জামশিদ নাসিরিকে যেমন ভুলতে পারবেন না বাংলা তথা ভারতের ফুটবলপ্রেমীরা, তেমনই তাঁর গর্ব তাঁর পুত্র কিয়ান নাসিরিকেও ভোলা কঠিন। এ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা তাঁকে মনে রাখবে তাঁর অসাধারণ এক কীর্তির জন্য।

ফুটবল জীবনের একেবারে শুরুতে না বলে একেবারে শুরুর দিন বললেই ভাল। ২০২২-এর জানুয়ারির সেই দিনটার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে? মোহনবাগানের হয়ে জীবনের প্রথম ডার্বি খেলতে নেমেছিলেন কিয়ান। দীপক টাঙরির জায়গায় পরিবর্ত হিসেবে নেমে ম্যাচের শেষ ৩০ মিনিটে যে হ্যাটট্রিক করেছিলেন, তা তাঁর ফুটবল কেরিয়ারের সেরা ঘটনা। যতদিন ফুটবল পায়ে মাঠে নামবেন, তত দিন তাঁর নামের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই কীর্তিকেও মনে রাখবে সবাই।

তার পরে অনেকটা সময় গড়িয়েছে। ক্রমশ নিজেকে উন্নত করে তুলেছেন এখন ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ ফুটবল প্রতিভা, যাঁর রক্তেই রয়েছে ফুটবলের বীজ। এত দিনে আইএসএলে খেলার পর এ বার ডাক পেয়েছেন জাতীয় শিবিরেও। চলতি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে ভারতীয় দলে রয়েছেন তিনি। প্রথম ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ হয়নি ঠিকই। দ্বিতীয় ম্যাচে সিরিয়ার বিরুদ্ধে কি তাঁকে নামাবেন দলের নতুন কোচ মানোলো মার্কেজ?

মাঠে নামার সুযোগ পান বা না পান, জাতীয় শিবিরে ডাক পাওয়াটাকেই অনেক বড় করে দেখছেন কলকাতার কিয়ান। হায়দরাবাদে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "গত কয়েক বছর আইএসএলে খেলার পর আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া, এবং আমি তা অর্জন করেছি। এখনই জাতীয় দলে ডাক পাব বলে সত্যিই আশা করিনি, তবে আমি খুশি। সবে প্রথম ধাপটা পেরিয়েছি, দ্বিতীয় ধাপটা হল দেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামা এবং তার পরে ভাল কিছু করা"।

তবে তিনি মাঠে নামতে না পারলেও দুঃখ নেই কিয়ানের। বলেন, "আমার সামনে এখন একটাই লক্ষ্য, নিজের সেরাটা দেওয়া। তবে আমরা চাই ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে দল সফল হোক। সে আমার আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হোক বা না হোক"।

জাতীয় শিবিরে যোগ দিতে পারাটাই তাঁর কাছে গর্বের বলে জানান দেশের অন্যতম প্রতিভাবান ফরোয়ার্ড, প্রতিপক্ষের এলাকায় যাঁর গতি ও ক্ষিপ্রতা বারবার প্রশংসিত হয়েছে। তিনি বলেন,"আমি ভারতীয় শিবিরে থাকতে পেরে সত্যিই খুশি। এটা আমার প্রথম জাতীয় ক্যাম্প এবং যখন দলে আমার নাম দেখলাম, তখন আমি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ি"।

ভারতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "যদি কোচ মনে করেন, আমাকে খেলার সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে, আমি সে জন্য তৈরি। তবে যদি সে সুযোগ নাও আসে, তাও খারাপ লাগবে না। দেশের সেরা ২৫ জন খেলোয়াড়ের সঙ্গে অনুশীলন করার আনন্দ উপভোগ চাই আমি। কঠোর পরিশ্রম করলে সামনে আরও অনেক সুযোগ আসবে"।

জাতীয় দলে তিনি নতুন মুখ হলেও তাঁর আশেপাশে তাঁর অনেক পরিচিত ফুটবলার রয়েছেন, যাঁদের জন্য তিনি ভারতীয় শিবিরে স্বচ্ছন্দেই রয়েছেন। "যখন প্রথম জাতীয় শিবিরে এলাম, তখন ভেবেছিলাম, হয়তো অভিজ্ঞতাটা একটু অন্যরকম হবে। তবে খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারলাম যে, দলের ছেলেদের সঙ্গে আমি সহজেই মিশে যাচ্ছি," বললেন নাসিরি, "এমনকী, যারা এত বছর আমার প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিল, তারা এখন আমাকে যে কোনও ছোটখাটো বিষয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে। আমার কাছে এটা দারুণ পরিবেশ। এমন পরিবেশ পেয়ে আমি খুব খুশি"।

নিজের শহর কলকাতার মহামেডান স্পোর্টিংয়ে নাসিরি তার ফুটবলের যাত্রা শুরু করেন। তার পর মোহনবাগানে যোগ দেন। গত পাঁচ বছর সেখানেই কাটিয়েছেন। ২০২২-এ আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে সেই হ্যাটট্রিকের ফলে তিনি সবার নজরে চলে আসেন। তবে তাঁর ওপর স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই প্রত্যাশা সকলের।

কারণ, তাঁর বাবা জামশিদ নাসিরি ১৯৮০-র দশকে ইস্টবেঙ্গল ও মহামেডান স্পোর্টিংয়ের অন্যতম সেরা ও জনপ্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন। তবে সেই চাপ এখন কিয়ানের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "সব সময়ই আমার ওপর একটা চাপ থাকে। আমি এমনই এক পরিবার থেকে এসেছি। অনেকেই বলেন, 'তুমি জানো, তোমার বাবা এটা করেছেন, তোমার বাবা ওটা করেছেন?' তবে আমি কখনওই এ সবে প্রভাবিত হই না। আমি আমার নিজস্ব ছন্দ খুঁজছি। সারা জীবন ধরেই এই চেষ্টা করছি," তিনি বললেন।

তারকা ফুটবলারের ছেলে হিসেবে তিনি যে বরাবরই ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন, তা সাফ জানিয়ে কিয়ান বলেন, "আমি জানি, অনেক পরিস্থিতিতেই অনেকে তাদের বাবা-মায়ের পথ বেছে নিতে পারে না। তবে আমি সবসময়ই ফুটবলার হতে চেয়েছি এবং তা হয়ে উঠতে পেরে আমি খুশি। আমি একমাত্র এটাই করতে জানি এবং প্ল্যান 'এ' সফল না হলে আমার প্ল্যান 'বি' হিসেবে কী বেছে নিতাম তা বলতে পারব না"। কিয়ান অবশ্য প্ল্যান 'এ'-এতেই টিকে রয়েছেন এবং দেশের হয়ে খেলারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন।

চলতি টুর্নামেন্টে ভারতীয় দলে অভিষেক না হলে নাসিরি তাঁর নতুন ক্লাব চেন্নাইন এফসি-তে ফিরে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে আরও পরিশ্রম করবেন বলে জানান। এই নিয়ে বলেন, "ক্লাব কেরিয়ারে বড় পরিবর্তন করেছি আমি। এত বছর ধরে নিজের শহর কলকাতায় খেলার স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম। তবে এখন অনুভব করছি যে, ‘কমফর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে এ বার আমার নতুন কিছু শেখার সময় এসেছে। প্রথমবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা কিছুটা কঠিন, তবে আমি কঠোর পরিশ্রম ও নিজেকে উন্নত করার প্রতি বেশি মননিবেশ করেছি”।

ক্লাব ফুটবলে তাঁর লক্ষ্য, "আরও বেশি গোল করতে হবে, আরও বেশি অ্যাসিস্ট দিতে হবে এবং ক্লাব পর্যায়ে ভাল পারফরম্যান্স দেখাতে হবে যাতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে আরও বেশি সুযোগ পাই," বলেন নাসিরি।

আগামী সোমবার হায়দরাবাদের জিএমসি বালাযোগী অ্যাথলেটিক স্টেডিয়ামে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের শেষ ম্যাচে সিরিয়ার মুখোমুখি হবে ভারত। সেই ম্যাচে নিশ্চয়ই কিয়ান নাসিরির অভিষেকের আশায় বসে থাকবেন বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা। ম্যাচটি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হবে এবং এটি সরাসরি স্পোর্টস ১৮ ৩-এ সম্প্রচারিত হবে এবং জিও সিনেমায় লাইভ স্ট্রিমিং করা হবে।