কলকাতা ডার্বিতে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারল না ইস্টবেঙ্গল এফসি। বুধবার ডুরান্ড কাপের সেমিফাইনালে ঘরের মাঠে ডায়মন্ড হারবার এফসি-কে হারিয়ে খেতাবি লড়াইয়ে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র মুখোমুখি হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে নেমেছিল লাল-হলুদ ব্রিগেড। কিন্তু তাদের লক্ষ্য পূরণ হল না। অসাধারণ লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে ফাইনালে উঠে পড়ল কলকাতার উঠতি এবং নবাগত দল ডায়মন্ড হারবার এফসি

এ দিন ইস্টবেঙ্গলকে ২-১-এ হারিয়ে ঐতিহ্যবাহী ডুরান্ড কাপ ফাইনালে নর্থইস্টের মুখোমুখি হওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলল ডায়মন্ড বাহিনী। আগাগোড়া ইস্টবেঙ্গলকে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ের হাসি হাসল তারাই, যা তাদের প্রাপ্যও ছিল। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে কখনও না হারার নজির নিয়ে এ দিন মাঠে দল নামিয়েছিলেন তাদের স্প্যানিশ কোচ কিবু ভিকুনা। সেই নজির এ দিন অক্ষত রাখলেন তিনি। এই প্রথম ডুরান্ড কাপে অংশ নিয়ে প্রথমবারেই খেতাবি লড়াইয়ে পৌঁছে দিলেন দলকে

এ দিন প্রথমার্ধে দুই দলের মধ্যে বল দখল ও গোলের সুযোগ তৈরির প্রতিযোগিতার পাশাপাশি গোলের সুযোগ নষ্টের প্রতিযোগিতাও দেখা যায়। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে দুই দলই নিজেদের ভুল শুধরে আরও নিখুঁত পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে ফেরে। কিন্তু সবার আগে সাফল্য পায় নবাগত দলই। ৬৬ মিনিটের মাথায় স্প্যানিশ ডিফেন্ডার মিকেল কোর্তাজারের দৃষ্টিনন্দন বাইসাইকেল কিকের গোলে এগিয়ে যায় ডায়মন্ড হারবার। তাদের আনন্দের রেশ কাটার আগেই পরের মিনিটেই আনোয়ার আলির দূরপাল্লার গোলমুখী শটে সমতা আনে ইস্টবেঙ্গল

কিন্তু ৮৩ মিনিটের মাথায় ইস্টবেঙ্গলেরই প্রাক্তনী জবি জাস্টিনের গোলে জয় নিশ্চিত করে ডায়মন্ড হারবার। আরও একবার জালে বল জড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের তারকা স্ট্রাইকার লুকা মাজেন। কিন্তু তিনি অফসাইড থাকায় সেই গোল বাতিল হয়ে যায়। ১৬ বারের ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন ইস্টবেঙ্গল এফসি ছিটকে যাওয়ায় এই টুর্নামেন্টের বর্ণময় ইতিহাসে লেখা হল এক নতুন ফাইনালিস্টের নাম। তবে তারা গতবারের চ্যাম্পিয়ন নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কে হারিয়ে খেতাব জয় করে আর এক ইতিহাস গড়তে পারবে কি না, তা বোঝা যাবে শনিবার ১৩৪তম ডুরান্ড কাপের ফাইনালে।

এ দিন প্রথমার্ধে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে ডায়মন্ড হারবার এফসি। আক্রমণের ধারে তারা লাল-হলুদ বাহিনীকেও পিছনে ফেলে দেয়। সারা অর্ধে যেখানে তিনটি শট গোলে রাখতে পারে তারা, সেখানে ইস্টবেঙ্গল একটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি। বরং গোলের সুযোগ হাতছাড়া করার দিক থেকে এগিয়ে ছিল আইএসএলের দলই।

ম্যাচের ১২ ও ১৫ মিনিটের মাথায় মিগুয়েল ফেরেইরা, ২০ মিনিটের মাথায় বিপিন সিং, ৪২ মিনিটের মাথায় দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস গোলের সুযোগ পেয়েও বল জালে জড়াতে পারেননি। প্রথমার্ধের একেবারে শেষ দিকে নাওরেম মহেশ ও ফেরেইরার পরপর দু’টি গোলমুখী শট অনবদ্য দক্ষতায় সেভ করেন গোলকিপার মিরশাদ মিচু।

অন্যদিকে, ডায়মন্ড হারবারও যেন গোলের সুযোগ নষ্টের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। আট মিনিটের মাথায় পলের দূরপাল্লার শট কোনওরকমে আটকান প্রভসুখন গিল। ২৪ মিনিটের মাথায় ডায়মন্ড ফরোয়ার্ড স্যামুয়েলের শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ৩২ মিনিটের মাথায় তাদের স্প্যানিশ ডিফেন্ডার কোর্তাজারের হেড অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়।

প্রথমার্ধে সমানে সমানে লড়াই হলেও ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে এ ভাবেই বারবার হানা দিয়ে কাঁপন ধরিয়ে দেন ডায়মন্ড হারাবারের অ্যাটাকাররা। দুই উইংকে কাজে লাগিয়ে একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করে তারা। অন্যদিকে, ইস্টবেঙ্গল আক্রমণে দিয়ামান্তাকসের ওপর একটু বেশিই নির্ভর করে এদিন। কিন্তু গত ম্যাচে জোড়া গোলের নায়ক এ দিন সতীর্থদের বারবার হতাশই করেন

বিরতির পর প্রভাত লাকরা ও জিকসন সিং লাল-হলুদ বেঞ্চ থেকে নামেন। তুলে নেওয়া হয় লালচুঙনুঙ্গাকে, যিনি এ দিন চতুর্থ হলুদ কার্ড দেখে পরের ম্যাচে খেলতে পারবেন না। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও সুযোগ পেয়েছিলেন দিয়ামান্তাকস। তাঁর কোণাকুনি শট গোলের বাইরে সাইড নেটে জড়িয়ে যায়। এর মিনিট চারেক পরে আনোয়ারের পাস থেকে পাওয়া বলে হেড করে বল গোলের বাইরে পাঠান গ্রিক ফরোয়ার্ড। ৫৭ মিনিটের মাথায় ফের বিপিনের গোলমুখী শট আটকে দেন মিরশাদ। এর পরেই হালিচরণ নারজারি চোট পেয়ে বেরিয়ে যান এবং রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে তিন খেলোয়াড় নামায় ডায়মন্ড হারবার এফসি। হালিচরণের সঙ্গে তুলে নেওয়া হয় কোয়ার্টার ফাইনালে জোড়া গোলের নায়ক রুয়াতকিমাকেও।

ম্যাচের ৬২ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে ফ্রি কিক পায় ইস্টবেঙ্গল, যা সরাসরি গোলের দিকে পাঠান দিয়ামান্তাকস। কিন্তু এ বার তাঁর সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান মিরশাদ। এর পরেই পরপর দু’মিনিটে দু’গোল করে দুই দল। প্রথমে ৬৬ মিনিটের মাথায় ডায়মন্ড বাহিনী ও পরের মিনিটেই আনোয়ার আলি।

বক্সের বাইরে থেকে উড়ে আসা বলে দ্বিতীয় পোস্টের সামনে কোণাকুনি বাইসাইকেল কিকে অসাধারণ গোলটি করেন কোর্তাজার (১-০) এবং এর পরে খেলা শুরু হতেই সেন্টার লাইন পেরিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে সোজা গোলে শট নেন আনোয়ার, যা আন্দাজ করতে না পেরে আটকাতেই পারেননি মিরশাদ (১-১)। এতটাই জোর ছিল আনোয়ারের শটে।

সমতা আনার পরেই চাপ বাড়ায় ইস্টবেঙ্গল এফসি এবং ৭৩ মিনিটের মাথায় মাঠে নামানো হয় মহম্মদ রশিদকে। সউল ক্রেসপোর জায়গায় নামানো হয় তাঁকে। প্যালেস্টাইনের এই সদ্য পিতৃহারা মিডফিল্ডার মাঠে নামার পরে আক্রমণে আরও ধার বাড়ায় লাল-হলুদ ব্রিগেড। তাঁর একটি শট পোস্টের কয়েক ইঞ্চি বাইরে দিয়ে চলে যায়।

কিন্তু ৮৩ মিনিটের মাথায় যে ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তনী জবি জাস্টিন, তা বোধহয় ভাবতেও পারেননি প্রভসুখন গিলরা। ছ’গজের বক্সে জটলার মধ্যে থেকে চামচের মতো করে বল তুলে গোলে প্রবেশ করিয়ে দেন জবি (২-১)। তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছিল, নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি গোল করেছেন। অবশ্য প্রাক্তন দলের জন্য সম্মান প্রদর্শনের জন্যও হয়তো এমন শান্ত ছিলেন।

নির্ধারিত সময় শেষ হতে যেহেতু আর মাত্র সাত মিনিট বাকি ছিল, তাই সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ইস্টবেঙ্গল এফসি। এই সময় মিরশাদই হয়ে ওঠেন ত্রাতা। সারা ম্যাচেই তিনি অসংখ্যবার দলকে বাঁচানোর দায়িত্ব নেন। ম্যাচের শেষ দিকে কেভিন সিবিলের হেডে প্রায় অবধারিত গোল পেয়ে যেত ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু মিরশাদের জন্যই তা সম্ভব হয়নি।

৮৮ মিনিটের মাথায় শেষ দুই তাস খেলে ইস্টবেঙ্গল, পিভি বিষ্ণু ও ডেভিড লালনসাঙ্গাকে নামিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে রক্ষণে প্রায় প্রাচীর তুলে দেয় ডায়মন্ড বাহিনী। বিষ্ণুরা নামায় কোনও লাভ তো হয়ইনি বরং উল্টো ফল হতে পারত। আট মিনিটের সংযুক্ত সময় দেন রেফারি। অল আউট ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে প্রায় কেউই ছিলেন না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের গোল এরিয়ায় ঢুকে পড়েন লুকা মাজেন এবং গোলে বলও ঠেলে দেন। কিন্তু ততক্ষণ সহকারী রেফারির অফ সাইডের পতাকা উঠে যায়। সেই গোল বাতিল না হলে আরও বেশি ব্যবধানে জিততে পারত ডায়মন্ড বাহিনী।