মরশুমের শুরুতে যতটা ভাল খেলেছিল ইস্টবেঙ্গল এফসি, আইএসএলের শুরুটা তারা ততটা ভাল করতে পারেনি। তিন ম্যাচে একটি করে জয়, ড্র ও হারের পর গত ম্যাচে তারা ফের হারের মুখ দেখে। তাও গোল করে এগিয়ে যাওয়ার পরও। দলের খোলনলচে বদলানো হলেও এই পুরনো রোগটা সারেনি তারা। এ বারের আইএসএলে যে দুটি ম্যাচে হেরেছে তারা, দুই ম্যাচেই জেতার জায়গায় ছিল। তা সত্ত্বেও জয়ের দোরগোড়ায় গিয়েও পাক্কা ছ’পয়েন্ট খোয়ায়।

এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে গত ম্যাচটি খাতায় কলমে ঘরের মাঠে হলেও বিশেষ কারণে লাল-হলুদ বাহিনীকে সেটি খেলতে হয় প্রতিবেশী রাজ্যের দল ওডিশা এফসি-র ঘরের মাঠ কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে। তেমন বেশি সমর্থকও ছিলেন না সে দিন গ্যালারিতে। খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য এটা অবশ্য কোনও অজুহাত হতে পারে না। আসলে ভাল পারফরম্যান্স না হলে তাতে উন্নতি করার কথা ছাড়া অন্য কিছুই বলা চলে না। গত মাসের ২১ তারিখ এফসি গোয়ার কাছে হারার পর যেমন দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে অনেক অনুশীলন করেছেন কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত, তেমনই প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেছে তাঁর দল। এর প্রভাব শনিবার ঘরের মাঠে কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে পড়বে কি না, সেটাই দেখার।

কেরালা ব্লাস্টার্সের ক্ষেত্রে আবার ছবিটা অন্যরকম। জোড়া জয় দিয়ে শুরু করার পর তিনটি ম্যাচ থেকে চার পয়েন্ট সংগ্রহ করেছে তারা। মোট দশ পয়েন্ট নিয়ে রয়েছে প্রথম তিনের মধ্যে। কলকাতায় তারা আসছে ওডিশা এফসি-কে হারানোর আত্মবিশ্বাস সঙ্গে নিয়েই। তবে গত বছর কলকাতায় এসে দুই ম্যাচেই হারার স্মৃতিও ক্ষত হয়ে রয়েছে তাদের মনে। কলকাতায় ব্লাস্টার্সের রেকর্ড খুব একটা ভাল নয়। এ পর্যন্ত আটটির মধ্যে মাত্র দু’টি ম্যাচ তারা জিতেছে এই শহরে। অবশ্য গতবারের পারফরম্যান্সের তুলনায় এ বার ব্লাস্টার্সের পারফরম্যান্স অনেক ভাল। আবার উন্নত ইস্টবেঙ্গল ঘরের মাঠেও ভাল খেলছে। তাই দুই দলের ম্যাচ জমে উঠতে পারে অনায়াসে।

এই ম্যাচের বাড়তি আকর্ষণ, বাংলার জনপ্রিয় ফুটবলার প্রীতম কোটাল অতিথি দলের হয়ে মাঠে নামবেন। ব্লাস্টার্সের আর এক বঙ্গসন্তান প্রবীর দাস গত দুই ম্যাচে খেলেননি সাসপেন্ড থাকার জন্য। এই ম্যাচেও তাঁর সাসপেনশন থাকছে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচের পর মারপিট করার জন্য। প্রীতম পাঁচটি ম্যাচেই খেলেছেন। তবে পাঁচ ম্যাচে পাঁচ গোল খেয়েছে তাঁর দল। একটি ম্যাচে কোনও গোল খায়নি। গোল খাওয়ার দিক থেকে দুই দলই চার নম্বরে রয়েছে। তবে শটকে গোলে পরিণত করার দিক থেকে দুই দলই বেশ খারাপ জায়গায়। ব্লাস্টার্সের কনভার্শন রেট যেখানে ১৬.৭%, সেখানে ইস্টবেঙ্গলের কনভারশন রেট ১২.১%। ঘরের মাঠে ইস্টবেঙ্গলকে এই পরিসংখ্যানে উন্নতি করতে হবে।

সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স

ইস্টবেঙ্গল এফসি: গত তিন মরশুম ধরে টানা একতরফা ব্যর্থতার পর এ বছরও আইএসএলের শুরুটা সে রকম ভাল করতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। জামশেদপুরের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্রয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে ক্লেটন সিলভা ফর্মে ফেরেন। দলও জয়ে ফেরে। ব্রাজিলীয় তারকার জোড়া গোলে চলতি লিগের প্রথম জয় পায় তারা। বেঙ্গালুরুতে ফের ছন্দপতন হয় তাদের। ২-১-এ তাদের হারিয়ে লিগের প্রথম জয় পায় সুনীল ছেত্রীর দল। হারার মতো না খেলেও হাভিয়ে হার্নান্ডেজের এক অনবদ্য বাইসাইকেল কিকের গোলে হার স্বীকার করতে হয় তাদের। গত ম্যাচে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ৭৩ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থাকার পরে দু’মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল খেয়ে ১-২-এ হেরে মাঠ ছাড়তে হয় লাল-হলুদ বাহিনীকে। বেঙ্গালুরুতেও প্রথমে গোল করে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হার মানে ইস্টবেঙ্গল। দলে আমূল পরিবর্তন এলেও তাদের পুরনো রোগ এখনও সারেনি।

কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি: জোড়া জয় দিয়ে এ বারের আইএসএল শুরু করে কেরালা ব্লাস্টার্স। প্রথম ম্যাচে তারা বেঙ্গালুরু এফসি-কে ২-১-এ হারায় তারা। আদ্রিয়ান লুনা জয়সূচক গোল করেন। জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধে ৭৪ মিনিটে গোল করে দলকে জেতান সেই লুনা। এই দুই ম্যাচই ছিল ঘরের মাঠে। যেখানে দলের সঙ্গে থাকে তাদের হাজার হাজার সমর্থক। কিন্তু মরশুমের প্রথম অ্যাওয়ে ম্যাচে মুম্বইয়ের কাছে ১-২-এ হারে তারা। দলের হয়ে একমাত্র গোলটি করেন দানিশ ফারুক। ঘরের মাঠে প্রথম দুই ম্যাচে জয় পেলেও তৃতীয় ম্যাচে অবশ্য তাদের ১-১-এ আটকে দেয় নর্থইস্ট ইউনাইটেড। এই ম্যাচেও গোল পান ফারুক। ফের ঘরের মাঠে তারা সাফল্যে ফেরে ওডিশা এফসি-কে ২-১-এ হারিয়ে। ওডিশা এফসি প্রথমে গোল করার পরেও ৬৬ মিনিটে দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস ও ৮৪ মিনিটে লুনার গোলে জেতে ব্লাস্টার্স। সাসপেনশনের জন্য প্রথম চার ম্যাচে ডাগ আউটে থাকতে পারেননি তাদের কোচ ইভান ভুকোমানোভিচ। গত ম্যাচেই ডাগ আউটে ফেরেন তিনি এবং দল জয় পায়। অর্থাৎ যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়েই কলকাতায় এসেছে ব্লাস্টার্স-বাহিনী।

দুই শিবিরের খবর

ইস্টবেঙ্গল এফসি: দলের স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড হাভিয়ে সিভেরিও ও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার সল ক্রেসপোর সঙ্গে হায়দরাবাদ এফসি থেকে আসা স্প্যানিশ মিডফিল্ডার বোরহা হেরেরা গঞ্জালেস প্রত্যেকেই ভাল ফর্মে রয়েছেন। কিন্তু যেটা আসল কাজ, সেই গোলই করতে পারছেন না। আর এক স্প্যানিশ তারকা ডিফেন্ডার হোসে পার্দোও রক্ষণকে ভরসা জোগাচ্ছেন। এ ছাড়া গত মরশুমে দলে থাকা বিদেশি স্ট্রাইকার ক্লেটন সিলভা তো এ বারেও আছেন। হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর জোড়া গোলেই জেতে ইস্টবেঙ্গল। তাঁর সঙ্গে নির্ভরযোগ্য উইঙ্গার নাওরেম মহেশ সিংও দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন। দলের চারটি গোলের মধ্যে তিনিই দুটি করেছেন। তবে সিনিয়র ডিফেন্ডার হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা, উইঙ্গার নন্দকুমার শেখর, ব্লাস্টার্স থেকে আসা ডিফেন্ডার নিশু কুমার ও গোলকিপার প্রভসুখন গিলদের সেরা ফর্মে ফিরতে হবে। জর্ডন থেকে আসা নতুন বিদেশি ডিফেন্ডার হিজাজি মাহেরকে এই ম্যাচে শুরু থেকেই দেখা যাবে কি না, সেটাও প্রশ্ন।

কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি: ইস্টবেঙ্গলের যেমন মাত্র দুজন গোলদাতা রয়েছেন, বাকিরা এখনও গোলের খাতা খুলতে পারেননি, তেমনই কেরালা ব্লাস্টার্সের ছ’টি গোলের মধ্যে তিনটিই করেছেন আদ্রিয়ান লুনা। দু’টি করেছেন দানিশ ফারুক ও একটি দিয়ামান্তাকস। তবে গোলকিপার শচীন সুরেশ একটির বেশি ক্লিন শিট রাখতে পারেননি। তবু তাঁকেই পাঁচটি ম্যাচে গোলরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মূলত ৪-৪-২-এই খেলছে তারা। গত ম্যাচে যেমন প্রীতম কোটাল ও হরমিপম রুইভা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে খেলেন ও দুই সাইড ব্যাক ছিলেন সন্দীপ সিং ও নাওচা সিং। কোয়ামি পেপরা ও আদ্রিয়ান লুনাকে সামনে রেখে তাদের পিছনে মোহনন, ফারুক, রাহুল কেপি ও দাইসুকে সাকাই ছিলেন নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে। শনিবার প্রথম এগারোয় হয়তো এঁরাই থাকবেন।

পরিসংখ্যান যা বলছে

আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে টানা পাঁচ ম্যাচে অপরাজিত থাকার পর ব্লাস্টার্স গতবারের মুখোমুখিতেই তাদের কাছে হেরেছে এবং কোনও গোল করতে পারেনি। পাঁচ ম্যাচে দশ পয়েন্ট অর্জন করেছে তারা। এই প্রথম প্রথম পাঁচ ম্যাচে এত পয়েন্ট পেল তারা। চলতি লিগের কোনও ম্যাচে প্রথমার্ধে গোল করতে পারেনি ব্লাস্টার্স। সব গোলই হয়েছে দ্বিতীয়ার্ধে। প্রতিপক্ষের পেনাল্টি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি হানা দেওয়ার ক্ষেত্রে দু’নম্বরে আছেন আদ্রিয়ান লুনা (৫১)। চেন্নাইনের রাফায়েল ক্রিভেলারোর (৫৮) পরেই তিনি। অর্থাৎ লুনাকে নজরে রাখতেই হবে লাল-হলুদ রক্ষণের।

ঘরের মাঠে শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জিতেছে ইস্টবেঙ্গল। তবে ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে একটিই ম্যাচ খেলে সেটিতে জিতেছে (১-০) লাল-হলুদ বাহিনী। এ বারের আইএসএলে গত তিন ম্যাচেই গোল পেয়েছে তারা। তাদের মিডফিল্ডার সল ক্রেসপো এ পর্যন্ত বল দখলের লড়াইয়ে ৭২% সাফল্যে পেয়েছেন। এই তালিকায় তিনি সবার ওপরে। ইস্টবেঙ্গলের আটটি জয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন নাওরেম মহেশ সিং। শনিবার দল জিতলে তিনিই হবেন এই ক্লাবের বর্তমান দলের সবচেয়ে বেশি জয়ের সাক্ষী।

দ্বৈরথের ইতিহাস

ইন্ডিয়ান সুপার লিগে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ছ’বার। ব্লাস্টার্স জিতেছে দু’বার। ইস্টবেঙ্গল একবার। বাকি তিনবার ড্র হয়েছে। তিনবারই ড্র হয় ১-১-এ, ২০২০-২১ মরশুমে দু’বার ও তার পরের মরশুমে একবার। প্রথম তিন মুখেমুখিতেই ড্র হওয়ার পর ২০২১-২২ মরশুমে দ্বিতীয় লেগে ব্লাস্টার্স ১-০-য় জেতে। গত মরশুমের প্রথম সাক্ষাতে ৩-১-এ জেতে কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি ও দ্বিতীয় লড়াইয়ে ১-০-য় জিতে বদলা নেয় কলকাতার দল।

ম্যাচ- ইস্টবেঙ্গল এফসি বনাম কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি

ভেনু- বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা

সময়- ৪ নভেম্বর, ২০২৩, রাত ৮.০০

সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং

টিভি: ডিডি বাংলা ও কালার্স বাংলা সিনেমা- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, ভিএইচ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, সূর্য মুভিজ- মালয়ালাম

স্ট্রিমিং: জিও সিনেমা ও ওয়ানফুটবল