ফের গোল করে এগিয়ে যাওয়া ও ফের ম্যাচের শেষ দিকে গোল খেয়ে জয় হাতছাড়া হওয়া। ইস্টবেঙ্গল এফসি-র ম্যাচে এই ঘটনা ঘটেই চলেছে। শনিবার চেন্নাইয়ের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে তারা ৮৫ মিনিট পর্যন্ত এক গোলে এগিয়ে থাকার পরও গোল খেয়ে জেতা ম্যাচ ১-১ ড্র করল। ঘরের মাঠে চেন্নাইন এফসি জয়ে ফিরতে না পারলেও একটি পয়েন্ট অর্জন করল কলকাতার দলের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে।

এই মরশুমে এই নিয়ে তিনটি ম্যাচে এগিয়ে থেকেও জয় হাতছাড়া করলেন ক্লেটন সিলভারা। ম্যাচের বয়স ৮০ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর এই নিয়ে দ্বিতীয় গোল খেল তারা। গত ম্যাচেও যে ভাবে কেরালার ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ৮৮ মিনিটের মাথায় গোল খেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল, শনিবার চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধেও ৮৬ মিনিটের মাথায় গোল খেয়ে জয়ে ফেরার সুযোগ হাতছাড়া করল।

এ দিন ২৯ মিনিটের মাথায় চেন্নাইনের মিডিও আয়ূষ অধিকারীর নিজগোলে এগিয়ে যায় কলকাতার দল। সেই গোলেই ৮৫ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে ছিল ইস্টবেঙ্গল। সারা ম্যাচে এদিন যথেষ্ট গোছানো ও তৎপর থাকার পরে শেষ ১২ মিনিটে (বাড়তি সময়-সহ) চাপের মুখে ভেঙে পড়ে লাল-হলুদ রক্ষণ এবং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই সমতা আনে চেন্নাইন এফসি। ফলে ছয় ম্যাচে মাত্র পাঁচ পয়েন্ট অর্জন করতে পারল কলকাতার দল। চেন্নাইন এফসি-র সংগ্রহ সাত ম্যাচে সাত পয়েন্ট।

গত ম্যাচের দলে তিনটি পরিবর্তন করে দল নামান ইস্টবেঙ্গল কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। জর্ডনের ডিফেন্ডার হিজাজি মাহের, শৌভিক চক্রবর্তী ও বিষ্ণু পুতিয়া শুরু থেকে খেলেন মহম্মদ রকিপ, নন্দকুমার শেখর ও হাভিয়ে সিভেরিওর জায়গায়। এই তিনজনই ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। ক্লেটনকে সামনে রেখে ও তাঁর পিছনে পুতিয়া, খাবরা, ক্রেসপো ও মহেশকে রেখে ৪-১-৪-১ ছকে খেলা শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। অন্যদিকে, সাচু সিবি, রহিম আলি ও কোনর্স শিল্ডের জায়গায় অজিত কুমার, জর্ডন মারে ও ভিঞ্চি ব্যারেটোকে প্রথম এগারোয় রেখে ৪-২-৩-১-এ দল সাজান চেন্নাইন কোচ আওয়েন কোইল।

প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যে দুটি করে গোলের সুযোগ তৈরি করে নেয় দু’পক্ষই। বিষ্ণুর গোলমুখী শট দেবজিৎ মজুমদার আটকানোর পর কর্নারে পাওয়া বল হেড করে বারের ওপর দিয়ে পাঠান মাহের ও বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া আয়ূষ অধিকারীর জোরালো শট বারের নীচ দিয়ে ঢোকার আগেই তা আটকে দেন ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার প্রভসুখন গিল। তবে সহজতম সুযোগটি হেলায় হারান জর্ডন মারে, যখন ১৪ মিনিটে ছ’গজের বক্সের মাথা থেকে বারের ওপর দিয়ে বল পাঠিয়ে অবাক করে দেন। দু’পক্ষই আক্রমণাত্মক ফুটবল দিয়ে শুরু করলেও ক্রমশ বল পজেশন ও আক্রমণের ধার বাড়ায় চেন্নাইন এফসি।

তবে ম্যাচের প্রথম গোলটি পায় ইস্টবেঙ্গলই। মাঝমাঠ থেকে বাড়ানো বল নিয়ে ২৯ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে ওঠা বিষ্ণু বাইলাইনের সামনে থেকে গোলের সামনে ক্লেটন সিলভার উদ্দেশ্যে ক্রস বাড়ান। ক্লেটনের কাছে বল পৌঁছনোর আগে তা ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজের গোলেই বল ঠেলে দেন আয়ূষ (১-০)। তিনি ছেড়ে দিলেও হয়তো ক্লেটনই গোল পেতেন।

গোল খাওয়ার পর থেকেই সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে চেন্নাইন এফসি। ডান উইং দিয়ে বারবার আক্রমণে ওঠেন রাফায়েল ক্রিভেলারো ও ভিঞ্চি ব্যারেটোরা। ৪০ মিনিটের মাথায় জর্ডন মারে তাঁর সেরা সুযোগটি পান এই ডান উইং থেকে আসা ক্রিভেলারোর ক্রসেই। বক্সের মধ্যে অরক্ষিত মারে গোলের দিকে এগিয়ে এসে সেই ক্রসে পা ছোঁয়ানোর চেষ্টা করলেও তা ঠিকমতো পারেননি। ফলে গোলকিপার গিল তা সামলে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যান।

ছ’মিনিটের ইনজুরি টাইম-সহ শেষ দশ মিনিটে চেন্নাইন আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়ায়। তবে তাদের বক্সে ঢুকতে দেননি লাল-হলুদ ডিফেন্ডাররা। ফলে বিরতিতে এক গোলে এগিয়ে থেকেই সাজঘরে যায় তারা। প্রথমার্ধে চেন্নাইন যেখানে চারটি শট গোলে নেয়, সেখানে একটি মাত্র শট গোলে রাখে। পজেশন (৫৪-৪৬) ও গোলের সুযোগ তৈরিতেও (১১-৪) এগিয়ে ছিল চেন্নাইন।

দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটেই ইস্টবেঙ্গল বক্সের ঠিক বাঁ দিকের কোনের সামনে থেকে ফ্রি কিক পায় চেন্নাইন। ক্রিভেলারোর ফ্রি কিক মহেশের গায়ে লেগে বক্সের বাইরে উড়ে গিয়ে পড়লে সেই বল নিয়ে বাঁ দিক দিয়ে ওঠেন মহেশ। তিনি মাঝখান দিয়ে ওঠা ক্রেসপোর উদ্দেশ্যে বল বাড়ানোর চেষ্টা করলেও তা এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে বাইলাইনের ওপারে চলে যায়। এর দু’মিনিট পর বক্সের মাথা থেকে বিষ্ণুর হাফ ভলিতে বল পান ক্লেটন। কিন্তু তাঁর শট ক্লিয়ার করে দেন রায়ান এডওয়ার্ডস। ৫৫ মিনিটের মাথায় আহত বিষ্ণুর জায়গায় মাঠে নামেন নন্দকুমার শেখর।

বিরতির ঠিক আগে থেকে বিরতির পর কুড়ি মিনিট পর্যন্ত—এই মিনিট পঁচিশের মধ্যে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে পাঁচ খেলোয়াড়কেই নামিয়ে দেয় চেন্নাইন। ফলে তাদের খেলায় ফের গতি বাড়তে শুরু করে। ফারুখ চৌধুরির জায়গায় নামা নিমথই মিতেই উইং দিয়ে দুরন্ত গতিতে একাধিকবার আক্রমণে ওঠেন। আয়ূষের জায়গায় নামা জীতেশ্বরও ক্ষিপ্রগতিতে লাল-হলুদ রক্ষণে চিড় ধরানোর চেষ্টা করেন। তবে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ এ দিন যথেষ্ট গোছানো ও তৎপর ছিল। ফলে তাদের লাগাতার গোলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

তা সত্ত্বেও ৭৫ মিনিটের মাথায় অসাধারণ সুযোগ পান ইরফান এডওয়ার্ড, যিনি বক্সের মধ্যে বল পেলেও অনেকটা উঠে যাওয়ায় গোলে বল ঠেলতে পারেননি। গোললাইনের সমান্তরাল পথে যাওয়া বল প্রভসুখন গিল ধরতে না পারলেও গোলের সামনে থেকে তা ক্লিয়ার করে দেন হোসে পার্দো। না হলে অবশ্য বিপদে পড়ত ইস্টবেঙ্গল। ৭১ মিনিটের মাথায় ক্রেসপোর জায়গায় নামেন অজয় ছেত্রী। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে মহম্মদ রকিপ ও হাভিয়ে সিভেরিও নামেন খাবরা ও মহেশের জায়গায়।

নন্দকুমার নামায় আক্রমণের তীব্রতা যতটা বাড়বে বলে ভাবা হয়েছিল, ততটা বাড়েনি। এর আগেও ইস্টবেঙ্গল আগে গোল করে পরে একাধিক গোল খেয়ে ম্যাচ হেরেছে। সে কথা মাথায় রেখে তারা তখন রক্ষণের ওপর জোর দেয় বেশি। তা সত্ত্বেও অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। ৮৬ মিনিটের মাথায় নিমথইয়ের গোল আটকাতে পারেনি তারা।

বক্সের মাথায় পার্দো তাঁর পা থেকে বল খোয়ান এবং ক্রিভেলারো সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বক্সের ডানদিকে নিমথইকে বল দেন। তিনি তীব্র গতিতে বক্সে ঢুকে গোলে যে কোণাকুনি শট নেন, তা কার্যত ফাঁকা গোলে ঢুকে যায় (১-১)। গোলকিপার গিল এগিয়ে এসে নিমথইকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারেননি।

এ দিন হারতেও পারত ইস্টবেঙ্গল। সাত মিনিটের বাড়তি সময়ের শুরুতে জয়সূচক গোল করার সুবর্ণ সুযোগ পান ইরফান। কিন্তু বাঁ দিক থেকে ক্রিভেলারোর নিখুঁত ক্রসে পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন তিনি। বাড়তি সময়ের ছ’মিনিটের মাথায় ম্যাচের দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন রায়ান এডওয়ার্ডস। বাকি সামান্য সময়ে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেনি লাল-হলুদ বাহিনী।

ইস্টবেঙ্গল এফসি দল: প্রভসুখন গিল (গোল), শৌভিক চক্রবর্তী, লালচুঙনুঙ্গা, হিজাজি মাহের, মন্দার রাও দেশাই, হোসে পার্দো, বিষ্ণু পুতিয়া (নন্দকুমার শেখর), হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা (মহম্মদ রকিপ), সল ক্রেসপো (অজয় ছেত্রী), নাওরেম মহেশ সিং (হাভিয়ে সিভেরিও), ক্লেটন সিলভা।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: চেন্নাইন এফসি ৫৬% - ইস্টবেঙ্গল এফসি ৪৪% , সফল পাসের হার: ৮১%-৬৯%, গোলে শট: ৫-২, ফাউল: ১০-১১, ইন্টারসেপশন: ৪-১০, ক্রস: ২৬-১৪, কর্নার: ৭-৬, হলুদ কার্ড: ০-১, লাল কার্ড: ১-০।

ম্যাচের সেরা: রাফায়েল ক্রিভেলারো