টালা থেকে টালিগঞ্জ, বরাহনগর থেকে বেহালা—সর্বত্র একটাই আবদার রবিবারের ডুরান্ড কাপ ফাইনালে কলকাতা ডার্বির একটা টিকিট হবে? যার কাছে সেই মহার্ঘ্য টিকিট, সে-ই একদিনের জন্য রাজা।

বহু কাল পর একটা রক্ত গরম করা ডার্বি দেখার আশায় রয়েছে বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা। সপ্তাহ তিনেক আগে যেমন দেখা গিয়েছিল কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে, সেখানেই ফের মুখোমুখি হতে চলেছে ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা দ্বৈরথের দুই যুযুধান পক্ষ।

আবার একটা কলকাতা ডার্বি। শতাধিক বর্ষের এই চিরপ্রতিদ্বন্দিতার জনপ্রিয়তা যে কোনও দিন কমবে না, তা এই ম্যাচ শুরু হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগে কলকাতার আনাচে কানাচে পাওয়া খণ্ডচিত্রগুলি দেখলেই বোঝা যায়।

চিত্র ১- ময়দানে দীর্ঘ সর্পিল লাইন। যারা দাঁড়িয়ে, তারা জানে এই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট পাওয়া অনিশ্চিত। তবু ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই দাঁড়িয়ে তারা।

চিত্র ২- সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই পোস্ট দেখা যাচ্ছে, ‘আমার কাছে ডার্বির চারটে টিকিট রয়েছে, কারও লাগলে ইনবক্স করুন’। যে বা যারা এই ধরনের পোস্ট করছে, তার ইনবক্স উপচে পড়ছে পাল্টা বার্তায়, ‘যত টাকা লাগবে দেব। কোথা থেকে কখন টিকিট নিতে হবে জানান’।

চিত্র ৩- দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্লাবের সমর্থকদের বিক্ষোভ। তারা কেন পর্যাপ্ত টিকিট পাচ্ছে না, এই প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ দুই ক্লাবের তাঁবুর সামনে। তাতেও সুরাহা হওয়ার আশা কম। কারণ, একটি টিকিটও না কি আর পড়ে নেই। সব বিক্রি হয়ে গিয়েছে।

এমন অসংখ্য ছবি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ফুটবল-মক্কার বিভিন্ন প্রান্তে। সব ওই ৯০ মিনিটের এক ফুটবল-যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। যা চিরকালীন, কালজয়ী। এ সব দেখে একটা জিনিসই বোঝা যাচ্ছে, রবিবার বিকেলে ভরে উঠবে যুবভারতীর গ্যালারি, উপছেও যেতে পারে। একদিকে ‘জয় মোহনবাগান’, অন্যদিকে ‘জয় ইস্টবেঙ্গল’ শব্দব্রহ্মে নিশ্চয়ই কেঁপে উঠবে রবিবাসরীয় কলকাতা।

ফিরছে ডার্বির চেনা মেজাজ

এ তো গেল মাঠের বাইরের কথা। যা চিরকালই একই রকম। কিন্তু মাঠের ছবিটা একই রকম থাকে না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায়। যেমন গত ৫৫ মাসে পাল্টে গিয়েছিল। এই সময়ে বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা প্রায় ভুলতে বসেছিলেন ডার্বির রণহুঙ্কার। টানা একতরফা ব্যর্থতার জ্বালায় ডার্বি থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছিলেন লাল-হলুদ জনতা। সবুজ-মেরুন সমর্থকদের কটাক্ষে জর্জরিত হয়ে নিজেদের ক্লাবকেই দোষারোপ করা শুরু করেছিলেন তাঁরা। গত ১২ অগাস্ট, দেশের স্বাধীনতা দিবসের তিন দিন আগেই যেন তাঁরা নতুন করে স্বাধীনতা ফিরে পান বহুকাঙ্খিত ডার্বি জিতে। ৫৫ মাস ধরে সহ্য করা যন্ত্রণার উপশম হয় যেন সে দিনই।

৬০ মিনিটের মাথায় অসাধারণ এক গোল করে দলকে বহু আকাঙ্খিত জয় এনে দেন ইস্টবেঙ্গলের নতুন ‘হিরো’, সুদূর তামিলনাড়ু থেকে এসে যিনি হয়ে ওঠেন লাল-হলুদ বাহিনীর নয়নের মণি। তিনি নন্দকুমার শেখর।গত জুনে যাঁকে তিন বছরের চুক্তি করে নিয়ে আসে কলকাতার ক্লাব।

সেই ডার্বির আগে ধারে ও ভারে এবং সাম্প্রতিক সাফল্যের বিচারে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিলেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রাক্তন আইএসএল চ্যাম্পিয়ন কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতের ইস্টবেঙ্গল সে দিন দেখিয়ে দেয়, বড় বড় নাম দলে থাকলেই সাফল্য আসে না। ফুটবলে পারফরম্যান্সই শেষ কথা বলে। সে দিনের পারফরম্যান্সেই চিরপ্রতিদ্বন্দীদের ছাপিয়ে গিয়ে মরশুমের প্রথম ডার্বি জিতে নেয় লাল-হলুদ বাহিনী।

রবিবার ডুরান্ড কাপের ফাইনালে সেই হারেরই বদলা নেওয়ার পালা মোহনবাগানের। ইস্টবেঙ্গলের কাছে হেরে যাদের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠাই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, সেই সবুজ-মেরুন বাহিনী ডুরান্ড কাপের গ্রুপ পর্বের গণ্ডী পেরয় নিজেদের গোলসংখ্যা ও অন্য দলের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে।তখন অবশ্য এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে ওঠার চিন্তাও ছিল সবুজ-মেরুন শিবিরে।

কিন্তু এখন আর সে চিন্তা নেই। কারণ, এএফসি কাপের খেলা আবার সেই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। তাই ফেরান্দো-বাহিনীর ফোকাস আপাতত ডুরান্ডের ফাইনালেই। মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালেই তা বুঝিয়ে দেয় তারা। ৫৫ মাস পর যেমন ইস্টবেঙ্গলের কাছে হারে গঙ্গাপাড়ের ক্লাব, তেমনই এই প্রথম মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে জয় পায় তারা। সেমিফাইনালে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে পিছিয়ে পড়েও জেতে। পরপর দুই ম্যাচে দুরন্ত জয় থেকে পাওয়া এই আত্মবিশ্বাসটাই রবিবার বদলা নিতে সাহায্য করবে তাদের?

এখনও অর্ধেক প্রস্তুত!

আত্মবিশ্বাসের স্তর বাড়তে পারে। কিন্তু দলটা কি পুরোপুরি তৈরি? এএফসি কাপের ম্যাচে সেরা পারফরম্যান্স না দেখিয়েও ঢাকা আবাহনীকে ৩-১-এ হারানোর পর মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো বলেছিলেন, তাঁর দল সবে ৫০ শতাংশ তৈরি হয়েছে। শনিবার ডুরান্ড ফাইনালের আগেও কিন্তু তাঁর মুখে প্রায় একই কথা। বললেন, “এখনও আমরা প্রায় সেই জায়গাতেই রয়েছি। নিজেদের যে ঠিকমতো তৈরি করব, সে জন্য আমরা তো ঠিকমতো অনুশীলনই করতে পারছি না। গত দশদিনে চারটে ম্যাচ খেলতে হয়েছে আমাদের। সে জন্য ম্যাচ, ম্যাচের পর রিকভারি, আবার পরের ম্যাচের প্রস্তুতি এই ভাবেই চলছি আমরা। দলের সার্বিক প্রস্তুতির সুযোগই পাচ্ছি না। এই ডুরান্ড শেষ হলে ভাবছি ফের প্রাক-মরশুম প্রস্তুতি শুরু করব”।

বড় যুদ্ধের আগে দুই দলের কোচেদের এক অপরকে দেখে নেওয়ারযে হুঙ্কার শুনতেই অভ্যস্ত জনতা, তার ছিটেফোঁটাও নেই সবুজ-মেরুন কোচের গলায়। বরং প্রতিপক্ষ সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল তিনি। আরও অবাক করে দিয়ে সাংবাদিকদের বললেন, “ডুরান্ডে সব ভাল ভাল দলের বিরুদ্ধে খেলেছি। এতে আমাদেরই ভাল হয়েছে। এ বার ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলব, ওরাও যথেষ্ট ভাল ও শক্তিশালী দল। এটাও নিজেদের উন্নত করে তোলার একটা ভাল সুযোগ”। চিরপ্রতিদ্বন্দীদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার ম্যাচে এমন নীচু স্বর, প্রতিপক্ষ সম্পর্কে এত শ্রদ্ধা, সন্মান! এগুলো শুনতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না সমর্থকদের।

কিন্ত ভারতীয় ফুটবলের দিনকাল যত পাল্টেছে, আধুনিকতা, বিশ্বায়নের ছোঁয়া যত লেগেছে এ দেশের ফুটবলে। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের কোচ, ফুটবলাররা ক্রমশ ভীড় বাড়াচ্ছেন, ততই যেন ডার্বির মাঠে লড়াইয়ের মেজাজেও পরিবর্তন এসেছে।

না হলে সপ্তাহ তিনেক আগেই যাদের হারিয়েছেন, সেই মোহনবাগান সম্পর্কেও প্রায় একই রকম শ্রদ্ধা ও সমীহ দেখান লাল-হলুদ ব্রিগেডের স্প্যানিশ কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত?

সমীহ, সন্মানে মাথা নত

২০১৮-য় প্রধান কোচ হিসেবে বেঙ্গালুরু এফসি-র দায়িত্ব নিয়ে প্রথম মরশুমেই (২০১৮-১৯) যিনি দলকে প্রথম আইএসএল চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন, সেই কুয়াদ্রাতই আবার ইস্টবেঙ্গলের গৌরব ফিরিয়ে এনেছেন। তবু ডুরান্ড ফাইনালে মরশুমের দ্বিতীয় ডার্বির আগে লাল-হলুদ কোচের কথাতেও সেই আগুননেই!

কুয়াদ্রাত বললেন, “আমার দলে এখনও অনেক সমস্যা রয়েছে। নতুন খেলোয়াড়দের নিয়ে নতুন একটা প্রকল্পে হাত দিয়েছি আমি। ভবিষ্যতের জন্য ভাল কিছু করাই লক্ষ্য। যেটা আমার ভাল লাগছে, তা হল দল একটা প্রতিযোগিতার জায়গায় চলে এসেছে, যদিও সেটা এই প্রকল্পের প্রথম ধাপ। আমরা ভাল খেলছি। ওরা (মোহনবাগান) আমাদের কাছে হারার পরের চারটে ম্যাচ খেলে চারটেই জিতেছে। ওদের মধ্যে একটা ইতিবাচক ব্যাপার আছে। যতই হোক, ওরা নেপাল, বাংলাদেশ এবং ভারতের চ্যাম্পিয়নদেরও (মুম্বই সিটি এফসি) হারিয়েছে। ওরা মানসিক ও টেকনিকের দিক থেকে নিজেদের উন্নত করে তুলেছে। তবে প্রতি ম্যাচই ওরা খুব কম ব্যবধানে জিতেছে। আমরা জেতার জন্য আমাদের অস্ত্রগুলো প্রয়োগ করার চেষ্টা করব”।

ডুরান্ড কাপের শুরুতে যে ফাইনালে ওঠার কথা ভাবতেই পারেননি, তাও স্বীকার করে নেন কুয়াদ্রাত। বলেন, “সব ম্যাচই জিততে চেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু ফাইনালে ওঠার কথা সত্যিই ভাবিনি। কারণ, এর জন্য আমাদের অনেক কঠিন কঠিন বাধা ও মুহূর্ত পেরিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল। দল যে তার করতে পেরেছে, সে জন্য আমি গর্বিত”। দুই কোচের এমন বিনয়ী ভাষণ শুনে একবারও মনে হওয়ার উপায় নেই যে, ডার্বির চেনা মেজাজ ফিরে এসেছে।

তা সত্ত্বেও রবিবারের ফাইনালে তো বটেই, সারা মরশুম ধরে এই চেনা দাপট বজায় থাকবে, এমনই আশায় বুক বাঁধছেন লাল-হলুদ সমর্থকেরা। আরও ডার্বি হবে এই মরশুমে। আইএসএলেই তারা একে অপরের মুখোমুখি হবে দু-দু’বার। সুপার কাপেও হতে পারে। কিন্তু এতদিন যাদের বিরুদ্ধে কোণঠাসা হয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে, সেই মোহনবাগানকে হারিয়ে ডুরান্ড জয় করার তৃপ্তিই আলাদা। তাই যে কোনও মূল্যে ১৩২ বছরের এই টুর্নামেন্টের ট্রফি ফের জিততে চায় তারা।

ইতিহাসেও লড়াইয়ের ইঙ্গিত

ষোলো বার করে ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুই ক্লাবই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে দুই প্রধান মুখোমুখি হয়েছে এগারোবার। পাঁচবার জিতেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী ও চারবার লাল-হলুদ ব্রিগেড। দু’বার অমীমাংসিত ভাবে ফাইনাল শেষ হওয়ায় যুগ্মজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয় দুই দলকেই। এ বারও ঐতিহ্যবাহী ডুরান্ড কাপের ফাইনালে আবার সেই কালজয়ী ফুটবল-দ্বৈরথ। ইতিহাসও বলছে রবিবারের ফাইনালে উত্তেজনা উপছে পড়বে। হয়তো টাই ব্রেকারেও হতে পারে নিষ্পত্তি। তবে দুই পক্ষই ৯০ মিনিটের মধ্যেই ফয়সালা করে মাঠ ছাড়তে চান।
টাই ব্রেকারের জুয়ায় নিজেদের জড়াতে চান না।

একদিকে যখন জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকু, দিমিত্রিয়স পেট্রাটসদের সঙ্গে লাল-হলুদ রক্ষণের তুমুল লড়াই দেখা যাবে। অন্যদিকে তখন হাভিয়ে সিভেরিও, বোরহা হেরেরা, সল ক্রেসপোদের আটকাতে তৎপর থাকবে সবুজ-মেরুন ডিফেন্স। দুই দলের ভারতীয় তারকারা অনিরুদ্ধ থাপা, আশিস রাই, মহেশ সিং, নন্দকুমার শেখর, সহাল আব্দুল সামাদ, আশিক কুরুনিয়ানরাও এই বড় মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রবিবার শেষ হাসি কারা হাসবে, সে তো সময়ই জানে। কিন্তু এই দ্বৈরথ নিয়ে যে জল্পনার জাল বুনছে বাংলার দ্বিখণ্ডিত ফুটবল মহল, তার প্রভাব যে যুবভারতীর গ্যালারিতেই দেখা যাবে, তা জানতে কারও বাকি নেই।

ডুরান্ড কাপ, ২০২৩ ফাইনাল

ম্যাচ- ইস্টবেঙ্গল এফসি বনাম মোহনবাগান এসজি
ভেনু- যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা
কিক অফ- ৩১ অগাস্ট, বিকেল ৪.০০
সম্প্রচার- সোনি টেন ২, সোনি লিভ অ্যাপ