ঘরের মাঠে আবার ব্যর্থতার অন্ধকারে ডুবল ইস্টবেঙ্গল এফসি। শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে তারা হেরে গেল কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি-র কাছে। এ দিন জোড়া গোলে জিতে লিগ তালিকার এক নম্বরে উঠে এল কেরালার দলটি। আর ইস্টবেঙ্গল তাদের তৃতীয় হারের পর নেমে গেল দশ নম্বরে। এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় যে ভাবে এ দিন পেনাল্টি মিস করেন ব্রাজিলীয় তারকা ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভা, তা অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়।

এ মরশুমে একমাত্র এই ম্যাচেই প্রধমার্ধে গোল করে ব্লাস্টার্স। সাসপেনশন ও চোট-আঘাতে জর্জরিত কেরালার দলটি ৩২ মিনিটের মাথায় এগিয়ে যায় দাইসুকে সাকাইয়ের সুযোগসন্ধানী গোলে। ৮৮ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস। এই গোলের আগেই পেনাল্টি থেকে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন যিনি, সেই ক্লেটন সিলভাই স্টপেজ টাইমের একেবারে শেষ দিকে ফের পেনাল্টির সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি গোল শোধ করেন।

আক্রমণে এ দিন যতটা বিষহীন লেগেছে ইস্টবেঙ্গলকে, রক্ষণে তার চেয়ে বেশি দুর্বল মনে হয়েছে তাদের। ঘরের মাঠে, গ্যালারিতে যেখানে হাজার হাজার সমর্থকের উল্লাস, সেখানেও লাল-হলুদ ফুটবলারদের উজ্জীবিত হয়ে উঠতে না পারার কারণ এখনও অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য রয়ে গেল। আইএসএলে এই নিয়ে কলকাতায় ১৪টি ম্যাচ খেলল তারা। তার মধ্যে ন’টিতেই হারল। এ পর্যন্ত ঘরের মাঠে তারা মাত্র তিনবার জয় পেয়েছে। বাকি দু’বার ড্র হয়েছে।

বরং ইস্টবেঙ্গলের মাঠে এসে এ দিন দুর্দান্ত ফুটবল দেখিয়ে গেল কেরালা ব্লাস্টার্স। প্রাক্তন মোহনবাগান তারকা প্রীতম কোটালের সতীর্থদের উজ্জীবিত ফুটবল রীতিমতো ছত্রভঙ্গ করে দেয় লাল-হলুদ বাহিনীকে। বরাবরের মতো এ দিনও তাদের অধিনায়ক আদ্রিয়ান লুনাই দলকে সাফল্যের রাস্তা দেখিয়ে দেন। তবে তরুণ গোলকিপার শচীন সুরেশের অসাধারণ পারফরম্যান্সও এই জয়ের অন্যতম উপাদান।

উরুগুয়ের এই তারকা ফরোয়ার্ড এ দিন ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে রীতিমতো ত্রাস হয়ে ওঠেন। বারবার গোলের সুযোগ তৈরি করে লাল-হলুদ রক্ষণকে কড়া পরীক্ষার মুখে ফেলে দেন তিনি। যদিও গোলমুখী শটের দিক থেকে ইস্টবেঙ্গলই এগিয়ে ছিল এ দিন। লাল-হলুদ বাহিনী যেখানে সারা ম্যাচে চারটি শট গোলে রাখে, সেখানে ব্লাস্টার্সের তিনটি শট গোলমুখী ছিল। তার মধ্যে দু’টিই গোলে পরিণত করে তারা।

বলা যায় লুনাই এ দিন ব্লাস্টার্সকে ৩২তম মিনিটে প্রথম গোলটি এনে দেন। মাঝমাঠ পেরিয়ে বাঁদিকে সাকাইকে লক্ষ্য করে যে ফরোয়ার্ড পাসটি বাড়ান তিনি, তাতেই কার্যত গোলের ঠিকানা লেখা ছিল। কারণ, তখন ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ কার্যত ফাঁকা ছিল। সুকেই মহম্মদ রকিপকে ধোঁকা দিয়ে বল নিয়ে বক্সে ঢুকে যখন গোলের ডানদিকে কোণ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন, তখন তাঁর সামনে গোলকিপার প্রভসুখন গিল ছাড়া আর কেউ ছিলেন না (১-০)। আইএসএলের ইতিহাসে সাকাই চতুর্থ জাপানি গোলদাতা।

কেরালার আক্রমণে যদি সেরা অস্ত্র হয়ে থাকেন লুনা, তা হলে তাদের রক্ষণের শেষ প্রহরী, গোলকিপার শচীন সুরেশ হয়ে ওঠেন দুর্ভেদ্য দেওয়ালের মতো। গত ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও পেনাল্টি সেভ করে দলকে নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে বাঁচান তিনি। ৮৫ মিনিটের মাথায় সমতা আনার যে সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন ক্লেটন সিলভা, তা মূলত শচীনের জন্যই বানচাল হয়ে যায়।

যদিও ক্লেটন পেনাল্টি আদায় করেন শচীনের ভুলেই। গোলমুখী ক্লেটনের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিতে গিয়ে তিনি ক্লেটনের পায়েই আঘাত করে বসেন এবং রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। প্রথম সুযোগে পেনাল্টি শট নেওয়ার সময় শচীন লাইন থেকে এগিয়ে এসে সেই শট বাঁচান বলে রেফারি ক্লেটনকে আবার পেনাল্টি মারার সুযোগ দেন। কিন্তু এবারেও ক্লেটনের শট শচীন লাইনে থেকেই দুর্দান্ত ভাবে আটকে দেন। তাঁর হাত থেকে ছিটকে আসা বলও জালে জড়ানোর সুযোগ পেয়ে যান ক্লেটন। কিন্তু এ বারও তাঁর শট বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। এই নিয়ে আইএসএলে পাওয়া ন’টি পেনাল্টির মধ্যে তিনটি সুযোগ হাতছাড়া করল ইস্টবেঙ্গল।

এমন সোনায় মোড়া সুযোগ পেয়েও তা হাতছাড়া হওয়ায় যখন কার্যত ভেঙে পড়ে লাল-হলুদ শিবির, তখনই ফের ধাক্কা খায় তারা। এ বার ৮৮ মিনিটের মাথায় সন্দীপ সিংয়ের বাড়ানো বল রকিপ বক্সের মধ্যে ব্লক করতে না পারায় তা ছিটকে আসে সম্পুর্ণ অরক্ষিত গ্রিক স্ট্রাইকার দিয়ামান্তাকসের পায়ে। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি (২-০)। কিন্তু জার্সি খুলে সেলিব্রেশন করার জন্য তাঁকে হলুদ কার্ড দেখতে হয়, যা ছিল এই ম্যাচে তাঁর দ্বিতীয় হলুদ কার্ড। ফলে ৮৯ মিনিটের মাথায় লাল কার্ড দেখে তিনি মাঠ ছাড়েন।

নাটক এখানেই শেষ হয়নি। মোট সাত মিনিটের স্টপেজ টাইম দেন রেফারি। কিন্তু ম্যাচ গড়ায় দশ মিনিট পর্যন্ত। নবম মিনিটে নিজেদের বক্সের মধ্যে উড়ে আসা বল দখল করতে গিয়ে তাতে হাত লাগিয়ে ফেলেন সন্দীপ সিং। ফলে আবার পেনাল্টি পায় ইস্টবেঙ্গল। এ বারও শট নিতে যান অধিনায়ক ক্লেটন নিজেই। তবে এ বার আর ভুল করেননি তিনি। কিন্তু তখন আর সমতা আনার কোনও সময় ছিল না।

৮৫ মিনিটের মাথায় পাওয়া পেনাল্টি থেকে ক্লেটন গোল করতে পারলে ম্যাচের ছবিটাই বদলে যেত। কিন্তু সেটা আর হল না। চলতি মরশুমে ইস্টবেঙ্গল চারটি হোম ম্যাচের (ভুবনেশ্বর-সহ) মধ্যে তিনটিতেই হরল। দেখা যাচ্ছে, ঘরের মাঠই তাদের কাছে ব্যর্থতার কেন্দ্র হয়ে উঠছে।

ইস্টবেঙ্গল এফসি দল: প্রভসুখন গিল (গোল), মন্দার রাও দেশাই (নিশু কুমার), হোসে পার্দো, লালচুঙনুঙ্গা (ভিপি সুহের), মহম্মদ রকিপ, নাওরেম মহেশ সিং, হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা (শৌভিক চক্রবর্তী), সল ক্রেসপো (হিজাজি মাহের), নন্দকুমার শেখর, হাভিয়ে সিভেরিও, ক্লেটন সিলভা।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: ইস্টবেঙ্গল এফসি ৬০% - কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি ৪০% , সফল পাসের হার: ৭৭%-৬৪%, গোলে শট: ৪-৩, ফাউল: ৯-১৮, ইন্টারসেপশন: ৭-১২, ক্রস: ২২-১১, কর্নার: ৬-৫, হলুদ কার্ড: ৩-৩, লাল কার্ড: ০-১

ম্যাচের সেরা: শচীন সুরেশ