ডার্বিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর দৌড় থামিয়ে ডুরান্ড কাপের শেষ চারে ইস্টবেঙ্গল এফসি
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে শেষ আটে থেকে ছিটকে দিয়ে শেষ চারে ডায়মন্ড হারবারের মুখোমুখি লাল-হলুদ বাহিনী।

গত মরশুমের ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে যেতে হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল এফসি -কে। এ বারের ডুরান্ড কাপের সেই কোয়ার্টার ফাইনালেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট -কে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে পড়ল লাল-হলুদ বাহিনী।
রবিবার সন্ধ্যায় বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে গ্রিক ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস-এর জোড়া গোলে গতবারের রানার্স আপ-দের ২-১-এ হারিয়ে শেষ চারে নিজেদের জায়গা পাকা করে ফেলল লাল-হলুদ ব্রিগেড। এ দিন প্রথমার্ধে ৩৮ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ইস্টবেঙ্গলের দিমি। বিরতির পর, ৫২ মিনিটের মাথায় ফের তাঁর গোলেই ব্যবধান দ্বিগুন হয়ে যায়। ৬৮ মিনিটের মাথায় অনিরুদ্ধ থাপা দূরপাল্লার শটে গোল করে ব্যবধান কমান। ম্যাচের শেষ দশ মিনিটে বাগান-বাহিনী সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেও তাদের সফল হতে দেয়নি তাদের তিরপ্রতিদ্বন্দ্বীরা।
বুধবার এই যুবভারতীতেই সেমিফাইনালের যুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলকে নামতে দেখা যাবে কলকাতার আর এক নবাগত দল ডায়মন্ড হারবার এফসি-কে। রবিবার বিকেলে জামশেদপুর এফসি-কে তাদেরই মাঠে ২-০-য় হারিয়ে শেষ চারে জায়গা পাকা করে ফেলেন লুকা মাজেনরা।
কলকাতার দুই প্রধানই এ দিন পূর্ণশক্তি নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। ইস্টবেঙ্গল শুরু থেকে আক্রমণাত্মক মেজাজে থাকলেও ১৫ মিনিটের মধ্যেই ধাক্কা খায় হামিদ আহদাদ চোট পেয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ায়। তৃতীয় মিনিটেই গোলের সামনে ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন হামিদ, যা হাতছাড়া হয় বিশাল কয়েথের তৎপরতায়। দশ মিনিটের মাথায় ফেরেইরার দূরপাল্লার শট তাঁর কাছে আসায় ফের সুযোগ পান হামিদ। এ বারেও সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি।
শুরু থেকেই গোলের সামনে হামিদের এই তৎপরতা প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে পারত। কিন্তু ১৫ মিনিটের মাথায় পেশীতে টান ধরায় তিনি মাঠের বাইরে চলে যান। ফলে সমস্যায় পড়ে ইস্টবেঙ্গল। তাঁর বদলে দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস মাঠে নামেন ঠিকই। কিন্তু তখনও তিনি পুরোপুরি তৈরি ছিলেন বলে মনে হয়নি। ছন্দে আসতে সময় নেন তিনি।
এ দিন দুই দলের মধ্যে লড়াই তো চলছিলই, এ ছাড়াও মাঠের মধ্যে ছোট ছোট ব্যক্তিগত দ্বৈরথও দেখা যায়। ইস্টবেঙ্গলের বাঁ উইংয়ে বিপিন সিং বনাম আশিস রাই, মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ডান উইংয়ে পাসাং দোরজির সঙ্গে লাল চুঙনুঙ্গার লড়াই, টম অলড্রেড ও হামিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা—এই ডুয়ালগুলিই জমিয়ে দেয় কলকাতা ডার্বি।
তবে প্রথম আধ ঘণ্টায় কোনও প্রবল উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা না ঘটলেও প্রতিপক্ষের ওপর বেশি চাপ বজায় রাখে ইস্টবেঙ্গল এফসি। ড্রিঙ্কস বিরতির পর জমে ওঠে নাটক এবং বক্সের মধ্যে বাড়ানো বল তাড়া করে তা গোলে ঠেলে দেন দিয়ামান্তাকস। কিন্তু সেই গোল বাতিল হয়ে যায় অফ সাইডের পতাকা ওঠায়। ড্রিঙ্কসের আগে সবুজ-মেরুন বক্সের সামনে থেকে একটি ফ্রি কিকেও গোলে বল ঠেলে দিয়েছিলেন সউল ক্রেসপো। কিন্তু বাঁশি বাজার আগেই ফ্রি কিক নিয়ে ফেলায় সেই গোলও বাতিল হয়ে যায়।
কিন্তু ৩৬ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেননি দিয়ামান্তাকস। গোলমুখী বিপিন সিংকে বক্সের মধ্যে বাধা দিয়ে প্রতিপক্ষকে পেনাল্টির সুযোগ পাইয়ে দেন আশিস রাই। সেই পোনাল্টি থেকে গোল করতে ভুল করেননি গ্রিক ফরোয়ার্ড (১-০)।
আগের দিনই বাগান-কোচ হোসে মোলিনা বলেছিলেন, এই ম্যাচে সেরা মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে দেখা যাবে না। প্রথমার্ধে সেই সবুজ-মেরুন বাহিনীকেই দেখা যায়, যারা তাদের সেরা ছন্দে ছিল না। প্রথমার্ধের শেষদিকে আপুইয়ার দূরপাল্লার শট ছাড়া তাদের গোলের সুযোগ পেতে দেখা যায়নি।
বরং ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে অনেক বেশি উজ্জীবিত লেগেছে। হামিদ মাঠের বাইরে চলে যাওয়ার পরেও যে ভাবে আগ্রাসন বজায় রেখেছিল লাল-হলুদ বাহিনী, তাতে তাদের সমর্থকদের খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। প্রথম ৪৫ মিনিটে দু’টি শট গোলে রাখে তারা, যেখানে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি।
বিরতির পর মাঠে ফিরে নিজেদের শুধরে নেওয়ার আগেই ফের ধাক্কা খায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। ম্যাচের ৫২ মিনিটের মাথায় ফের তাদের ধাক্কা দেন সেই দিয়ামান্তাকস। এ বার আর পেনাল্টি নয়, একেবারে ওপেন প্লে থেকে গোলে শট নেন তিনি, যা আলবার্তো রড্রিগেজের গায়ে লেগে গতিপথ বদলে জালে জড়িয়ে যায় (২-০)। বক্সের মধ্যে তাঁকে বল বাড়িয়েছিলেন নাওরেম মহেশ।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা দেখা যায় সবুজ-মেরুন জার্সির খেলোয়াড়দের মধ্যে। তবে ম্যাচের দ্বিতীয় গোল তাদের সেই চেষ্টায় বড়সড় হার্ডল তৈরি করে দেয়। তবে ফের চেষ্টা শুরু করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট এবং ৫৮ মিনিটের মাথায় কামিংসের গোলমুখী শট গোল লাইন সেভ করেন কেভিন সিবিল।
মনবীর সিং না থাকায় এ দিন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ প্রায় বন্ধই ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে সেই দিক দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা শুরু করেন সহাল আব্দুল সামাদ। ৬১ মিনিটের মাথায় আনোয়ার আলি তাঁকে বাধা না দিলে হয়তো ব্যবধান কমত।
দু’গোলে এগিয়ে থাকায় ক্রমশ দূর্গরক্ষায় বেশি মন দেয় ইস্টবেঙ্গল। ফলে প্রতিপক্ষের এলাকায় আরও বেশি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়ে যায় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। তাদের চেষ্টা অবশেষে ফলপ্রসূ হয় ৬৮ মিনিটের মাথায়, যখন লিস্টন কোলাসোর কর্নারের পর বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া অনিরুদ্ধ থাপার কোণাকুনি শট বারে লেগে জালে জড়িয়ে যায় (২-১)।
এই গোলের পরেই দীপেন্দু বিশ্বাস, দীপক টাঙরি ও দিমিত্রিয়স পেট্রাটস মাঠে নামেন সমতা আনার উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁরা নামার পর থেকেই ছন্দে ফিরতে শুরু করে গতবারের রানার্স আপ। ৭২ মিনিটের মাথায় ডান দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে তিন ডিফেন্ডারকে ধোঁকা দিয়ে গোলে জোরালো শট নেন আশিস। গোলকিপার প্রভসুখন লাফিয়ে উঠে বলে হাত না ছোঁয়ালে হয়তো সমতা এনে ফেলতে পারতেন। পরের মুহূর্তেই ফের গোলের সুযোগ তৈরি করে তারা।
প্রতিপক্ষের ঘনঘন আক্রমণে দু’গোল করা ইস্টবেঙ্গলকে বেশ কিছুক্ষণ দিশাহারা মনে হয়। জলপান বিরতিতে ফের খেলায় ফেরার পরিকল্পনা তৈরি করে তারা এবং সেই চেষ্টাও শুরু করে। কিন্তু একটি গোল ও একাধিক সুযোগ তৈরি করে যে ছন্দ পেয়ে গিয়েছিল বাগান-বাহিনী, তা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা।
এই ছন্দে ফের পতন ঘটাতে একসঙ্গে পিভি বিষ্ণু, ডেভিড লালনসাঙ্গা ও শৌভিক চক্রবর্তীকে মাঠে নামায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। এই পরিবর্তনগুলির সময় নির্ধারিত সময় শেষ হতে আর মিনিট দশেক বাকি। ইস্টবেঙ্গলের পরিবর্ত খেলোয়াড়রা মাঠে এসে আগে খেলায় নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা শুরু করেন এবং রক্ষণকে আরও আঁটোসাঁটো করে তোলেন।
তাদের রক্ষণে চিড় ধরানোর জন্য ৮৫ মিনিটের মাথায় আশিসের জায়গায় সুহেল ভাটকে নামান বাগান-কোচ মোলিনা। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। পাল্টা আক্রমণে উঠে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে রক্ষণে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন ক্রেসপো, বিষ্ণুরা।
ছ’মিনিটের সংযুক্ত সময়ে সমতা আনতে পারলে ম্যাচ সরাসরি পেনাল্টি শুট আউটে নিয়ে যেতে পারত মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের এই পাল্টা কৌশলের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা। বল কিছুতেই নিজেদের এলাকায় আসতে দেননি লাল-হলুদ খেলোয়াড়রা। উত্তেজনায় মেজাজও হারাতে দেখা যায় দুই দলের খেলোয়াড়দের।
তবে সংযুক্ত সময়ের শেষ দু’মিনিটে প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের আশেপাশে দেখা যায় সবুজ-মেরুন বাহিনীকে। সমতার গোল পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। কিন্তু নিজেদের দূর্গ সামলাতে মরিয়া ছিলেন লাল-হলুদ তারকারাও এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরাই জয়ের হাসি মুখে নিয়ে মাঠ ছাড়েন।