চলে গেলেন ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি সুবিমল গোস্বামী, ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীরা যাঁকে চূনী গোস্বামী নামেই বেশি চেনেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ভারতের হয়ে প্রায় ৫০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ক্লাব ফুটবলে সারা জীবনই ছিলেন মোহনবাগানে। অন্য কোনও ক্লাব থেকে বহুবার প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু মোহনবাগান ছেড়ে যাননি কখনও। তাঁর এই অবদানের জন্যই ক্লাব তাঁকে ২০০৫ সালে মোহনবাগান রত্ন সম্মান দেয়। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী ও অর্জুন সম্মানেও ভূষিত করে।

ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের চার ফুটবলারকে সেরা কিংবদন্তি বলা হয়ে থাকে। তাঁরা হলেন পিকে ব্যানার্জি, শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামী ও তুলসীদাস বলরাম। এই চার জনের মধ্যে প্রথম তিনজনই চলে গেলেন। জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার কলকাতায় নিজের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন, বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তির পরেও ফের হৃদরোগে আক্রান্ত হন । তার পর আর বাঁচানো যায়নি তাঁকে।

গত ২০ মার্চ প্রয়াত হয়েছিলেন ভারতীয় ফুটবলের আর এক কিংবদন্তি পিকে ব্যানার্জি। পরম বন্ধু ছিলেন চূনীর। সেই শোকই বোধহয় ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিয়েছিল তাঁকে। শেষ পর্যন্ত আর লড়াই করতে পারলেন না। বন্ধু পিকে-র পথই অনুসরণ করলেন চুনীও।

ফুটবলজীবনে বহু সাফল্যে পেয়েছেন তিনি। সেরাটা ছিল এশিয়ান গেমসে সোনাজয়। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৬২ সালে জাকার্তায় তাঁর নেতৃত্বে সোনা পায় ভারতীয় দল। ১৯৬৪-তে তেল আভিভে এশিয়া কাপে সোনাজয়ী দলেরও অধিনায়ক ছিলেন তিনি। সে বছর মারডেকা কাপেও রানার্স হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দল। ১৯৫৬ সালে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে প্রথম মাঠে নামা তাঁর। চিনের অলিম্পিক দলের বিরুদ্ধে ভারত যে ম্যাচে ১-০ গোলে জিতেছিল, সেই ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল চূনীর। এর পরে অলিম্পিক্স, এশিয়ান গেমস, এশিয়া কাপ ও মারডেকা কাপে ভারতের হয়ে ৫০টি ম্যাচ খেলেন এই কিংবদন্তি স্ট্রাইকার। এর মধ্যে ফিফা স্বীকৃত ম্যাচের সংখ্যা ৩২। আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের শেষ বছরেই সবচেয়ে বেশি ৯টি ফিফা স্বীকৃত ম্যাচ খেলেন তিনি, যাতে তিনটি গোল পান যথাক্রমে এশিয়ান কাপে হংকং-এর বিরুদ্ধে এবং মারডেকা কাপে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে।

১৯৩৮ সালে অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত কিশোরগঞ্জে জন্ম নেন তিনি। ১৯৪৬-এ আট বছর বয়সে মোহনবাগান জুনিয়র দলে যোগ দেন  তিনি। ১৯৫৪ পর্যন্ত জুনিয়র দলে খেলেছিলেন তিনি। পরে সিনিয়র গ্রুপে তাঁকে নেওয়া হয়। ১৯৬৮ পর্যন্ত টানা মোহনবাগানেই খেলেন তিনি। তাঁর সময়ে ন’বার কলকাতা লিগ জেতে মোহনবাগান। এ ছাড়া পাঁচবার ডুরান্ড কাপ, তিনবার রোভার্স কাপ, ছ’বার আইএফএ শিল্ডজয়ী দলেও ছিলেন তিনি। শোনা যায় সেই সময় অন্য ক্লাব তো বটেই, এমনকী বিদেশী ক্লাব থেকেও প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মোহনবাগান ছেড়ে যাননি কোনও দিন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪—টানা পাঁচ বছর ক্লাবের ক্যাপ্টেনও ছিলেন তিনি।

২২ বছর একই ক্লাবের ছত্রছায়ায় থেকে একেবারে মোহনবাগানের ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫-এ মোহনবাগান রত্ন সম্মান দেওয়া হয় তাঁকে। ক্লাবে যারা চিরস্মরণীয় অবদান রেখে গিয়েছেন, তাঁদেরই এই সম্মান দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালে অর্জুন ও ১৯৮৩ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে।

ফুটবলের পাশাপাশি সফল ভাবে ক্রিকেটও খেলতে চুনী। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফিও খেলেছেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান ও মিডিয়াম পেসার হিসেবে। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি ক্রিকেটে মন দেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭২-এ রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে উঠেছিল বাংলা। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৩—এই এগারো বছরে তিনি ৪৬টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১৫৯২ রান করেন ও ৪৭ উইকেট পান। এ ছাড়া হকি, টেনিসও খেলতেন নিয়মিত। একটি বাংলা ছবিতে অভিনয়ও করতে দেখা যায় তাঁকে। ২০০৫-এ হয়েছিলেন কলকাতার শেরিফ।  খেলোয়াড় জীবন শেষ করার পরে নিয়মিত ফুটবল ও ক্রিকেটের বিশ্লেষক ও ধারাভাষ্যকারের ভূমিকাও পালন করেছেন দীর্ঘদিন। এমন বৈচিত্রময় জীবন শেষ হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। বেশ কিছু দিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভোগার পরে তাঁর জীবনের লড়াইয়ে শেষ বাঁশি বেজে গেল বৃহস্পতিবার।

তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ আইএসএল পরিবার এবং তাঁর পরিবারের প্রতি রইল আমাদের সমবেদনা।