ভারতীয় ফুটবলে এখন তিনিই সবচেয়ে চর্চিত চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। এটা অবশ্য নতুন নয়। এর আগেও যে বিদেশিরা ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে এসেছেন, তাঁরা নানা সময়ে, নানা ভাবে সারা দেশের ফুটবল মহলে বিভিন্ন চর্চায় এমনকী, বিতর্কেও উঠে এসেছেন। স্টিমাচও সেই পথেই পা বাড়িয়েছেন।

চার বছর আগে, ২০১৯-এর মে মাসে এএফসি এশিয়ান কাপের পর যখন ভারতীয় দলের দায়িত্ব নেন তিনি, তখন থেকে শুরু করে নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছে ক্রোয়েশিয়ার এই প্রাক্তন বিশ্বকাপারকে। কখনও ব্যর্থতা, কখনও সাফল্য। সাফল্যের সময় নৈঃশব্দ, ব্যর্থতার সময় সমালোচনার ঝড়। ভারতীয় ফুটবলের কোচেদের ক্ষেত্রে যা ঘটে এসেছে এতদিন। কিন্তু ইগর স্টিমাচ বোধহয় একটু অন্য ধাঁচের।

চলতি বছরে ভারত যখন ১১টি ম্যাচ খেলে ন’টিতে জিতেছে এবং দু’টিতে ড্র করেছে, তখন স্টিমাচকে বোধহয় আর সন্দেহের চোখে দেখছেন না ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা। কারণ, এই বছরে এখন পর্যন্ত হারের মুখ দেখেনি তাঁর প্রশিক্ষণাধীন ভারত। টানা আটটি ম্যাচে গোল না খাওয়ার পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্বে কুয়েতের বিরুদ্ধে গোল খান সুনীলরা, তাও আত্মঘাতী গোল। এমন ধারাবাহিকতা অনেকদিন দেখেনি ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা। সে, দেশের মাটিতেই হোক বা বিদেশে। তাই অনেকেরই মনে হচ্ছে, স্টিমাচ হয়তো কঠিন সময়টা পেরিয়ে এসেছেন।

ভারতীয় দলের বিদেশী কোচেদের এতদিন একটা ‘হেডমাস্টার’ সুলভ ইমেজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। তাঁরা গুরুগম্ভীর থাকতে ভালবাসতেন। বেশি কথা বলতে পছন্দ করতেন না। অনুশীলনের মাঠে খেলোয়াড়দের সঙ্গে বেশি কথা বলতেন না। সহকারীদের বলে দিতেন কী কী করতে হবে, সেই অনুযায়ী সহকারী কোচেরা খেলোয়াড়দের নির্দেশ দিতেন। হেড কোচ প্রধান শিক্ষকের মতোই পুরো ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করতেন।

প্রাক্তন ফুটবলারদের কাছেও শোনা গিয়েছে, ভারতীয় দলের বিদেশী কোচেদের তাঁরা অনেকেই ভয় পেতেন। কখন যে কী ভাবে তাঁর রোষানলে পড়ে যাবেন, তার কোনও ঠিক ছিল না। তাই অনেকেই হেড কোচেদের একটু এড়িয়েই চলতেন। কিন্তু এখনকার ফুটবলাররা স্টিমাচকে নিয়ে সম্পুর্ণ উল্টো কথা বলেন। তিনি নাকি দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনেক খোলাখুলি, বন্ধুদের মতো মেলামেশা করেন, অনুশীলনে সরাসরি খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলেন, কার কী সমস্যা হচ্ছে, তা নিজেই শোনেন এবং নিজেই তার সমাধান করেন।

কিন্তু স্টিমাচ নিজে এই প্রসঙ্গে কী বলেন? তাঁর বক্তব্য, “আমি ওদের বাবার মতো হয়ে উঠতে চেষ্টা করি। ওদের পরামর্শ দিই, ফুটবলার হিসেবে ও মানুষ হিসেবে উন্নত হয়ে উঠতে সাহায্য করি। ওদের বন্ধুও হয়ে উঠতে চাই। কিন্তু সেটা একটা সীমা পর্যন্ত। সেই সীমা অতিক্রম করতে চাই না। সে জন্যই কখনও ওদের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হয়ে উঠতে চাই না আমি। আমি সবসময়ই হাসিমুখে থাকি। কিন্তু সেটাও একটা সীমা পর্যন্ত। যদি দেখি কারও কমিটমেন্টের স্তর কমে যাচ্ছে, তাকে আমি কখনওই দলে রাখতে চাইব না।” হিরো আইএসএলের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ‘ইন দ্য স্ট্যান্ডস’ শোয়ে তাঁর এক্সক্লুসিভ সাক্ষৎকারে এই কথাগুলি বলেন স্টিমাচ।

বড় চ্যালেঞ্জ নিতে ভারতে

সেই জন্যই বোধহয় ভারতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে অনেক ভাবনাচিন্তা ও গবেষণা করেছিলেন স্টিমাচ। নিজেই সে কথা স্বীকার করে এই সাক্ষাৎকারে বলেন, “প্রথম যখন ভারতীয় ফেডারেশনের কাছ থেকে কোচ হওয়ার প্রস্তাবটা পাই, তখন প্রথমেই মনে হয়েছিল, ভারতে আবার ফুটবল হয় ঠিকমতো? বিশ্ব ফুটবলের বুঝতে পারলাম, ওখানে কিছু একটা চলছে, যাতে ফুটবলের ভাল হতে পারে। আসলে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। তৈরি দল, তৈরি ক্লাবের দায়িত্ব নেওয়াটা অনেক সোজা। কিন্তু এই দায়িত্বটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া ওটাই ছিল আমার প্রথম প্রস্তাব। তাই হাতছাড়া করিনি। এখানে ইন্টারভিউ দিতে আসি। আমার কথাবার্তা টেকনিক্যাল কমিটির পছন্দও হয়। এভাবেই আমার এখানকার সফর শুরু হয়।”

তিনি যে ভারতীয় ফুটবলকে শুধু উন্নত জায়গায় নিয়ে এসেছেন, তা নয়, বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত উন্নতিতেও তাঁদের সাহায্য করেন। যেমন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, সহাল আব্দুল সামাদ,অনিরুদ্ধ থাপা, আকাশ মিশ্র এবং আরও অনেককে তিনি অনেকটা পথ হাত ধরে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন, যেখানে অনেকেই আসার স্বপ্ন দেখেও পৌঁছতে পারেননি। তাঁরা এখন নিজেদের ক্লাব তথা জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড়। তাঁদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশলেও যে সবসময়ই একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলেন, তা তো তাঁর কথাতেই বোঝা গিয়েছে।

আসলে যে দেশ থেকে এসেছেন তিনি, যে দেশের জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন তিনি, সেই যুগোস্লাভিয়া ও ক্রোয়েশিয়ায় বরাবরই কঠোর অনুশাসনের মধ্যে থেকে ফুটবল খেলেছেন। সেখানকার ফুটবলারদের আগ্রাসী মনোভাবও তাঁর মধ্যে রয়েছে ভরপুর। এই মনোভাবটাই ক্রমশ ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যেও আনতে চাইছেন স্টিমাচ। আধুনিক ফুটবলে আগ্রাসনের ভূমিকাও যে যথেষ্ট, তা আন্তর্জাতিক ফুটবল বিশ্লেষকেরা বেশিরভাগই স্বীকার করেন। আগ্রাসন না থাকলে যে ফুটবল মাঠে সফল হওয়া যায় না, আধুনিক ফুটবলে এটা এখন খুব প্রচলিত ধারণা। সেই ধারণাটাই ভারতীয় শিবিরে আনতে চান স্টিমাচ এবং এই কাজে তিনি অনেকটাই সফল হয়েছেন বলে মনে হয়।

কঠিন লড়াইয়ের পর সাফল্য

যুগোস্লাভিয়া ভেঙেই পরবর্তী কালে তৈরি হয় ক্রোয়েশিয়া। ফলে যুগোস্লাভিয়ার সংস্কৃতিই রয়ে যায় নতুন এই দেশের মানুষদের মধ্যে। ১৮ বছর বয়সে ইগর স্টিমাচ এই যুগোস্লাভিয়ারই ক্লাব হাদযুক স্প্লিটের হয়ে ফুটবল জীবন শুরু করেন। সে সময়ের কথা স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে স্টিমাচ বলেন, “সেই সময়ে আমাদের দেশের নিয়ম ছিল ২৮ বছর বয়স না হওয়ার পর্যন্ত সে দেশের কোনও তরুণ অন্য দেশে যেতে পারবে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, জাতীয় দলে ঢোকা কতটা কঠিন ছিল সেই সময়। দুর্দান্ত দক্ষতা ও সক্ষমতা না থাকলে সেরাদের দলে থাকা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু আমার সেই সুযোগ এসেছিল। ১৬ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসি হাজদুক স্প্লিটে। তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল অ্যাকাডেমি ছিল এটি”।

পরবর্তীকালে এই ক্লাবের হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলেন স্টিমাচ। অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপেও যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সেবার ব্রাজিল, পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানির মতো দেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয় তারা। সেই দলের ডিফেন্ডার হিসেবে খেললেও স্টিমাচ সেই বিশ্বকাপে দু’টি গোলও করেন। একটি গ্রুপ পর্বে ও অন্যটি সেমিফাইনালে। “তার পর থেকে আট-ন’বছর লেগে যায় আমার স্বপ্ন পূরণ হতে। এই কয়েক বছরে কত যে আত্মত্যাগ করেছি, কত যে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, চ্যালেঞ্জ, অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়াই করেছি, তার কোনও হিসেব নেই”, বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন ভারতীয় দলের কোচ।

১৯৯১-৯২ মরশুমে তাঁর নেতৃত্বে স্প্লিট ঘরোয়া ফুটবলে দ্বিমুকুট জেতে—ক্রোয়েশিয়ান লিগ ও যুগোস্লাভ কাপ। ক্লাবের ইতিহাসে সেই প্রথম একই মরশুমে জোড়া খেতাব জয়। কিন্তু তখন নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল স্টিমাচের। তাই ইংল্যান্ডের ডার্বি কাউন্টিতে সই করেন। সে বছরই টানা ২০টি ম্যাচে অপরাজিত থেকে ডার্বি কাউন্টি প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেয় এবং স্টিমাচের ভাগ্যে জুটল আরও সন্মান, কোনও প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবের প্রথম বিদেশী অধিনায়কের তকমা। এখানেই শেষ নয়, ডার্বি কাউন্টির সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের তালিকাতেও উঠে গেল তাঁর নাম। ডার্বি কাউন্টির ঘরের মাঠ, প্রাইড পার্ক স্টেডিয়ামে, যে পানশালা রয়েছে, তার নাম, ‘ইগর’স বার’। বুঝতেই পারছেন, কার নামে নামাঙ্কিত সেই পানশালা। এর চেয়ে বড় গর্বের বিষয় আর কীই বা হতে পারে?

স্বপ্নপূরণ!

অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে যুগোস্লাভিয়া যে ফুটবল প্রজন্ম আবিষ্কার করেছিল, ক্রমশ সেই প্রজন্মই ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার মেরুদন্ডে পরিণত হয়। ১৯৯৮-এর সেই দলে দাভর সুকের, রবার্ট প্রসিনেকি, ভনিমির বোবান, সিলভিও মারিচের সঙ্গে ছিলেন ইগর স্টিমাচও। জামাইকা, জাপান, রোমানিয়া, জার্মানিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে যায় তারা। তবে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে বিশ্বের তৃতীয় সেরার খেতাব পান স্টিমাচরা। সেই সাফল্যই ক্রোয়েশিয়ার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফুটবল নিয়ে আগ্রহকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে এবং স্টিমাচের মতো সে বারের বিশ্বকাপাররা হয়ে যান কিংবদন্তি।

সেই কিংবদন্তিই এখন ভারতীয় ফুটবল দলের ‘বস্’!এটা ভাবতে অনেকেরই অবাক লাগে ঠিকই। কিন্তু এটাই সত্যি। তাই ভারতীয় দলের ফুটবলাররাও সহজেই তাঁদের কোচের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পান। এমন একটা জায়গায় পৌঁছে, তার পরে সেখান থেকে সুনীল ছেত্রীদের শিবিরে এসেছেন স্টিমাচ, যে জায়গাটা আর যাই হোক, হেলাফেলা করার মতো নয়।

জানুয়ারির পর কী?

এখন তাঁর সামনে আরও একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। এ বার কোচ হিসেবে। ভারতের মতো দেশকে এশিয়ার ফুটবলে উজ্জ্বল করে তোলা। সেই লক্ষ্যেই আপাতত এগিয়ে চলেছেন তিনি। অক্টোবরে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে যে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি হয়েছে স্টিমাচের, সেই অনুযায়ী, তিনি এশিয়ান কাপের শেষ পর্যন্ত দলের দায়িত্বে রয়েছেন। জানুয়ারিতে কাতারে এশিয়ান কাপে ভারত কেমন ফল করবে, তার ওপর নির্ভর করবে তাঁর ভবিষ্যৎ। এখন তাই তার ওপারে আর কিছু ভাবছেন না তিনি।

এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “জানুয়ারিতে এশিয়ান কাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি ফ্রি এজেন্ট হয়ে যাব। ওই সময়টা সারা বিশ্বে মরশুমের শেষ পর্যায়। আমাকে হয়তো দু-তিন মাস বসে থাকতে হবে নতুন কাজের জন্য। সে দেখা যাবে। কিন্তু সে সব নিয়ে আমি ভাবছিই না। আমি এখন পুরোপুরি এশিয়ান কাপে মনোনিবেশ করতে চাই”। তবে সবকিছু ভালয় ভালয় মিটলে ভারতের কোচ হিসেবে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধিতেও আপত্তি নেই তাঁর। এই ব্যাপারে তাঁর স্পষ্ট কথা, “আমি কখনও বলিনি যে আমি ভারতে থাকতে চাই না। আমার চুক্তির মেয়াদ ফুরনোর সময় এসে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সময়টা এখন ভাল যাচ্ছে। আশা করি, আমাদের দল আরও কয়েকটা ভাল জয় পাবে এবং আরও কয়েকটা ভাল ম্যাচ খেলবে”।

ইগর স্টিমাচের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেখুন নীচে