যদি কোনও কুইজ অনুষ্ঠানে জিজ্ঞেস করা হয় ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল)-এর ইতিহাসে সবচেয়ে সফল কোচ কে, তখন যে নামটি অবশ্যই সবার আগে মাথায় আসবে, তা হল আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আইএসএল এবং ভারতীয় ফুটবল — দুই জগতেই আন্তোনিও লোপেজ হাবাস একটি পরিচিত নাম। ৬৮ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ কোচ ২০১৪ সালে আইএসএলের প্রথম মরশুমেই লিগে যোগ দেন এবং তখন থেকেই তিনি প্রায় প্রতিটি ক্লাবেই সফল অধ্যায় রচনা করেছেন।

তাঁর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশলগত দূরদৃষ্টি এবং জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠার মানসিকতা হাবাসকে শুধুই সাফল্য এনে দেয়নি, তিনি নিজের হাতে এক নতুন যুগের সূচনা করেছেন, যার প্রভাব আজও উপলব্ধি করা যায়।

দাপুটে সূচনা ও গৌরব

২০১৪-য় এটিকে এফসিকে তাদের প্রথম আইএসএল কাপ এনে দেন হাবাস এবং লিগের ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিয়ে চিরস্মরণীয় করে তোলেন। দলের ফুটবলারদের নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি ও কৌশলগত দক্ষতা নিখুঁত। খুব অল্প সময়েই নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তিনি।

দ্বিতীয় মরশুমেও তিনি ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। কলকাতার দলটি ২০১৫ মরশুমেও ফের প্লে-অফে পৌঁছয়, যদিও সেমিফাইনালে চেন্নাইন এফসির কাছে হেরে যায়। এর পর ২০১৬-য় তিনি এফসি পুনে সিটির দায়িত্ব নেন, কিন্তু সেবার সেরা চারে পৌঁছে দিতে পারেননি তাদের।

প্রত্যাবর্তনেও ট্রফি জয়

২০১৯ মরশুমে আইএসএলে ফিরে আসেন স্প্যানিশ ফুটবল গুরু এবং এটিকে এফসিতে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নেন। সেবারও দ্রুত প্রভাব বিস্তার করেন তিনি। গত কয়েক মরশুমে দলে যা যা দুর্বলতা ছিল, তা কাটিয়ে সেই মরশুমেই দলকে তৃতীয় আইএসএল কাপ এনে দেন।

পরের মরশুমে তিনি মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কোচের দায়িত্ব পালন করেন এবং তখন থেকেই তাঁকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ চড়তে থাকে। হাবাস সেই প্রত্যাশা পূরণ করেন – ২০ ম্যাচে ৪০ পয়েন্ট অর্জন করে দারুণ পারফর্ম করে দল। তবে খুব অল্পের জন্য লিগ শিল্ড জেতা হয়নি। কারণ, মুম্বই সিটি এফসির কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়ে তারা। আইএসএল কাপ ফাইনালেও মুম্বইয়ের বিপক্ষে ১-২-এ হেরে যায়। ২০২১–২২ মরশুমে হাবাস সবুজ-মেরুন বাহিনীর কোচ হিসেবে থেকে গেলেও, দল পরপর চার ম্যাচ জয়হীন থাকায় ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

লিগ শিল্ড জয়, বৃত্তের পূর্ণতা

এ বার আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের ফেরা কার্যত ছিল এক বার্তা। আইএসএলের সব ট্রফির মধ্যে শুধু লিগ শিল্ডই ছিল না তাঁর ট্রফির শো কেসে। ২০২৩–২৪ মরশুমে সেটিই অর্জন করে সেই অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করেন তিনি।

২০২৪-এর জানুয়ারিতে যখন তিনি ফের দায়িত্ব নেন, পরিস্থিতি অনেকটাই ছিল ২০২১ সালের মত। তখন দলের কোচ হুয়ান ফেরান্দোর অধীনে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট পরপর হারছিল এবং বেশ খারাপ সময় যাচ্ছিল তাদের। সেই পরিস্থিতিতে হাবাসের জাদুই দারুন কাজ করল— টানা ১১টি লিগ ম্যাচে অপরাজিত থেকে দলকে প্রায় খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন তিনি। তাঁর ছোঁয়ায় দল নতুন উদ্দীপনা পায়। শিল্ড জয়ের পথে সেই ধারাবাহিকতাই বজায় ছিল।

যদিও কাপ ফাইনালে আবারও মুম্বই সিটি এফসির কাছে হেরে আইএসএল ডাবল (শিল্ড ও কাপ) জেতা হয়নি, কিন্তু ২০২৩–২৪ মরশুমে অবশেষে তারা বহু প্রতীক্ষিত লিগ শিল্ড ঘরে তোলে।

ফলভিত্তিক দর্শনেই সাফল্য

অনেক কোচ আছেন যারা সৌন্দর্যে ভরা পজেশন-ভিত্তিক ফুটবলে বিশ্বাসী। কিন্তু হাবাস বরাবরই ছিলেন এমন এক কৌশলের প্রবক্তা, যে কৌশল শুধুমাত্র ভাল ফলের কথা চিন্তা করে তৈরি করা হয়। রক্ষণভাগের দৃঢ়তা, কৌশলগত শৃঙ্খলা এবং ঝড়ের গতিতে প্রতি আক্রমণ — এ সবই ছিল তাঁর দলে বৈশিষ্ট্য। বারবার নিজের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছেন হাবাস। শুধু ট্রফি জেতেননি, বরং এক উত্তরাধিকারের জন্ম দিয়েছেন — যে মডেলের নাম অনায়াসে দেওয়া যেতে পারে, ‘দ্য হাবাস এফেক্ট’।

এই লেখাটি ইংরেজিতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন