মহমেডান এসসি-র বিরুদ্ধে প্রায় ৭৫ মিনিট ন’জনে মিলে লড়াই করার পর গোলশূন্য ড্র করাটা যে ইস্টবেঙ্গলের নৈতিক জয়, শনিবারের ম্যাচের দুই যুযুধান দলের কোচই এই ব্যাপারে একমত হয়েছেন। ইস্টবেঙ্গল কোচ অস্কার ব্রুজোন এবং মহমেডান কোচ আন্দ্রেই চেরনিশভ এই কোনও দ্বিমত পোষণ করেননি। তবে এই লড়াই যে তাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, তা নির্দ্বিধায় বলছেন ইস্টবেঙ্গলের তারকা ফুটবলাররা।

শনিবার প্রথমার্ধে দুই নির্ভরযোগ্য উইঙ্গার নন্দকুমার শেকর ও নাওরেম মহেশ সিং লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যাওয়ার পর প্রায় ৭৫ মিনিট (বাড়তি সময়-সহ) ন’জনে মিলে লড়াই করে দুর্দান্ত রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে ইস্টবেঙ্গল এবং নিজেদের গোল অক্ষত রাখে। চলতি লিগের প্রথম পয়েন্ট তারা অর্জন করে নেয় এই ম্যাচেই। পুরো দল নিয়ে মহমেডানের নাগাড়ে আক্রমণের পরেও নিজেদের গোলের দরজা খুলতে দেননি লাল-হলুদ ফুটবলাররা।

আইএসএলে যে চারটি ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের কোনও খেলোয়াড় স্কোর সমান থাকাকালীন লাল কার্ড দেখেছেন, সেই ম্যাচগুলিতে কখনও তারা হারেনি। লড়াইয়ের এমন দৃষ্টান্ত সাধারণত পাওয়া যায় না। চলতি মরশুমে ইস্টবেঙ্গলের চারজন খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখেছেন। ১৪ সেপ্টেম্বর বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে ৮৭ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন ডিফেন্ডার লাল চুঙনুঙ্গা। অক্টোবরের ২২ তারিখে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে ৭৬ তম মিনিটে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখেন আর এক ডিফেন্ডার প্রভাত লাকরা।

শনিবারের ম্যাচে ২৮ মিনিটের মাথায় অমরজিৎ সিং কিয়ামের মুখে হাত চালানোয় ও কটূক্তি করার কারণে প্রথমে লাল কার্ড দেখেন নন্দকুমার শেকর। রেফারির এই সিদ্ধান্তের ফলে মেজাজ হারিয়ে অসংযত আচরণ করায় মহেশ সিং নাওরেমকে দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখান রেফারি। আইএসএলের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও দলকে প্রথমার্ধেই জোড়া লাল কার্ড দেখতে হয়।

গত চার মরশুম মিলিয়ে তাদের মোট লাল কার্ডের সংখ্যা এর চেয়ে কম ছিল। ২০২০-২১ ও গত মরশুমে তাদের কোনও ফুটবলার লাল কার্ড দেখেননি। ২১-২২ ও ২২-২৩ মরশুমে যথাক্রমে একজন ও দু’জন খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখেন। অর্থাৎ, এর আগে চার মরশুমে যেখানে লাল-হলুদ বাহিনীর তিনজন লাল কার্ড দেখেন, সেখানে এই মরশুমে ইতিমধ্যেই চারজন লাল কার্ড দেখে ফেললেন।

শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সেই ম্যাচের গোলপ্রহরী প্রভসুখন গিলের কাছে দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। indiansuperleague.com কে তিনি বলেন, “ম্যাচের ২৮ মিনিটের পর থেকে ন’জনে এই লড়াই আমি কখনও ভুলব না। আর কোনও আইএসএল ম্যাচে এমন হয়েছে বলে মনে হয় না। আর কোনও লিগেও এমন হয়েছে কি না, সন্দেহ আছে। সল্ট লেক স্টেডিয়ামের মতো এত বড় মাঠে ২৮ জন মিলে একটা পয়েন্টের জন্য লড়াই করা অসাধারণ ব্যাপার। ছোট মাঠেও এমন লড়াই করা দুর্দান্ত ব্যাপার”।

এই লড়াইয়ের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে দেশের ফুটবল মহলে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই লড়াইয়ের প্রশংসা করেছেন বহু ফুটবলপ্রেমী, সমর্থকেরা। এই লড়াইয়ের কৃতিত্ব শুধু নিজেরা নেননি ইস্টবেঙ্গলের গোলকিপার। এ জন্য সমর্থকদেরও কৃতিত্ব দেন তিনি। বলেন, “যখন আমরা সে দিন বিরতিতে যাই, তখন আমাদের যে ব্যাপারটা বেশি উজ্জীবিত করে, তা ছিল, এখন পর্যন্ত লিগে আমরা একটাও জয় পাইনি। তখন আমাদের মাথায় একটাই কথা ঘুরছিল, আমাদের একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। আমরা তখন ন’জনে খেলছিলাম। কিন্তু অসাধারণ সমর্থকদের জন্য একবারও তা মনে হয়নি আমাদের। পুরো একশো মিনিট সমান ভাবে আমাদের জন্য গলা ফাটিয়েছে ওরা। আমরা সৌভাগ্যবান যে, এমন সমর্থকদের পেয়েছি”।

সতীর্থদেরও ভূয়ষী প্রশংসা করে গিল বলেন, “দ্বিতীয়ার্ধে আমাকে সে ভাবে কোনও সেভই করতে হয়নি। এর পুরো কৃতিত্ব আমাদের বাকি আট যোদ্ধার, যারা আমার সামনে থেকে সমানে লড়াই করে গিয়েছে। এই ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট অর্জন করতে পেরে আমরা খুশি। আশা করি, পরের ম্যাচগুলোতে ইস্টবেঙ্গল আরও পয়েন্ট পাওয়ার জন্য লড়াই করবে”।

দলের বাঙালি মিডফিল্ডার শৌভিক চক্রবর্তী মনে করেন, এই লড়াই-ই তাঁদের টিম স্পিরিট অনেকটা বাড়িয়ে দেবে। বলেন, “এতক্ষণ ন’জনে খেলা আমাদের কাছে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ওই পরিস্থিতিতে এক পয়েন্ট অর্জন করা বেশ কঠিন ছিল। সে জন্য ভাল লাগছে। তবে এই লড়াইয়ের ফলে আমাদের টিম স্পিরিট অবশ্যই বাড়বে। এগারোজনের বিরুদ্ধে ২৮ মিনিটের পর থেকে ন’জনে খেলা যে কত কঠিন, তা নিশ্চয়ই সবাই জানেন। এই লড়াই-ই আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেকটা বাড়িয়ে দেবে। ক্লিনশিট বজায় রাখা খুবই জরুরি ছিল। বহুদিন আমরা নিজেদের গোল অক্ষত রাখতে পারিনি”।

মাঝমাঠে শৌভিকের বিদেশী সঙ্গী সল ক্রেসপোও আত্মবিশ্বাসী। “আমরা জানি যে আমরা একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দু’জন খেলোয়াড়কে ছাড়াই পয়েন্ট অর্জন করাটা এক পয়েন্টের চেয়েও বেশি মূল্যবান। আমরা একটা দল হিসেবে, একটা পরিবারের মতো লড়াই করেছি। খুব কঠিন ছিল লড়াইটা। এ ভাবে খেলতে পারলে আমরা অনেক ম্যাচ জিততে পারব”, বলেন ক্রেসপো।

তাদের স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোন ম্যাচের পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আজকের এই এক পয়েন্টই আত্মবিশ্বাস জোগাল। আমাদের দলের ছেলেদের মানসিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তাই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি। সামনে যে অবকাশ আসছে, সেই সময়ে দলের যে সব সমস্যা আছে, সেগুলো মেরামত করাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ”।

অবকাশের পর ইস্টবেঙ্গল তাদের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামবে ২৯ নভেম্বর, নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে, ঘরের মাঠে। অর্থাৎ, সেই ম্যাচের আগে তারা প্রায় আড়াই সপ্তাহ পাবে প্রস্তুতির জন্য। এই সময়কে কাজে লাগিয়ে জয়ে ফিরতে পারবে কি না ইস্টবেঙ্গল, এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

নর্থইস্ট লিগ টেবলের তিন নম্বরে থাকা দল। গত তিন ম্যাচে অপরাজিত তারা। আটটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে জয় ও তিনটিতে ড্র করে ১২ পয়েন্ট পেয়েছে তারা। তারাই সর্বোচ্চ (১৯) গোলদাতা দল। সম্প্রতি জামশেদপুর এফসি-কে ৫-০-য় হারিয়েছে তারা। এ ছাড়াও ওডিশা এফসি ও মহমেডান এসসি-কে হারায়। ড্র করে কেরালা ব্লাস্টার্স, এফসি গোয়া ও বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে। শুধু মোহনবাগান এসজি ও চেন্নাইন এফসি হারিয়েছে তাদের। এ রকম এক ফর্মে থাকা দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের লড়াই আরও কঠিন হতে চলেছে।