গোলশূন্য ড্রয়ে আইএসএল মরশুমের সূচনা ইস্টবেঙ্গল এফসি, জামশেদপুর এফসি-র
বাড়তি সময়-সহ প্রায় একশো মিনিটের উপভোগ্য না হয়ে ওঠা ম্যাচের পর বিফল মনোরথেই মাঠ ছাড়তে হল দুই দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের।
দুই দলের আগোছালো ফুটবল, মাঝমাঠ ও আক্রমণে সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং দু’পক্ষের রক্ষণের তৎপরতার যোগফল গোলশূন্য ড্র। সোমবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ইস্টবেঙ্গল এফসি ও জামশেদপুর এফসি-র মধ্যে ম্যাচের ফল এমনই। গত মরশুমে কলকাতার দল ছিল লিগ টেবলের ন’নম্বরে ও তাদের প্রতিবেশী রাজ্যের দল ছিল দশে। এ দিন দুই দল যে পারফরম্যান্স দেখাল, তাতে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সেই জায়গা থেকে এখনও উঠে আসতে পারেনি কোনও পক্ষই।
আইএসএলে ঘরের মাঠে ইস্টবেঙ্গলের রেকর্ড অন্যান্য দলের চেয়ে খারাপ। এ দিনও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখল তারা। আগের দিন সাংবাদিক বৈঠকে ঘরের মাঠে সমর্থকদের খুশি করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামার কথা বলেছিলেন লাল-হলুদ শিবিরের কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। কিন্তু চলতি আইএসএলে যে ভাবে অভিযান শুরু করল তাঁর দল, তাতে সমর্থকদের খুশি হওয়ার তেমন কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।
অন্যদিকে, ইস্পাতনগরীর দলেও বোঝাপড়ার স্পষ্ট অভাব দেখা যায় এ দিন। ডুরান্ড কাপে তাদের যে খেলোয়াড়রা তিন ম্যাচে এগারো গোল খেয়েছিল, এই দল তার চেয়ে অনেক ভাল বলে দাবি করেছিলেন কোচ স্কট কুপার। কিন্তু তাঁর দলের খেলায় তা প্রমাণিত হল না। দেশীয় ফুটবলারদের সঙ্গে বিদেশিদের যোগাযোগের অভাব ও বিদেশি ফুটবলারদের দক্ষতা দুই বিষয়েই অনেক প্রশ্ন থেকে গেল এ দিনের ম্যাচের পর। বাড়তি সময়-সহ প্রায় একশো মিনিটের উপভোগ্য না হয়ে ওঠা ম্যাচের পর তাই বিফল মনোরথেই মাঠ ছাড়তে হল দুই দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের।
এ দিন প্রথমার্ধে যাও বা কিছুটা ভাল ফুটবল খেলার তাগিদ দেখা যায় দুই দলের মধ্যে, দ্বিতীয়ার্ধে তেমন কিছুই দেখা যায়নি। প্রথমার্ধে ইস্টবেঙ্গল তিনটি শট গোলে রাখে। জামশেদপুরের একটি শট ছিল গোলে। দ্বিতীয়ার্ধে কোনও দলই কোনও শট গোলে রাখতে পারেনি। একের পর এক লক্ষ্যভ্রষ্ট শট নেন দুই দলের ফুটবলাররা। ইস্টবেঙ্গলের হাভিয়ে সিভেরিও, সল ক্রেসপো, মহেশ সিং, নন্দকুমার শেখররা যেমন হতাশ করেন, তেমনই জামশেদপুরের ড্যানিয়েল চিমা, অ্যালেন স্তেভানোভিচরাও কম হতাশ করেননি।
এ দিন ক্লেটন সিলভাকে দলের বাইরে রেখেই প্রথম এগারো নামান ইস্টবেঙ্গল কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। তিনি দ্বিতীয়ার্ধে নেমে একেবারেই কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেননি। সামনে হাভিয়ে সিভেরিওকে রেখে ও তাঁর পিছনে মহেশ সিং, বোরহা হেরেরা, নন্দকুমার শেখর, শৌভিক চক্রবর্তী, রেখে ৪-১-৪-১-এ দল সাজান কুয়াদ্রাত। তবে তাঁর দল বেশিরভাগ সময়েই সঠিক শেপে ছিল না। অন্য দিকে, জামশেদপুর এফসি ড্যানিয়েল চিমাকে সামনে রেখে দল সাজায়। তাঁর পিছনে অ্যালেন স্তেভানোভিচ ও নিখিল বারলাকে রেখে। দলের নির্ভরযোগ্য বঙ্গ অ্যাটাকার ঋত্বিক দাসের চোট। তাই তাঁকে দলের সঙ্গেই আনা হয়নি। ঋত্বিকের অভাব এ দিন ভীষণ ভাবে টের পেয়েছেন কোচ কুপার।
শুরুর দিকে মূলত বাঁ উইং ব্যবহার করে আক্রমণ শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। বাঁ দিক থেকে মহেশের ক্রস থেকে সিভেরিও দু’বার গোলের সুযোগ পেলেও জামশেদপুরের ডিফেন্ডারদের তৎপরতায় তিনি তা হাতছাড়া করেন। তুলনায় জামশেদপুরের আক্রমণের সংখ্যা ছিল কম। মূলত ড্যানিয়েল চিমাকেই বারবার গোলের পাস বাড়ান তাঁর সতীর্থরা। কিন্তু লাল-হলুদ রক্ষণ ছিল সজাগ।
খেলা মিনিট কুড়ি গড়ানোর পর থেকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় জামশেদপুরের ফুটবলারদের মধ্যে। তারা মূলত ডানদিকের উইং দিয়ে আক্রমণে ওঠে। ঘরের মাঠের সুবিধা নিয়ে ইস্টবেঙ্গল যে তাদের সমানে চাপে রাখতে পারবে না, পরপর কতগুলি মুভ-এ সেরকমই ইঙ্গিত দেয় ইস্পাতনগরীর দল।
তবে ৩৮ মিনিটের মাথায় এক গোলে দলকে এগিয়ে দেওয়ার যে সুবর্ণ সুযোগটি পান সিভেরিও, তা হাতছাড়া করাটাই কঠিন। বাঁ দিক দিয়ে ওঠা বোরহা হেরেরার নিখুঁত ক্রস গোলের সামনে এসে পড়লে সেখানে পৌঁছেও যান সিভেরিও। কিন্তু ছ’গজের বক্সের মাথা থেকে নেওয়া শট বারের ওপর দিয়ে চলে যায়!
এই আক্রমণের পর থেকে প্রথমার্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় লাল-হলুদ ঝড় তোলেন সিভেরিওরা। ৪৩ মিনিটের মাথায় গোলকিপার টিপি রেহনেশ প্রথমে হেরারা ও পরে মহেশের অবধারিত গোলের শট না বাঁচালে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যেতে পারত ইস্টবেঙ্গল। তার আগে বোরহার ক্রস নন্দকুমার ও সিভেরিও ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে অবশ্যই গোল পেতেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টাই বিফলে যায়।
জামশেদপুরও পাল্টা আক্রমণে ওঠে। প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ে স্তেভানোভিচের কাট ব্যাক থেকে বল পেয়ে সোজা গোলে শট নেন জেরেমি মানজোরো, যা আটকে দেন লাল-হলুদ গোলপ্রহরী প্রভসুখন গিল।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা শুরু করে জামশেদপুর এফসি। ৫১ মিনিটের মাথায় ইস্টবেঙ্গলের বক্সের মধ্যে মহেশের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে গোলে কোণাকুনি শট নেন প্রণয় হালদার, যা সাইড নেটে লাগে।
গোল পাওয়ার উদ্দেশ্যে ৫৭ মিনিটের মাথায় হেরেরার জায়গায় ক্লেটন সিলভাকে নামান কুয়াদ্রাত। শৌভিক চক্রবর্তীর জায়গায় নামান মহম্মদ রকিপকে। জামশেদপুরও চিমাকে তুলে নিয়ে জাপানি অ্যাটাকার তাচিকাওয়াকে নামায়। সঙ্গে প্রণয় ও নঙদম্বা নাওরেমও মাঠ ছাড়েন সেম্বয় হাওকিপ ও মহম্মদ সানানকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য।
অনেক সুযোগ পেলেও ইস্টবেঙ্গলের খেলায় এ দিন যেমন নিখুঁত পরিকল্পনার অভাব দেখা যায়, তেমনই ট্রানজিশনেও গতির অভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেক ভুল পাসও করে তারা। শেষ ১৫ মিনিটে তাদের বেশ কিছুটা ক্লান্তও হয়ে পড়তে দেখা যায়।
তার মধ্যেও অবশ্য মাঝে মাঝে বিপজ্জনক ভাবে প্রতিপক্ষের এলাকায় হানা দেয় তারা। ৬৯ মিনিটের মাথায় মাঝ মাঠ থেকে উড়ে আসা বল ধরে বক্সের মধ্যে থেকে তা সল ক্রেসপোকে ব্যাকপাস করেন নন্দকুমার। বক্সের বাইরে থেকে ক্রেসপো সোজা গোলে জোরালো শট নিলেও অল্পের জন্য তা পোস্টের বাইরে চলে যায়।
নিখিল বারলা ও ব্রাজিলীয় ডিফেন্ডার এলসিনহো ছাড়া জামশেদপুরের কোনও খেলোয়াড়ই এ দিন মনে ছাপ ফেলার মতো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। তাঁরাও প্রচুর ভুল পাস করেন, গোলের সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি। যেমন ৮২ মিনিটের মাথায় ডানদিক থেকে নিখুঁত ক্রস বাড়ান মহম্মদ সানান, যা বক্সের মধ্যে পড়ে সম্পুর্ণ অরক্ষিত হাওকিপের পায়ে। কিন্তু তিনি ইনসাইড স্টেপ ব্যবহার না করে আউটসাইড স্টেপে শট মারায় বল গোলের বাইরে চলে যায়।
নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে বক্সের মধ্যে বল ধরে গোলে শট নিতে যান ইমরান খান। কিন্তু তাঁকে বাধা দেন হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা, যার জেরে পেনাল্টির জোরালো দাবি জানান জামশেদপুরের খেলোয়াড়রা। কিন্তু রেফারি তাতে সাড়া দেননি।
সাত মিনিটের বাড়তি সময়ে একবার হাওকিপের হেড পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে সল ক্রেসপোকে ফাউল করেন মহম্মদ সানান, যার জেরে মেজাজ হারিয়ে এমিল বেনিকে ধাক্কা মারেন ক্রেসপো। এই অপরাধের জন্য ক্রেসপোকে হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। কিন্তু অযথা তর্ক করার জন্য বেনিকে লাল কার্ড দেখানো হয়। পরমুহূর্তেই অবশ্য সেই সিদ্ধান্ত বদলে তাঁকে শুধু হলুদ কার্ড দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই সময়ে অনেক নাটক হলেও আসল জিনিসটা দেখা যায়নি, যাকে ফুটবলের পরিভাষায় বলে গোল।
ইস্টবেঙ্গল এফসি দল: প্রভসুখন গিল (গোল), নিশু কুমার (এডুইন ভন্সপল), মন্দার রাও দেশাই, সল ক্রেসপো, হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা, হোসে পার্দো, নন্দকুমার শেখর, শৌভিক চক্রবর্তী (মহম্মদ রকিপ), মহেশ সিং (গুইতে পেকা), বোরহা হেরেরা (ক্লেটন সিলভা), হাভিয়ে সিভেরিও।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: ইস্টবেঙ্গল এফসি ৫৬% - জামশেদপুর এফসি ৪৪%, সফল পাসের হার: ৮১-৭৯, গোলে শট: ৩-১, ফাউল: ৬-৭, ইন্টারসেপশন: ৯-৭, ক্রস: ২৭-২৬, কর্নার: ৬-৯, হলুদ কার্ড: ২-৪,
ম্যাচের সেরা: এলসিনহো