ভারতীয় ফুটবল দলের সামনে যে শুধু এএফসি এশিয়ান কাপের চ্যালেঞ্জ, তা নয় আরও একটা বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে তাদের সামনে। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ডে ওঠার চ্যালেঞ্জ, যে লক্ষ্যের দিকে এগোনোর পথে প্রথম ধাপটা তারা পেরিয়েছে সাফল্যের সঙ্গে, গত বৃহস্পতিবার কুয়েতকে তাদের মাঠে গিয়ে হারিয়ে এসে। এ বার দ্বিতীয় ধাপে তারা।

মঙ্গলবার ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে গত বিশ্বকাপে আয়োজক ও অংশগ্রহনকারী এশিয়ার অন্যতম সেরা দল কাতারের মুখোমুখি হতে চলেছে সুনীল ছেত্রী ও তাঁর দল। ঘরের মাঠে ভরা গ্যালারির সামনে সুনীলরা উজ্জীবিত ফুটবল খেলবেন ঠিকই। কিন্তু কাতার তো আর কুয়েত নয়। লড়াইটা আরও কঠিন। এই লড়াইয়ে জিততে গেলে একশো শতাংশ নয়, ভারতীয় ফুটবলারদের তার চেয়েও বেশি কিছু দিতে হবে মাঠে।

বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বের ইতিহাসে দেশের বাইরে পা রেখে এই প্রথম জয় অর্জন করে আনা ভারতীয় দলের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে রয়েছে ঠিকই। কিন্তু শুধু আত্মবিশ্বাস দিয়ে এ রকম একটা কঠিন ম্যাচ জেতা সম্ভব না। চাই যথেষ্ট দক্ষতা, উপযুক্ত পরিকল্পনা ও সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী নিখুঁত পারফরম্যান্স। এই তিনটি দিক ঠিকঠাক হলে ভারত কাতারের বিরুদ্ধে একটা ভাল ফল করতে পারে, যেমন করেছিল চার বছর আগে তাদের দেশে গিয়ে।

২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে দোহায় বিশ্বকাপ ২০২২ বাছাই পর্বের ম্যাচে কাতারের একের পর এক আক্রমণ সামলে তাদের একটিও গোল করতে দেয়নি ভারত। ম্যাচ শেষ হয়েছিল গোলশূন্য ড্রয়ে, যা যে কোনও ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীর কাছেই ছিল অপ্রত্যাশিত। তার তিন মাস আগেই জাপানকে তিন গোলে হারিয়ে এশিয়ান কাপ জয় করেছিল কাতার। সেই কাতারকে একটিও গোল করতে না দিয়ে রুখে দেওয়া ভারতের মতো ক্রমতালিকায় একশোর বাইরে থাকা একটা দেশের পক্ষে ছিল দুর্দান্ত ফল। মঙ্গলবার সে রকমই বা তার চেয়েও ভাল ফল করে তাক লাগিয়ে দেওয়াই এই ভারতীয় দলের লক্ষ্য।

‘বাড়তি চাপ নয়, উপভোগ করো’

এ বারের লড়াইটাও কম কঠিন নয়। বিশ্বের ৬১ নম্বরের সঙ্গে বিশ্বের ১০২ নম্বরের লড়াই। তার ওপর ঘরের মাঠে হাজার হাজার প্রত্যাশী সমর্থকের সামনে সেরা পারফরম্যান্স দেখানোর চ্যালেঞ্জ। এর সুবিধা যেমন আছে, তেমন চাপটাও একটু বেশিই। ভারতীয় দলের আত্মবিশ্বাসী কোচ ইগর স্টিমাচ অবশ্য তাঁর দলের খেলোয়াড়দের চাপ নিতে বারণ করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা কাতারকে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছি এবং গতি ও শক্তির দিক থেকে তারা কতটা কী করতে পারে, তা ভাল করেই বুঝে নিয়েছি। আফগানিস্তানকে তারা আট গোল করে হারিয়েছে, আরও আট গোল দিতে পারত। তাই আমাদের কাছে এই ম্যাচটা বেশ কঠিন হয়ে উঠবে। তবে ছেলেদের বলেছি ম্যাচটা উপভোগ করো। কুয়েতের বিরুদ্ধে জিতে আমরা প্রথম ধাপটা ভালভাবেই পেরিয়ে এসেছি। আমি চাই না এই ম্যাচে ছেলেরা বাড়তি চাপ নিয়ে খেলুক। বরং কাতারের বিরুদ্ধে নিজেদের গুনগুলো মেলে ধরার চেষ্টা করুক”।

চলতি বছরে ভারত ঘরের মাঠে ১১টি ম্যাচ খেলে। তার মধ্যে ন’টিতে জেতে এবং দু’টিতে ড্র করে। অর্থাৎ এই বছরে ঘরের মাঠে হারের মুখে দেখেনি ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্টিমাচের প্রশিক্ষণাধীন ভারত। টানা আটটি ম্যাচে গোল খায়নি তারা। তিনটি চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবও জেতে। ভারতীয় ফুটবলে এমন ধারাবাহিকতা অনেকদিন দেখা যায়নি। এই ধারাবাহিকতার ফলে ফিফার বিশ্ব ক্রমতালিকায় ৯৯ নম্বরেও উঠে আসে ভারত। কিন্তু দেশের বাইরে বেরিয়ে তাদের দুর্বলতা ফের ফুটে ওঠে। প্রথমে সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে কিংস কাপে ও পরে কুয়ালালামপুরে অক্টোবরে মারডেকা কাপে কোনও ম্যাচেই জিততে পারেনি তারা।

দুর্দান্ত লড়াই করে ইরাকের বিরুদ্ধে জয়ের দোরগোড়ায় গিয়েও ফিরে আসতে হয় ভারতকে। কিংস কাপ সেমিফাইনালে ভারতকে টাই ব্রেকারে হারায় বিশ্ব ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ২৯ ধাপ এগিয়ে থাকা ইরাক। কিংস কাপের তৃতীয় স্থান নির্ধারক ম্যাচেও তাদের চেয়ে একধাপ পিছিয়ে থাকা লেবাননের কাছে ০-১-এ হারে ভারত। মারডেকা কাপে ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ৩২ ধাপ পিছিয়ে থাকা আয়োজক মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করেও জয়ের হাসি হাসতে পারেনি ভারত। সেই ম্যাচে ৪-২-এ জেতে মালয়েশিয়া। এশিয়ান গেমসের ফুটবলে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলেও সৌদি আরবের কাছে ০-২-এ হেরে ছিটকে যায় ভারত। বিদেশের মাটিতে এই খারাপ পারফরম্যান্সই চিন্তায় ফেলে দেয় ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচকে।

কুয়েতে সাফল্যে উজ্জীবিত

কিন্তু গত বৃহস্পতিবার কুয়েত সিটিতে রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে কুয়েতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের অভিযান শুরু করে ভারত। সারা ম্যাচে প্রতিপক্ষকে চাপে রেখে একাধিক সুযোগ তৈরির পর ৭৫ মিনিটের মাথায় মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের তারকা মনবীর সিংয়ের অসাধারণ গোলে জয় পায় ভারত। এই জয়ের পর শুধু ভারতীয় কোচ নন, স্বস্তি পেয়েছেন দলের খেলোয়াড়রাও। আনোয়ার আলি, আশিক কুরুনিয়ান ও জিকসন সিংয়ের মতো নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ভারত যে এত ভাল খেলা দেখাবে, তা অনেকেই ভাবতে পারেননি।

এই নিয়ে কোচ স্টিমাচ বলেন, “গ্রুপের দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতে গেলে যে দলকে হারানো দরকার, তাদের আমরা হারাতে পেরেছি। এটাই আমাদের উজ্জীবিত করার পক্ষে যথেষ্ট। পরের রাউন্ডে যেতে গেলে আমাদের গ্রুপের দ্বিতীয় স্থানে থাকতে হবে। সেই লক্ষ্যে এগোনোর জন্য আমাদের এই জয় যথেষ্ট সাহায্য করবে। কাতার বরাবরই এই গ্রুপের সেরা দল হিসেবে ফেভারিট। আমাদের উচ্চাকাঙ্খা নেই। তবে আমরা জানি আমাদের সুযোগ রয়েছে এবং সেই সুযোগ কাজে লাগাতেই হবে আমাদের”।

বিশ্বকাপের পরে অবনতি

গত বছর নিজেদের দেশে হওয়া বিশ্বকাপের মূলপর্বে কাতার হারে ইকুয়েডর, সেনেগাল ও নেদারল্যান্ডসের কাছে। এই তিন ম্যাচে এক গোল দিয়ে সাতটি গোল খায় তারা। বাছাই পর্বের আগে এ বছর তারা মোট ১৫টি ম্যাচ খেলেছে। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে জেতে। জানুয়ারিতে গালফ কাপে কুয়েতকে ২-০-য় হারায় তারা। তবে বাহরিনের কাছে ১-২-এ হারে এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে। গালফ কাপের সেমিফাইনালে ইরাকের কাছে ১-২-এ হেরে ছিটকে যায়।

জুনে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে স্টিমাচের দেশ ক্রোয়েশিয়ার বি দলের কাছে এক গোলে হারে ও জামাইকাকে ২-১-এ হারায় কাতার। জুন-জুলাইয়ে হাইতি ও মেক্সিকোকে হারিয়ে এবং হন্ডুরাসের সঙ্গে ড্র করে কনকাকাফ গোল্ড কাপের সেমিফাইনালে ওঠে তারা। কিন্তু সেখানে পানামার কাছে চার গোলে হেরে সেই টুর্নামেন্টের বাইরে চলে যায়। সেপ্টেম্বরে তারা কেনিয়ার কাছে ১-২-এ হারে ও রাশিয়ার সঙ্গে ১-১ ড্র করে, যা তাদের পক্ষে ছিল উল্লেখযোগ্য ফল। গত মাসে ইরানের কাছে চার গোলে হারে এবং তার চার দিন আগে ইরাকের বিরুদ্ধে গোলশূন্য রাখার পর পেনাল্টি শুট আউটে জেতে। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ৮-১ জয় দিয়ে বাছাই পর্ব শুরু করেছে কাতার।

তারকা কোচ, বিপজ্জনক ফুটবলার

বিশ্বকাপে কোচের দায়িত্বে থাকা ফেলিক্স স্যানচেজকে সরিয়ে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে সেই দায়িত্ব নিয়েছেন কার্লোস কুইরোজ, যিনি ২০১০ বিশ্বকাপে পর্তুগালের কোচ ছিলেন এবং তাঁদের শেষ ১৬ পর্যন্ত পৌঁছতে সাহায্য করেন। ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইরানের কোচ। এই সময়ে দু’বার ইরানকে বিশ্বকাপের মূলপর্বে উঠতে সাহায্য করেন কুইরোজ। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে তিনি ছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সহকারী কোচ। কাজ করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সঙ্গে।

তবে কাতারে তাঁর শুরুটা তেমন ভাল হয়নি। তাঁর প্রশিক্ষণে দশটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিনটিতে জেতে তাঁর দল। সাধারণত ৪-৩-৩ ছকে দলকে খেলাতে পছন্দ করেন কুইরোজ। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলগুলিকে ম্যাচের শুরু থেকেই চাপে ফেলার পক্ষপাতী তিনি। ভারতকে এই চাপ সামলে ৯০ মিনিট ধরে যেমন তাদের আটকে রাখতে হবে, তেমনই কাউন্টার অ্যাটাকের সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সুনীল ছেত্রীরা যে খুব বেশি গোলের সুযোগ পাবেন না, এমন সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু যে গুটিকয়েক সুযোগ তাঁরা পাবেন, তা কাজে লাগাতে হবে তাঁদের। না হলে কাতারকে পাল্টা চাপে ফেলা সম্ভব নয়।

আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে চার গোল করা আলমোজ আলি কাতারের আক্রমণের সবচেয়ে বিপজ্জনক খেলোয়াড়। তাঁর সঙ্গী ফরোয়ার্ড ও অধিনায়ক হাসান আল হেইদোস যথেষ্ট অভিজ্ঞ। দেশের হয়ে ১২৮টি ম্যাচ খেলে ৩২ গোল করেছেন। গত বিশ্বকাপের বাছাই পর্বেও ভারতের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন তিনি। এই দলের তরুণ লেফট উইঙ্গার আক্রাম আফিফ তাঁর গতি ও ক্ষিপ্রতা দিয়ে বিপজ্জনক আক্রমণ তৈরি করেন ও গোলও করেন। নিজেদের গোল এরিয়ায় এই তিন খেলোয়াড়কে কড়া নজরে রাখতেই হবে সন্দেশ ঝিঙ্গনদের। না পারলেই সমূহ বিপদ আসন্ন। এ পর্যন্ত দুই দলের মধ্যে তিনবারের মুখোমুখিতে দু’বার জিতেছে কাতার ও একবার ড্র হয়েছে। চতুর্থবার কী হয়, তা দেখার আশায় থাকবেন সারা দেশের ফুটবলপ্রেমীরা।

ভারতীয় স্কোয়াড:

গোলকিপার: অমরিন্দর সিং, গুরপ্রীত সিং সান্ধু ও বিশাল কয়েথ;

ডিফেন্ডার: আকাশ মিশ্র, লালচুঙনুঙ্গা, মেহতাব সিং, নিখিল পূজারি, রাহুল ভেকে, রোশন সিং নাওরেম, সন্দেশ ঝিঙ্গন, শুভাশিস বোস;

মিডফিল্ডার: অনিরুদ্ধ থাপা, ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ, আপুইয়া, লিস্টন কোলাসো, মহেশ সিং নাওরেম, রোহিত কুমার, সহাল আব্দুল সামাদ, সুরেশ ওয়াংজাম, উদান্ত সিং;

ফরোয়ার্ড: ইশান পন্ডিতা, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, মনবীর সিং, রাহুল কেপি, সুনীল ছেত্রী।

ম্যাচ: ভারত বনাম কাতার

টুর্নামেন্ট: বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব, এশীয় অঞ্চল, দ্বিতীয় রাউন্ড

ভেনু: কলিঙ্গ স্টেডিয়াম, ভুবনেশ্বর

কিক অফ: ২১ নভেম্বর, সন্ধ্যা ৭.০০