্চে দুটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ফিলিপিন্সকে ২-০-য় হারায় কুয়েত এবং তাজিকিস্তানকে ২-১-এ হারায়। বেঙ্গালুরুতে আসার আগে জাম্বিয়াকে ৩-০-য় হারিয়ে আসে তারা।
সাফ সেমিফাইনালে তারা বাংলাদেশকে হারায় ১-০-য়। ফাইনালে ভারতের কাছে হারার পরে সেপ্টেম্বরে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে তারা বাহরিনকে হারায় ৩-১-এ ও কিরগিজস্তানের কাছে ১-৩-এ হারে। অক্টোবরে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর কাছে ০-১-এ হারে তারা এবং সিরিয়াকে ২-১-এ হারায়। এ বছর ১৫টি ম্যাচের মধ্যে ন’টিতে জেতে তারা, তিনটিতে ড্র করে। ভাল-মন্দয় মেশানো বছরে দলটি ভারতের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে কতটা আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে, সেটাই দেখার।
দলের প্রধান স্ট্রাইকার শাবায়েব আল খলিদি ভারতীয় রক্ষণে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। আন্তর্জাতিক অভিষেকেই গোল পাওয়া খলিদি সম্প্রতি সিরিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ জয়ে দুটি গোলই করেন। সাফ ফাইনালেও গোল করেছিলেন তিনি। কুয়েতের রক্ষণে অন্যতম স্তম্ভ অধিনায়ক ফাহাদ আল হাজেরি। এই সেন্টার ব্যাক অবশ্য প্রতিপক্ষের এলাকায় সেটপিসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভারত অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে তাঁর লড়াই জমে উঠতে পারে বৃহস্পতিবার।
সুনীলদের চোট-চিন্তা
চোটের জন্য ডিফেন্ডার আনোয়ার আলি ও মিডফিল্ডার আশিক কুরুনিয়ানের অনুপস্থিতি স্টিমাচকে চিন্তায় রেখেছে। আর এক তরুণ মিডিও জিকসন সিংকেও যে পাবেন না, সেই দুশ্চিন্তার কথাও সম্প্রতি জানিয়েছেন ভারতীয় দলের কোচ। এঁদের উপযুক্ত বিকল্প খুঁজে বের করাই ভারতীয় দলের আসল পরীক্ষা।
আক্রমণ বিভাগে সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, নাওরেম মহেশ সিংদের খেলাতে পারেন স্টিমাচ। তাঁদের পিছনে রাখতে পারেন সহাল আব্দুল সামাদ, ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজদের। অনিরুদ্ধ থাপা, গ্ল্যান মার্টিন্স, লিস্টন কোলাসো, উদান্ত সিং, নন্দকুমার শেখরদের মতো নিডফিল্ডাররাও রয়েছেন তাঁর হাতে, যাঁরা সম্প্রতি ক্লাব ফুটবলে ভাল খেলে এসেছেন। যদিও এঁদের মধ্যে অনেকে ধারাবাহিক নন। সন্দেশ ঝিঙ্গনের নেতৃত্বে রক্ষণে আকাশ মিশ্র, লালচুঙনুঙ্গা, মেহতাব সিং, রোশন সিং নাওরেম, শুভাশিস বোসদেরও দেখা যেতে পারে। তবে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা অনুযায়ীই প্রথম এগারোর উপযুক্ত ও সঠিক কম্বিনেশন তৈরি করবেন স্টিমাচ, এমন আশাই করা যেতে পারে।
ভারতীয় স্কোয়াড:
গোলকিপার: অমরিন্দর সিং, গুরপ্রীত সিং সান্ধু ও বিশাল কয়েথ;
ডিফেন্ডার: আকাশ মিশ্র, লালচুঙনুঙ্গা, মেহতাব সিং, নিখিল পূজারি, রাহুল ভেকে, রোশন সিং নাওরেম, সন্দেশ ঝিঙ্গন, শুভাশিস বোস;
মিডফিল্ডার: অনিরুদ্ধ থাপা, ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ, গ্ল্যান মার্টিন্স, লালেঙমাউইয়া, লিস্টন কোলাসো, মহেশ সিং নাওরেম, নন্দকুমার শেখর, রোহিত কুমার, সহাল আব্দুল সামাদ, সুরেশ ওয়াংজাম, উদান্ত সিং;
ফরোয়ার্ড: ইশান পন্ডিতা, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, মনবীর সিং, রাহুল কেপি, সুনীল ছেত্রী, বিক্রম প্রতাপ সিং।
ম্যাচ: কুয়েত বনাম ভারত
টুর্নামেন্ট: বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব, এশীয় অঞ্চল, দ্বিতীয় রাউন্ড
ভেনু: জাবের আল আহমাদ স্টেডিয়াম, কুয়েত সিটি
কিক অফ: ১৬ নভেম্বর, রাত ১০.০০
টিভি সম্প্রচার: স্পোর্টস ১৮
অনলাইন স্ট্রিমিং: ফ্যানকোড