অসাধারণ কৌশলী ও হিসেবি ফুটবল খেলল এফসি গোয়া। আর সেই জালেই আটক হয়ে মাত্র এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে হল এশিয়ার অন্যতম সেরা ক্লাব কাতারের আল রাইয়ানকে। এই মহাদেশের সবচেয়ে বড় ক্লাব-লিগ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অভিষেক ম্যাচ ড্র রেখে তা স্মরণীয় করে রাখলেন এডু বেদিয়ারা। আল রাইয়ানের মতো কঠিন প্রতিপক্ষকে গোলশূন্য ড্রয়ে রুখে দিয়ে তাদের কাছ থেকে এক পয়েন্ট ছিনিয়ে নিলেন তাঁরা।

এই প্রথম কোনও ভারতীয় দল এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মূলপর্বে খেলছে। যা এ দেশের ফুটবলে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। শুরুটা যে ভাবে করল গোয়ার ক্লাবটি, তাতে ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা গর্বিত হতেই পারেন। বুধবার গোয়ার ফতোরদায় জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে নিজেরা গোল করতে না পারলেও প্রতিপক্ষের বিপজ্জনক ফরোয়ার্ডদেরও গোল করতে দিলেন না ইভান গঞ্জালেস, জেমস ডোনাচিরা।

রক্ষণে বড় চেহারার বিদেশিদের যাতে রাখা যায়, সে জন্য আলবার্তো নগুয়েরা, ইগর অ্যাঙ্গুলোদের মতো গোলমেশিনদের বাদ দিয়ে দল গড়েন এফসি গোয়ার স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো। সুকৌশলী ফেরান্দোর এই সিদ্ধান্তে অনেকে অবাক হলেও তিনি যুক্তি দেন, তাঁর হাতে যে সব ফুটবলার যে অবস্থায় রয়েছেন, সেই অনুযায়ী তাঁকে বাস্তবাদী হতে হবে এবং গোল করার চেয়ে আগে গোল না খাওয়ার রাস্তা তৈরি করে রাখতে হবে।  

বুধবার ফতোরদায় তাঁদের পারফরম্যান্সে সেই পরিকল্পনার ছাপ ছিল স্পষ্ট। এই কঠিন ম্যাচ থেকে সবচেয়ে ভাল, বাস্তবসম্মত যে ফল চেয়েছিলেন ফেরান্দো, সেটাই তাঁকে দিলেন তাঁর দলের ফুটবলাররা। এ দিন শুরু থেকেই বিপক্ষকে হতাশ করার দিকে বেশি জোর দেন ডোনাচি, গঞ্জালেসরা। দুই দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডারের দুপাশে ছিলেন সেরিটন ফার্নান্ডেজ ও স্যানসন পেরেইরা। আক্রমণ বিভাগে এ দিন শুরু থেকেই দেখা যায় সুপার সাবতকমা পাওয়া তরুণ স্ট্রাইকার ঈশান পন্ডিতাকে।

প্রতিপক্ষের কোচ যেখানে পোড় খাওয়া আন্তর্জাতিক ফুটবলার ও কোচ ফ্রান্সের লরাঁ ব্লাঁ, সেখানে কৌশলের লড়াইয়ে তাঁর দলকে হারানো মোটেই সহজ ছিল না ফেরান্দোর পক্ষে। কিন্তু ম্যাচের শেষে দেখা গেল মস্তিষ্কের লড়াইয়ে জিতলেন স্প্যানিশ কোচই। তবে তাঁর পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার কৃতিত্ব অবশ্যই ফুটবলারদের।

শুরু থেকেই ইয়াসিন ব্রাহিমি, ইওহান বলিদের মারাত্মক চাপ দারুণ ভাবে সামলান তাঁরা। মুহূর্তের মধ্যে ম্যাচের ছবি পাল্টে দিতে পারেন আলজেরিয়ান উইঙ্গার ইয়াসিন ব্রাহিমি। গত মরশুমে ১৫ গোল করে কাতার লিগের যুগ্ম সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন তিনি। ২০১৯-এর আফ্রিকান নেশনস কাপজয়ী আলজেরিয়া দলের সদস্য এই ব্রাহিমি। তাঁকে অল্প জায়গা দেওয়া মানেই বিপদ।

অন্য দিকে, ইওহান বলি আর এক মারাত্মক ফুটবলার, যিনি সে দেশের সদ্য শেষ হওয়া লিগ মরশুমে ২২ ম্যাচে ১১ গোল করেছেন। তিনটি গোলে সাহায্যও করেছেন তিনি। আইভরি কোস্ট থেকে আসা এই ফুটবলারকেও নজরে রাখাই এ দিন প্রধান কাজ ছিল গোয়ার ডিফেন্ডারদের। এই দুই তারকাকে নিজেদের সেরা ছন্দে থাকতে দিলে যে সমস্যায় পড়তে হতে পারে তাঁদের, তা খুব ভাল করেই জানতেন ফেরান্দো। তাই দুই তারকাকেই নজরবন্দি করার পরিকল্পনা নেন তিনি। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কাজটা নিখুঁত ভাবে করে যান গোয়ার ডিফেন্ডাররা।

তরুণ গোলকিপার ধীরজ সিং-ও ছিলেন সদাসতর্ক। প্রথমার্ধের শুরুর দিকে একটি অসাধারণ সেভও করেন তিনি। গোলের সামনে নইফ আলহাধরামি ও ধীরজ ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে চলে আসেন। কিন্তু অসাধারণ দক্ষতায় গোল লাইন ছেড়ে বেরিয়ে এসে ছোঁ মেরে তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নেন এটিকে মোহনবাগান থেকে লিয়েনে আসা এই তরুণ গোলকিপার।

গোয়ার ডিফেন্ডারদের প্রবল বাধা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে গোলের রাস্তা তৈরির চেষ্টা করছিলেন বলি, ব্রাহিমিরা। কিন্তু এতটাই চাপের মধ্যে সারাক্ষণ থাকতে হয় তাঁদের যে, বারবার ভুল করে ফেলেন। এফসি গোয়া যে এ দিন একেবারে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে গিয়েছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, তা অধিকাংশ সময়ে তাদের ৫০ শতাংশ বল পজেশন দেখেই বোঝা যায়।

শুধু বিপক্ষকে আটকানোই যে তাদের কাজ নয়, আক্রমণে ওঠার পরিকল্পনাও তাদের আছে, তা বিরতির পাঁচ মিনিট আগেই বুঝিয়ে দেন আলেকজান্দার রোমারিও, যখন তাঁর নিখুঁত গোলমুখী দুরপাল্লার জোরালো শট সামলাতে প্রায় হিমশিম খেতে হয় আল রাইয়ানের গোলরক্ষক ফাহাদ ইউনিসকে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে একটু ওপরে উঠে খেলে আক্রমণ তৈরির চেষ্টা শুরু করতে দেখা যায় স্যানসন ও গঞ্জালেসকে। তখন আল রাইয়ানের রক্ষণকেই এফসি গোয়ার আক্রমণ সামলাতে দেখা যায়। বলি, ব্রাহিমিরা আরও হতাশ হয়ে ওঠেন এবং একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করেও তা গোলে করতে পারেননি। শেষ দশ মিনিট তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠলেও গোয়ার দল নিজেদের গোলের সামনে প্রায় দেওয়াল তুলে দেওয়ায় আর তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

এই ড্রয়ের ফলে এফসি গোয়া ও আল রাইয়ান একটি করে পয়েন্ট পেয়ে গ্রুপের তৃতীয় স্থানে রইল। ফেরান্দোর দলের পরবর্তী ম্যাচ ১৭ এপ্রিল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর আল ওয়াহদার বিরুদ্ধে, যারা বুধবার ইরানের পার্সেপলিস এফসি-র কাছে ০-১ গোলে হেরে যায়।