টানা চারটি ম্যাচে অপরাজিত থাকার পরে আরব সাগরের তীরে হোঁচট খেল এটিকে মোহনবাগান। রবিবার এফসি গোয়ার কাছে কার্যত নাস্তানাবুদ হয়ে হার মানতে হল তাদের। গোয়ার ফতোরদায় তাদের ঘরের মাঠে এ দিন ৩-০-য় জেতে এফসি গোয়া। হিরো আইএসএলে এই প্রথম সবুজ-মেরুন ব্রিগেডের বিরুদ্ধে জয় পেল তারা। এই জয়ের ফলে এফসি গোয়া উঠে এল লিগ টেবলের তিন নম্বরে ও এটিকে মোহনবাগানকে নেমে যেতে হল ছয়ে।

প্রথমার্ধে গোয়ার দলকে ঠেকিয়ে রাখেন সবুজ-মেরুন গোলকিপার বিশাল কয়েথ। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আর আলভারো ভাস্কেজদের ঠেকিয়ে রাখেতে পারেননি তিনি। দলের মাঝমাঠ ও রক্ষণের দুর্বলতার খেসারত দিতে হয় তাঁকে। দ্বিতীয়ার্ধে ৩২ মিনিটের মধ্যে মেঘালয়ের ডিফেন্ডার আইবান ডোলিং, সিরিয়ান ডিফেন্ডার মোহাম্মদ ফারেস ও মরক্কোর মিডফিল্ডার নোয়া সাদাউই তিনটি গোল করে দলকে দাপুটে জয় এনে দেন। যে এটিকে মোহনবাগান এতদিন তাদের আক্রমণের জন্য প্রশংসা কুড়োচ্ছিল, সেই দল এ দিন সারা ম্যাচে একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি (নীচে পরিসংখ্যান দেখুন)! অথচ এফসি গোয়ার আটটি শট গোলমুখী ছিল।

কথায় বলে সকাল দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। এ দিন সবুজ-মেরুন ব্রিগেডের ক্ষেত্রে তেমনই হয়েছে। দশ দিন আগেই নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে যে দাপুটে এটিকে মোহনবাগানকে দেখা গিয়েছিল, সেই দলের এগারোজনকেই এ দিন ফতোরদায় লড়াই শুরু করতে দেখা যায়। কিন্তু ছিল না সেই দাপট। শুরু থেকেই হোম টিম কোণঠাসা করে দেয় তাদের। প্রথম সাত মিনিটের মধ্যেই আলভারো ভাস্কেজ, ইকের গুয়ারেতজেনা, এডু বেদিয়াদের চার-চারটি অবধারিত গোলের শট বাঁচিয়ে দলকে বিপন্মুক্ত করেন সবুজ-মেরুন গোলকিপার বিশাল কয়েথ। তখনই মনে হতে শুরু করে দিনটা আজ হুগো বুমৌস, দিনিত্রিয়স পেট্রাটসদের নয়।

সবুজ-মেরুন রক্ষণের বেহাল দশা কাজে লাগিয়ে এফসি গোয়া তাদের চেপে ধরে এবং ঘন ঘন আক্রমণে উঠতে থাকে। যথারীতি এটিকে মোহনবাগানের মাঝমাঠ ও রক্ষণে প্রচুর ফাঁকা জায়গা দেখা যায়, যা কাজে লাগিয়ে আক্রমণ শুরু করেন এফসি গোয়ার ফুটবলাররা। প্রথম ১৫ মিনিটে সবুজ-মেরুন বাহিনীর আক্রমণ বিভাগে দু-একবারের বেশি বল যেতেই দেননি বেদিয়ারা। ২২ মিনিটের মাথায় গোয়ার ডিফেন্ডার আনোয়ার আলি অফ সাইড থাকায় তাঁর হেডের গোল বাতিল হয়ে যায়।

ম্যাচের বয়স বাড়তে শুরু করলে হুয়ান ফেরান্দোর দলের রক্ষণ কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ঠিকই, কিন্তু আক্রমণে উঠতে পারছিল না তারা। আসলে মাঝমাঠের দুই প্রধান কুশীলব জনি কাউকো ও হুগো বুমৌসদের সমানে নীচে নেমে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকানোর কাজ করতে হওয়ায় ফরোয়ার্ডরা তেমন সাপ্লাই পাচ্ছিলেন না। মাঝে মাঝে তারা কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠার চেষ্টা করলেও দ্রুত ট্রানজিশনের এফসি গোয়া তাদের গোল এরিয়ায় চটপট খেলোয়াড় বাড়িয়ে নেয়।

প্রথমার্ধের শেষ দিকে ভাস্কেজের ক্রস গোলের সামনে পড়লে তা বিশাল কয়েথ ও শুভাশিস বোস ক্লিয়ার করে দেন। এ বারেও তাঁরা দলকে না বাঁচালে প্রথম গোলটি হয়তো আগেই পেয়ে যেত এফসি গোয়া। এটিকে মোহনবাগানের চেনা ছন্দই যেন এ দিন উধাও হয়ে যায়। একবারও মাঝমাঠ থেকে কোনও বল আসেনি তাদের দুই উইংয়ে। সারা ম্যাচে একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি তারা। মাঝমাঠে প্রতিপক্ষের ফুটবলারদের এতটাই কড়া মার্কিংয়ে রেখেছিলেন এফসি গোয়ার খেলোয়াড়রা। গতবারের সেমিফাইনালিস্টরা গোলশূন্য অবস্থায় বিরতিতে যেতে পারার জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত তাদের গোলকিপার বিশালকে।

সবুজ-মেরুন সমর্থকেরা হয়তো ভেবেছিলেন, দ্বিতীয়ার্ধে তাঁদের প্রিয় দল কৌশল বদলে ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু তারা সেই চেষ্টা শুরুর আগেই ৫০ মিনিটের মাথায় অসাধারণ গোল করে এফসি গোয়াকে এগিয়ে দেন লেফট ব্যাক আইবান ডোলিং। আনোয়ার আলির পাস পেয়ে বাঁ দিকের উইং দিয়ে বল নিয়ে বাইলাইনের একেবারে সামনে দিয়ে বক্সে ঢুকে প্রায় শূন্য ডিগ্রি কোণ থেকে শট নিয়ে তা জালে জড়িয়ে দেন মেঘালয়ের ডিফেন্ডার। ২৬ বছর বয়সি ডিফেন্ডারকে সমানে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও পারেননি আশিস রাই (১-০)। এ বার আর ত্রাতা হয়ে উঠতে পারেননি বিশাল।

গোল খাওয়ার ন’মিনিট পরে ফের ধাক্কা খায় এটিকে মোহনবাগান। জনি কাউকো স্ট্রেচারে মাঠ ছাড়েন এবং তাঁর জায়গায় নামেন কার্ল ম্যাকহিউ। গোল শোধ করার জন্য ছন্দে ফেরার প্রয়োজন ছিল এটিকে মোহনবাগানের। কিন্তু তাঁদের মধ্যে সেই মরিয়া ভাব দেখা যায়নি। ৬৭ মিনিটের মাথায় কার্ল ম্যাকহিউয়ের কাছ থেকে বল পেয়ে বুমৌস গোলের সামনে চলে গেলেও ম্যাচের নায়ক আনোয়ার আলি তাঁকে আটকে দেন ও কর্নার দেন। কর্নারে হেড করে বল বারের ওপর দিয়ে পাঠিয়ে দেন ব্রেন্ডান হ্যামিল।    

এই সময়ে ক্রমশ রক্ষণাত্মক হতে শুরু করে এফসি গোয়া এবং সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ৭০ মিনিটের মাথায় দীপক টাঙরির জায়গায় আশিক কুরুনিয়ানকে নামান ফেরান্দো। দুই স্প্যানিশ মস্তিষ্কের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা কার্লোস পেনা ফের আক্রমণের ধার বাড়ানোর জন্য ভাস্কেজের জায়গায় নামান মরক্কোর মিডফিল্ডার নোয়া সাদাউইকে।

নোয়া নামার পরেই ব্যবধান বাড়িয়ে নেয় গোয়া, তবে নোয়া নন গোল করেন আর এক পরিবর্ত ডিফেন্ডার মোহাম্মদ ফারেস (২-০)। ২৫ বছর বয়সি এই সিরিয়ান ফুটবলার ৭৬ মিনিটের মাথায় যখন কর্নারে মাথায় ছুঁইয়ে জালে বল জড়ান, তখন তাঁকে পাহাড়া দিচ্ছিলেন হ্যামিল। কিন্তু ফারেস যতটা লাফিয়ে হেড করেন, হ্যামিল ততটা লাফাতে পারেননি।

তবে নোয়াও হতাশ করেননি। ফারেসের গোলের ছ’মিনিট পরেই তিনি বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শটে দলের তৃতীয় গোলটি করেন (৩-০)। ডিফেন্ডার প্রীতম কোটাল তাঁর কাছছাড়া না হলে  বোধহয় এই শট নেওয়ার সুযোগ পেতেন না। বিশাল লাফিয়ে বলে হাত লাগিয়েও গোল আটকাতে পারেননি। এই গোলের পরে লিস্টন কোলাসোকে তুলে ফারদিন আলি মোল্লা এবং আশিস রাইকে তুলে কিয়ান নাসিরিকে মাঠে নামালেও ম্যাচ ততক্ষণে কার্যত হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।

এর পরেই কর্নারে হেড করে শুভাশিস বোস গোয়ার জালে বল জড়িয়ে দিলেও তার আগে প্রীতম অবৈধভাবে ধীরজ সিংকে ঠেলায় গোয়াকে ফ্রি কিক দেন রেফারি। পাঁচ মিনিটের বাড়তি সময় পেয়েও কোনও গোল শোধ করতে পারেনি কলকাতার দল।         

এটিকে মোহনবাগান দল: বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই (কিয়ান নাসিরি), প্রীতম কোটাল (অধি), ব্রেন্ডান হ্যামিল, শুভাশিস বোস, দীপক টাঙরি (আশিক কুরুনিয়ান), জনি কাউকো (কার্ল ম্যাকহিউ), হুগো বুমৌস, মনবীর সিং, লিস্টন কোলাসো (ফারদিন আলি মোল্লা), দিমিত্রিয়স পেট্রাটস।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ         

বল পজেশন: এফসি গোয়া ৫৩% - এটিকে মোহনবাগান ৪৭%, সফল পাস: ৩৫০/৪৪৬ (৭৮%) - ২৯১/৪০০ (৭৩%), গোলে শট: ৮-০, ফাউল: ১১-৯, সেভ: ০-৪, ইন্টারসেপশন: ২০-১৩, কর্নার: ৪-৪, হলুদ কার্ড: ৩-৪, ম্যাচের হিরো: আনোয়ার আলি।