কলকাতার ফুটবল যেখানে কলকাতার দুই প্রধান ক্লাব মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল কেন্দ্রিক, সেখানে একটা ক্লাব ধারাবাহিক ভাবে ভাল করলে অপর ক্লাবেরও ভাল কিছু করে দেখানোর তাগিদ থাকে। তাই মোহনবাগান গত তিন মরশুম ধরে যথেষ্ট ভাল ফল করায় ইস্টবেঙ্গলেরও সেই তাগিদ ছিল। কিন্তু কোনওবারই তারা সফল হয়ে উঠতে পারেনি ঠিকমতো দল গঠন করতে না পারায় এবং সঠিক ভাবে দলকে চালনা করার লোকের অভাবে। 

এ বার এই দুই সমস্যাই মেটানোর চেষ্টা করে লাল-হলুদ বাহিনী। একজন ভাল কোচ নিয়ে আসার পাশপাশি একাধিক ভাল ফুটবলারও নিয়ে আসে তারা। কিন্তু তাতেও যে খুব একটা লাভ হয়েছে, তা নয়। ইস্টবেঙ্গল শেষ পর্যন্ত সেই লিগ টেবলের নীচের অর্ধেই রয়ে যায়। আগের তিন বারে যেমন যথাক্রমে ৯, ১১ ও ৯ নম্বরে ছিল তারা, এ বারেও সেই নবম স্থানেই থেকে লিগ শেষ করে তারা। কিন্তু এক সময় সেরা ছয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল তারা। 

কিন্তু সেরা ছয়ের কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয় তাদের, শেষ ম্যাচে পাঞ্জাব এফসি-র কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করায়। লিগ টেবলের ১১ নম্বরে নেমে যাওয়া পাঞ্জাব এফসি তাদের অনায়াসে ৪-১-এ হারিয়ে লিগ শেষ করে আট নম্বরে থেকে। 

দলবদলে নতুন উদ্যম 

এ বার মরশুম শুরুর অনেক আগে থেকেই নতুন উদ্যমে মাঠে নেমে পড়ে লাল-হলুদ শিবির। প্রথমে একজন ভাল কোচ বাছাই, তার পরে একটা ভাল দল বাছা এবং সেই দলটাকে তৈরি করার জন্য ভাল প্রাক-মরশুম প্রস্তুতির ব্যবস্থা করা, এ সবই করে ইস্টবেঙ্গল কর্তৃপক্ষ। যার ফল তারা মরশুমের শুরুতেই পায় ডুরান্ড কাপের আসরে এবং পরে সুপার কাপেও।  

গত ৫৫ মাস ধরে টানা একতরফা ব্যর্থতার জ্বালা গত ১২ অগাস্ট উপশম হয় ডার্বি জয়ের মাধ্যমে। অসাধারণ এক গোল করে দলকে বহু আকাঙ্খিত জয় এনে দেন ইস্টবেঙ্গলের নতুন ‘হিরো’, নন্দকুমার শেকর। সেই ডার্বির আগে ধারে ও ভারে এবং সাম্প্রতিক সাফল্যের বিচারে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিলেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রাক্তন আইএসএল চ্যাম্পিয়ন কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতের ইস্টবেঙ্গল সে দিন সবাইকে ভুল প্রমাণ করে মরশুমের প্রথম ডার্বি জিতে নেয় লাল-হলুদ বাহিনী।

শুধু এই জয় নয়, টানা চার ম্যাচে অপরাজিত থেকে ডুরান্ডের ফাইনালে ওঠে তারা। ফাইনালে ফের চিরপ্রতিদ্বন্দী মোহনবাগান এসজি-রই মুখোমুখি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাইনাল জিতে নেয় মোহনবাগান। জিততে না পারলেও এ মরশুমে যে ঘুরে দাঁড়াবে তার ইঙ্গিত প্রথম টুর্নামেন্টেই দিয়ে রাখে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু মরশুমের মাঝখানে কয়েকটি সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই শেষ হয়ে যায়।  

গত আইএসএলে ন’নম্বরে থেকে লিগ শেষ করার পর দলের এক ঝাঁক ফুটবলারকে ছেড়ে দেয় লাল-হলুদ বাহিনী। এ মরশুমের জন্য তাই ঢেলে দল সাজানো হয়েছে। সিনিয়র ডিফেন্ডার হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা, মান্দার রাও দেশাইকে নেয় তারা। ওডিশা এফসি থেকে সফল ভারতীয় উইঙ্গার নন্দকুমার শেখর, কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে ডিফেন্ডার নিশু কুমারকেও সই করায় কলকাতার ক্লাব। কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে তিন বছরের জন্য তারা নিয়ে আসে পাঞ্জাবের গোলকিপার প্রভসুখন গিলকেও। এ ছাড়া যে দেশীয় ফুটবলাররা গতবারও ছিলেন, সেই ডিফেন্ডার লালচুঙনুঙ্গা, মিডফিল্ডার শৌভিক চক্রবর্তীরা দলে থেকে যান। 

স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড হাভিয়ে সিভেরিও ও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার সল ক্রেসপোকে সই করায় কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। এ ছাড়া হায়দরাবাদ এফসি থেকে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার বোরহা হেরেরা গঞ্জালেসকেও নিয়ে আসা হয়। যোগ দেন আর এক স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হোসে পার্দো। এ ছাড়া গত মরশুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা ব্রাজিলিয়ান ক্লেটন সিলভা তো ছিলেনই। অস্ট্রেলিয়া থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার জর্ডন এলসিকে। কিন্তু ডুরান্ড কাপের ফাইনালে হাঁটুর চোট পেয়ে ছিটকে যান। 

‘জাদুকর’ কুয়াদ্রাতের আগমন  

দল পরিচালনার জন্য প্রাক্তন আইএসএলজয়ী কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাঁর সহকারী প্রাক্তন ছিলেন আইএসএল জয়ী ফুটবলার দিমাস দেলগাদো। ভারতে কোচিং করানোর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে ৫৪ বছর বয়সী কুয়াদ্রাতের। তা কাজেও লাগান তিনি। 

কতটা কী করতে পারেন কুয়াদ্রাত, তার ইঙ্গিত ডুরান্ড কাপ ও সুপার কাপেই দেন তিনি। লাল-হলুদ শিবিরে যোগ দেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, এটাই তাঁর কোচিং জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ডুরান্ড কাপে প্রথম ধাপ পেরনোর পরে জানিয়েছিলেন, প্রথমবার আইএসএলের নক আউটে জায়গা অর্জন করাটাই তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তই তাঁকে ডোবায়। 

টানা নয় ম্যাচে অপরাজিত!

জামশেদপুরের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্রয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে ক্লেটন সিলভা ফর্মে ফেরেন। দলও জয়ে ফেরে। ব্রাজিলীয় তারকার জোড়া গোলে চলতি লিগের প্রথম জয় পায় তারা। বেঙ্গালুরুতে ফের ছন্দপতন হয় তাদের। ২-১-এ তাদের হারিয়ে লিগের প্রথম জয় পায় সুনীল ছেত্রীর দল। এর পরে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ৭৩ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থাকার পরে দু’মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল খেয়ে ১-২-এ হেরে মাঠ ছাড়তে হয় তাদের। 

কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ফের ১-২-এ হারে লাল-হলুদ বাহিনী। এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ৮৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন ক্লেটন সিলভা। চেন্নাইনের বিরুদ্ধেও ৮৫ মিনিট পর্যন্ত এক গোলে এগিয়ে থাকার পর গোল খেয়ে জেতা ম্যাচ ১-১ ড্র করে লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু নর্থইস্টের বিরুদ্ধে তাদের ৫-০-য় জয় আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেয় তাদের। কিন্তু পাঞ্জাব, মুম্বই সিটি এফসি ও ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে তাদের পরপর তিন ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়। দুর্দান্ত কৌশলী ফুটবল খেলে মুম্বই সিটি এফসি-র পর ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধেও গোলশূন্য ড্র করায় টানা চারটি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রাখে তারা। 

সারা মরশুমে এই সময়টাতেই সবচেয়ে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখা যায় ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে। ৪ নভেম্বর আইএসএলে কেরালা ব্লাস্টার্সের কাছে হারের পর থেকে টানা ন’টি ম্যাচে হারেনি লাল-হলুদ বাহিনী। এর মধ্যে চারটিতে ড্র ও পাঁচটিতে জয় পায় তারা। সুপার কাপে চারটি ম্যাচে জেতে তারা। এমন ধারাবাহিকতা বহুদিন দেখা যায়নি ইস্টবেঙ্গলের খেলায়। 

বারো বছর পর ট্রফিজয়, কিন্তু...  

আইএসএলের মাঝখানেই জানুয়ারির আন্তর্জাতিক অবকাশের সময় কলিঙ্গ সুপার কাপে টানা ১৫ ম্যাচে অপরাজিত থাকা গতবারের চ্যাম্পিয়ন ওডিশা এফসি-কে তাদের ঘরের মাঠে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল এফসি। সে দিন তারা ওডিশার ধারাবাহিক সাফল্যের দৌড় থামায় ৩-২-এ জিতে। দীর্ঘ ১২ বছর পর জাতীয় পর্যায়ের কোনও ট্রফি জেতে কলকাতার শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। ২০১২-য় ফেডারেশন কাপ জয়ের পর ২০২৪-এর সুপার কাপ। শুধু এই ট্রফি নয়, আগামী মরশুমে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এ খেলার ছাড়পত্রও পেয়ে যায় তারা। 

সুপার কাপ জিতলেও জানুয়ারির অবকাশের আগে ও পরে ইস্টবেঙ্গলের আইএসএল পারফরম্যান্সের খতিয়ানে খুব একটা তফাৎ হয়নি। অবকাশের আগে তারা দশটি ম্যাচে ১১ পয়েন্ট অর্জন করে। জিতেছিল মাত্র দুটি ম্যাচ, পাঁচটিতে ড্র করে। অবকাশের পর তারা চারটি ম্যাচে জিতলেও একটিতে ড্র করে ও ছ’টি ম্যাচে হেরে ১৩ পয়েন্ট অর্জন করে। জানুয়ারির অবকাশের পর হারের সংখ্যা বাড়লেও সেই প্রথম আইএসএলে টানা দুটি ম্যাচে জেতে ইস্টবেঙ্গল। কেরালা ব্লাস্টার্সকে ৪-২-এ হারানোর পর বেঙ্গালুরু এফসি-কেও হারায় ২-১-এ। 

লিগের শেষ ম্যাচে পাঞ্জাব এফসি-কে হারিয়ে জয়ের হ্যাটট্রিক করতে পারলে হয়তো প্রথমবার আইএসএল প্লে-অফে পা রাখত তারা। সেই ম্যাচের আগে ছ’নম্বর জায়গার দৌড়ে লড়াইয়ে ছিল শুধু ইস্টবেঙ্গল এবং চেন্নাইন এফসি। কিন্তু পাঞ্জাবের কাছে হেরে সেই লড়াই থেকেও ছিটকে যায় তারা। 

কোথায় বড় ভুল? 

সুপার কাপের পরে হাভিয়ে সিভেরিও ও বোরহা হেরেরাকে অন্য ক্লাবে খেলার জন্য ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মরশুম শেষে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। সুপার কাপে দু’জনেই ফর্মে ছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁদের অন্য ক্লাবে যাওয়ার অনুরোধ ফেলতে পারেননি কোচ কুয়াদ্রাত। কিন্তু তাঁদের পরিবর্তে যাঁদের আনেন, সেই ফরোয়ার্ড ফেলিসিও ব্রাউন ফোর্বস ও ভিক্টর ভাজকেজ কেউই তেমন কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেননি। ব্রাউন দশটি ম্যাচে মাঠে নামলেও একটির বেশি গোল করতে পারেননি। ভাজকেজ ন’টি ম্যাচে মাত্র একটি অ্যাসিস্ট করেন। কোনও গোল করতে পারেননি। দেখা যায় সিভেরিও ও বোরহা অন্য ক্লাবে গিয়ে ভাল খেলতে শুরু করেন। 

ব্রাউন ও ভাজকেজ দু’জনেই ভারতে প্রথম আসেন। ফলে এখানকার পরিবেশ ও নতুন দলের খেলার ধরন ও সতীর্থদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় প্রয়োজন ছিল তাঁদের। কিন্তু যথেষ্ট সময় পাননি তাঁরা। এর মধ্যে সল ক্রেসপোও চোট পেয়ে যান। ফলে তাঁদের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে যায়, শুরু থেকেই যে চাপ নিয়ে ভাল খেলা বেশ কঠিন ছিল। যদিও কুয়াদ্রাত কখনও মানতে চাননি, সিভেরিও ও বোরহাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছিল তাঁর। কিন্তু তাঁরা চলে যাওয়ার পরে যে পারফরম্যান্সে উন্নতি করতে পারেনি লাল-হলুদ বাহিনী, তা পরিসংখ্যানই বলে দেয়। 

পরের মরশুমে যা দরকার 

দলে অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন ইস্টবেঙ্গল শিবিরে। প্রথমত, দলের আক্রমণ বিভাগে ঢালাও বদল প্রয়োজন। ক্লেটন সিলভাকে যোগ্য সঙ্গত দেওয়ার মতো ভাল বিদেশী ফুটবলার দলকার। তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের যেমন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও জেসন কামিংস জুটি আছে, সে রকম অ্যাটাকার জুটি চাই লাল-হলুদের। এমনকী রক্ষণেও দক্ষ ও শক্তিশালী ফুটবলার প্রয়োজন। মাঝমাঠে শৌভিক চক্রবর্তীর চাপ কমানোর জন্য ও তাঁর মতো করে খেলার মতো একজন দেশীয় বা বিদেশী মিডফিল্ডার প্রয়োজন দলের। 

তবে প্রতিবার যে কোচ বদলের হাওয়া ওঠে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে, তা না উঠলেই ভাল। কুয়াদ্রাত কোচ হিসেবে যথেষ্ট দক্ষ ও সুকৌশলী। দলটা ক্রমশ গড়ে তুলছেন। সামনেই এএফসি কাপের খেলাও আছে তাদের সামনে। সেখানে আরও কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে তাদের। এই লড়াইয়ে সফল হতে হলে কুয়াদ্রাতকে আরও ভাল ভাল খেলোয়াড়দের দিয়ে দল সাজাতে হবে। নিশ্চয়ই তা করবেন তিনি। তার প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করে দিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো আরও উন্নত ও আগ্রাসী ইস্টবেঙ্গলকে দেখা যাবে আগামী মরশুমে।