প্রায় সপ্তাহ তিনেকের ছুটি কাটিয়ে ফের মাঠে নামতে চলেছে ইস্টবেঙ্গল এফসি। এ বার তাদের লড়াই চেন্নাইয়ে। যেখাকার দল চেন্নাইন এফসি-রও অনেকটা তাদের মতোই অবস্থা। যদিও পয়েন্টের বিচারে অবশ্য এগিয়ে দক্ষিণ ভারতীয় দলটিই। প্রথম তিন ম্যাচের টানা হারের পর টানা দুটি ম্যাচে জিততে না জিততেই শেষ ম্যাচে আবার হারতে হয়েছে তাদের। ইস্টবেঙ্গল তাদের চেয়ে একটি কম ম্যাচ খেলেছে। কিন্তু গত তিন ম্যাচে হারের হ্যাটট্রিক করেছে কলকাতার দল।

কখনও গোল করে এগিয়ে গিয়েও হেরেছে, কখনও জঘন্যভাবে পরপর দুবার পেনাল্টির সুযোগ হাতছাড়া করে হেরেছে। ছুটির মধ্যে ভুলভ্রান্তি শুধরে নিয়ে নিজেদের যদি একটুও উন্নত করে তুলতে পারে লাল-হলুদ শিবিরের ফুটবলাররা, তা হলে শনিবার চেন্নাইয়ের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে হয়তো জয়ে ফিরতে পারে। চেন্নাইন এ মরশুমে এ পর্যন্ত তিনটি হোম ম্যাচ খেলেছে। তার মধ্যে একটিতে ৫-০ গোলে জিতেছে, পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে। অন্য দুই ম্যাচে মোহনবাগান এসজি ও এফসি গোয়ার কাছে হেরেছে।

ঘরের মাঠে তাদের হারানো যে কঠিন, এ কথা বলা যায় না। তবে এই ছুটিতে দলকে কী ভাবে ঘষামাজা করেছেন তাদের স্কটিশ কোচ আওয়েন কোইল, সেটাই দেখার। এই ক’দিনে যদি নিজেদের ধারালো করে তোলে চেন্নাইন, তা হলে এই ম্যাচে তার প্রতিফলন অবশ্যই ঘটা উচিত। একই কথা অবশ্য ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কেও বলা যায়। লিগ টেবলে ইস্টবেঙ্গল রয়েছে দশে এবং চেন্নাইন ছ’পয়েন্ট নিয়ে আছে সাতে। সুতরাং, শনিবার সন্ধ্যার এই ম্যাচে জয়ে ফেরার তাগিদ ইস্টবেঙ্গলেরই বেশি। পাঁচ ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পাওয়া ইস্টবেঙ্গল যদি এই ম্যাচেও জিততে না পারে, তা হলে তাদের লিগ টেবলে আরও তলায় চলে যেতে হবে। তাই শনিবারের বিকেলের ম্যাচটি লাল-হলুদ শিবিরের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স

চেন্নাইন এফসি: টানা তিন হার দিয়ে এ বারের আইএসএল শুরু করে চেন্নাইন। প্রথমে ওডিশা এফসি-র কাছে দু’গোলে হারে তারা। পরে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র কাছে তিন গোলে হার। অর্থাৎ প্রথম দুই ম্যাচেই পাঁচ গোল খেয়ে বসে দু’বারের আইএসএল চ্যাম্পিয়নরা। এই দুটিই ছিল অ্যাওয়ে ম্যাচ। সমর্থকেরা ভেবেছিলেন শুরুতেই বাইরের মাঠে খেলতে হচ্ছে বলে হয়তো দলটা ঠিকমতো সাফল্য পাচ্ছে না। ঘরের মাঠে নামলে বোধহয় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মোহনবাগান এসজি চেন্নাইয়ে এসে ফের হারিয়ে দিয়ে যায় চেন্নাইনকে। তাও ৩-১-এ। শেষ পর্যন্ত চেন্নাইন জয়ে ফেরে বাইরের ম্যাচেই। হায়দরাবাদ এফসি-কে ১-০-য় হারিয়ে এবং ঘরের মাঠেও তারা প্রথম জয় পায় পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে, ৫-১-এ। কিন্তু গত ম্যাচে আবার হারের মুখ দেখতে হয়, এটাও ঘরের মাঠে, যেখানে এফসি গোয়া তাদের ৩-০-য় হারিয়ে দিয়ে চলে যায়। সব মিলিয়ে দু’টি ম্যাচে জিতে ছ’পয়েন্ট পেয়ে তারা এখন লিগ তালিকার সাত নম্বরে।

ইস্টবেঙ্গল এফসি: গত তিন মরশুম ধরে টানা একতরফা ব্যর্থতার পর এ বছরও আইএসএলের শুরুটা সে রকম ভাল করতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। জামশেদপুরের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্রয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে ক্লেটন সিলভা ফর্মে ফেরেন। দলও জয়ে ফেরে। ব্রাজিলীয় তারকার জোড়া গোলে চলতি লিগের প্রথম জয় পায় তারা। বেঙ্গালুরুতে ফের ছন্দপতন হয় তাদের। ২-১-এ তাদের হারিয়ে লিগের প্রথম জয় পায় সুনীল ছেত্রীর দল। হারার মতো না খেলেও হাভিয়ে হার্নান্ডেজের এক অনবদ্য বাইসাইকেল কিকের গোলে হার স্বীকার করতে হয় তাদের। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ৭৩ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থাকার পরে দু’মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল খেয়ে ১-২-এ হেরে মাঠ ছাড়তে হয় লাল-হলুদ বাহিনীকে। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ ম্যাচে এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ৮৫ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন ক্লেটন সিলভা। যদিও তিনি স্টপেজ টাইমের একেবারে শেষ দিকে ফের পেনাল্টির সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি গোল শোধ করেন, কিন্তু ততক্ষণে আরও এক গোল খেয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। পাঁচ ম্যাচে মাত্র একটি জয় নিয়ে লিগ টেবলে দশ নম্বরে তারা।

দুই শিবিরের খবর

কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি: ইস্টবেঙ্গলে যেমন মাত্র দুজন গোলদাতা, চেন্নাইন কিন্তু এখন পর্যন্ত চারজন গোলদাতা খুঁজে পেয়েছে। ফরোয়ার্ড কোনর্স শিল্ড, যিনি তিনটি গোল করেছেন। দুটি গোল করেছেন রাফায়েল ক্রিভেলারো, একটি করে গোল রয়েছে ভিঞ্চি ব্যারেটো ও রায়ান এডওয়ার্ডসের। এই দলের দুই গোলকিপারই বাংলার, দেবজিত মজুমদার ও শমীক মিত্র। দুজনেই তিনটি করে ম্যাচে গোল সামলেছেন। দেবজিত তিন ম্যাচে সাতটি সেভ করেছেন, ক্লিন শিট রেখেছেন একটি। শমীক তিন ম্যাচে দশটি সেভ করলেও কোনও ক্লিনশিট রাখতে পারেননি। গত দুই ম্যাচে ৪-২-৩-১ ছকে দলকে খেলালেও তার আগের ম্যাচে ৪-৪-২-এ খেলেছিল কোইলের দল। গত ম্যাচে যেমন বাংলার ফরোয়ার্ড রহিম আলিকে সামনে রেখে তাঁর পিছনে শিল্ড, ক্রিভেলারো ও ফারুখ চৌধুরিকে রাখা হয়। মাঝমাঠে ক্রিশ্চিয়ান বাত্তোচিও ও আয়ূষ অধিকারী এবং রক্ষণে অঙ্কিত মুখার্জি, বিকাশ ইউমনাম, রায়ান এডওয়ার্ডস ও সাচু সিবি। বাংলার ডিফেন্ডার সার্থক গলুইকে এখনও কোনও ম্যাচে দেখা যায়নি।

ইস্টবেঙ্গল এফসি: স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড হাভিয়ে সিভেরিও ও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার সল ক্রেসপো যে দারুন ফর্মে রয়েছেন, তা বলা যায় না। তাঁরা এখন পর্যন্ত কোনও গোলও করতে পারেনি। সিভেরিওর আইএসএল কেরিয়ারে সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে এটা। না গোল করতে পেরেছেন, না অ্যাসিস্ট। তার ওপর স্প্যানিশ মিডফিল্ডার বোরহা হেরেরা গঞ্জালেস এই ম্যাচে চোটের জন্য অনিশ্চিত। স্প্যানিশ তারকা ডিফেন্ডার হোসে পার্দো অবশ্য রক্ষণকে ভরসা জোগাচ্ছেন। ফলে গত মরশুমের দুই সেরা গোলদাতা ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার ক্লেটন সিলভা ও নাওরেম মহেশ সিংয়ের ওপরই যাবতীয় চাপ এসে পড়ছে। হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ক্লেটনের জোড়া গোলেই জেতে ইস্টবেঙ্গল। তাঁর সঙ্গে নির্ভরযোগ্য উইঙ্গার মহেশও ভাল ফর্মে রয়েছেন। দলের পাঁচটি গোলের মধ্যে তিনিই দুটি করেছেন। সিনিয়র ডিফেন্ডার হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা, উইঙ্গার নন্দকুমার শেখর, ব্লাস্টার্স থেকে আসা ডিফেন্ডার নিশু কুমার ও গোলকিপার প্রভসুখন গিলদের সেরা ফর্মে ফিরতে হবে। জর্ডন থেকে আসা নতুন বিদেশি ডিফেন্ডার হিজাজি মাহেরকে গত ম্যাচে পরিবর্ত হিসেবে দেখা গিয়েছিল। এই ম্যাচে শুরু থেকেই দেখা যাবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

পরিসংখ্যান যা বলছে

টানা তিন ম্যাচে হারের পর ইস্টবেঙ্গল শনিবারও যদি হারে, তা হলে এটি হবে তাদের টানা চার ম্যাচে হারের দ্বিতীয় ঘটনা। গত মরশুমে জানুয়ারিতেও তারা টানা চার ম্যাচে হেরেছিল। ইস্টবেঙ্গল গত চার ম্যাচে গোলহীন থাকেনি। ট্যাকলে ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যের শতকরা হার ৭৫%। চলতি আইএসএলে যা অন্য যে কোনও দলের চেয়ে বেশি। ৬১টির মধ্যে ৪৬টি ট্যাকলে সফল হয়েছে লাল-হলুদ ফুটবলাররা। বল দখলের ডুয়ালে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছেন লাল-হলুদ মিডফিল্ডার সল ক্রেসপো। এ পর্যন্ত মোট ৫৫টি ডুয়ালের মধ্যে ৪১টিই জিতেছেন ক্রেসপো, যা চলতি লিগে অন্য সব দলের ফুটবলারদের চেয়ে বেশি।

প্রথম ছয় ম্যাচে ১২ গোল খেয়েছে চেন্নাইন এফসি। এর আগে আইএসএলে কোনও মরশুমে প্রথম ছয় ম্যাচে এত গোল খায়নি তারা। বক্সের বাইরে থেকে তারা পাঁচটি গোল খেয়েছে। আর কোনও দল বক্সের বাইরে থেকে এত গোল খায়নি। চেন্নাইন কিন্তু এই মরশুমে ওপেন প্লে-তে বক্সের বাইরে থেকে কোনও গোল করতে পারেনি। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে তাদের কোচ আওয়েন কোইলের সাফল্যের শতকরা হার ২৫%। লিগের অন্য সব দলের বিরুদ্ধে কোইলের সাফল্যে এর চেয়ে বেশি। বাংলার ফরোয়ার্ড রহিম আলি চেন্নাইনের জার্সি গায়ে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে দু’টি গোল করেছেন। শনিবার তিনি একটি গোল বা অ্যাসিস্ট করলে তাদের দলের হয়ে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি গোলে অবদান থাকবে রহিমেরই।

দ্বৈরথের ইতিহাস

ইন্ডিয়ান সুপার লিগে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ছ’বার। চেন্নাইন এফসি জিতেছে দু’বার। ইস্টবেঙ্গল কখনও তাদের হারাতে পারেনি। তবে চারবার ড্র হয়েছে। প্রথম চারবারের মুখোমুখিতেই ড্র করে দুই দল। প্রথম চার ম্যাচে ড্র হওয়ার পর ২০২২-২৩ মরশুমে প্রথম লেগে চেন্নাইন ১-০-য় জেতে এবং দ্বিতীয় লেগে ২-০-য় জেতে। তার মধ্যে ঘরের মাঠে চেন্নাইন এফসি কলকাতার লাল-হলুদ বাহিনীকে হারিয়েছে একবার ও ড্র করেছে দু’বার। এই ছয় ম্যাচে চেন্নাইন সাত গোল করেছে ও ইস্টবেঙ্গল এফসি চার গোল করেছে। গত তিন মরশুমে চেন্নাইয়ের মাঠে আজ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল কোনও গোল করতে পারেনি।

ম্যাচ- চেন্নাইন এফসি বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি
ভেনু- জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম, চেন্নাই
সময়- ২৫ নভেম্বর, ২০২৩, বিকেল ৫.৩০
সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং টিভি: ডিডি বাংলা ও কালার্স বাংলা সিনেমা- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, ভিএইচ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, সূর্য মুভিজ- মালয়ালাম
স্ট্রিমিং: জিও সিনেমা ও ওয়ানফুটবল