নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের পর পেনাল্টি শুট আউট জিতে ১৯ বছর পর ডুরান্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল
নাটকীয় প্রত্যাবর্তন একেই বলে। দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও শেষ কুড়ি মিনিটে দু’গোল দিয়ে সমতা আনা এবং পেনাল্টি শুট আউটে ম্যাচ জেতা, যা মঙ্গলবার করে দেখাল ইস্টবেঙ্গল এফসি। চলতি ডুরান্ড কাপের সেমিফাইনালে এই অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে লাল-হলুদ বাহিনীর নাম লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে। নির্ধারিত সময়ে ২-২ থাকার পরে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কে টাইব্রেকারে ৫-৩-এ হারিয়ে ১৯ বছর পরে ডুরান্ডের ফাইনালে উঠল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব।


নাটকীয় প্রত্যাবর্তন একেই বলে। দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও শেষ কুড়ি মিনিটে দু’গোল দিয়ে সমতা আনা এবং পেনাল্টি শুট আউটে ম্যাচ জেতা, যা মঙ্গলবার করে দেখাল ইস্টবেঙ্গল এফসি। চলতি ডুরান্ড কাপের সেমিফাইনালে এই অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে লাল-হলুদ বাহিনীর নাম লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে। নির্ধারিত সময়ে ২-২ থাকার পরে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কে টাইব্রেকারে ৫-৩-এ হারিয়ে ১৯ বছর পরে ডুরান্ডের ফাইনালে উঠল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব।
এভাবেও ফিরে আসা যায়? একদম যায়! 👊
— East Bengal FC (@eastbengal_fc) August 29, 2023
We are the first finalists of #DurandCup 2023! ❤️💛#DurandCup #JoyEastBengal #EmamiEastBengal #NEUFCEEBFC pic.twitter.com/d0aoJZoyCi
এই টুর্নামেন্টেরই প্রথম ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল যে ভাবে দু’গোলে এগিয়ে থাকার পরও শেষ আট মিনিটে দু’গোল খেয়ে হাতের মুঠোয় আসা জয় হাতছাড়া করেছিল, এ দিন সে ভাবেই নর্থইস্ট ইউনাইটেডের নিশ্চিত জয় তাদের হাতের মুঠো থেকে বের করে এনে টাই ব্রেকারে ম্যাচ জিতে নিল।
এ দিন ম্যাচের ৭৫ মিনিট পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে রীতিমতো দমিয়ে রেখে দু’গোলে এগিয়ে ছিল নর্থইস্ট ইউনাইটেড। ২২ মিনিটে মিগুয়েল জাবাকো ও ৫৭ মিনিটে ফাল্গুনী সিংয়ের গোল তাদের প্রথমবার ডুরান্ড কাপের ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। ম্যাচের বেশিরভাগ সময়ে আগোছালো ও দিশাহীন ফুটবল খেলা ইস্টবেঙ্গল প্রতিপক্ষের ক্লান্তি ও আত্মতুষ্টির সুযোগ নিয়ে শেষ দশ মিনিটে আক্রমণের ঝড় তোলে এবং ৭৭ মিনিটের মাথায় মহেশ সিংয়ের শট দীনেশ সিংয়ের পায়ে লেগে গোলে ঢুকে যায়।
আট মিনিটের বাড়তি সময়ের একেবারে শেষে, ৯৭ মিনিটের মাথায় হেডে সমতা এনে ফেলেন মরশুমের প্রথম কলকাতা ডার্বির নায়ক নন্দকুমার শেখর। টাই ব্রেকারে নর্থইস্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা পার্থিব গগৈয়ের শট প্রথমে ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার প্রভসুখন গিল সেভ করেন। রেফারি পার্থিবকে ফের আর একবার শট নেওয়ার সুযোগ দিলেও তাঁর দ্বিতীয় শটও ক্রসবারে ধাক্কা খায়। ইস্টবেঙ্গলের কেউই পেনাল্টির সুযোগ নষ্ট করেননি। ফলে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে তারাই জেতে।
ঐতিহ্যবাহী ডুরান্ড কাপে ইস্টবেঙ্গল শেষবার ফাইনালে উঠেছিল ২০০৪-এ। সেবার তারা চিরপ্রতিদ্বন্দী মোহনবাগানকে ২-১-এ হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। তার পর থেকে আর ডুরান্ডের ফাইনালে ওঠা হয়নি তাদের। কার্লস কুয়াদ্রাতের প্রশিক্ষণে ফের সেই সন্মান অর্জন করল ১৬ বারের চ্যাম্পিয়নরা। আগামী রবিবার ২০০৪-এর সেই ফাইনাল আবার দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন ফুটবলপ্রেমী জনতা। বৃহস্পতিবার অপর সেমিফাইনালে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট যদি এফসি গোয়াকে হারাতে পারে, তা হলে সেই আশা পূরণ হতে পারে তাদের।
এ দিন শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করে ইস্টবেঙ্গল এফসি। কিন্তু ক্রমশ তাঁদের পা থেকে বল কেড়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে নিয়ে আসে নর্থইস্ট। ফাল্গুনী সিং ও পার্থিব গগৈ লাল-হলুদ রক্ষণকে ব্যস্ত রাখেন। ১৫ মিনিটের মাথায় ডানদিকে ডাইভ দিয়ে সল ক্রেসপোর প্রায় অবধারিত গোল বাঁচান নর্থইস্টের গোলকিপার মিরশাদ মিচু। এটিই ছিল ম্যাচের প্রথম গোলে শট।
ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণে এদিন তেমন তীব্রতা এবং সুপরিকল্পনা ছিল না, যার সুযোগ নিয়ে নর্থইস্ট পাল্টা আক্রমণে ওঠে বারবার। এমনই এক আক্রমণ থেকে ২২ মিনিটের মাথায় গোল পেয়ে যায় তারা। একটি কর্নার ক্লিয়ার হওয়ার পর বাঁ দিকের উইং থেকে মাপা ও বাঁকানো ক্রসে বক্সের মধ্যে বল পাঠান ফাল্গুনী, যা অনুসরণ করে সামনে ঝাঁপ মেরে হেড করে গোলের ডান কোণ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন মিগুয়েল জাবাকো (১-০)।
বল দখলের লড়াইয়ে ইস্টবেঙ্গল এ দিন এগিয়ে থাকলেও ধারাবাহিক ভাবে একটানা তাদের বল দখলে রাখতে দেয়নি নর্থইস্ট। ফলে তাদের আক্রমণেও বারবার ছন্দপতন ঘটে। গোল খাওয়ার পর থেকে অবশ্য তাদের বল পজেশনে উন্নতি হয় এবং তার ফলে আক্রমণের ধারও বাড়ে। তবে ফিনিশিং-এর অভাব বারবার চোখে পড়ছিল। ৩৭ মিনিটের মাথায় হাভিয়ে সিভেরিওর শর্ট কর্নার থেকে বল পেয়ে গোলে শট নেন নন্দকুমার, যা ফের সেভ করেন মিরশাদ। প্রথমার্ধে দু’টি-র বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি লাল-হলুদ বাহিনী।
প্রথমার্ধের একেবারে শেষ দিকে নর্থইস্টের বক্সে সিভেরিও ও আলি বেমামারের সঙ্ঘর্ষে দু’জনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং রেফারি নর্থইস্টকে ফ্রি কিকি দেন। তাতে সিভেরিও মেজাজ হারান ঠিকই। কিন্তু সাইডলাইন থেকে আপত্তিকর মন্তব্য করায় হলুদ কার্ড দেখতে হয় নর্থইস্টের কোচ বেনালিকে। এ দিন বেশ কয়েকটি কড়া ট্যাকল করতে দেখা যায় নর্থইস্টের খেলোয়াড়দের। কয়েকটি প্রয়োজনের চেয়েও কড়া ছিল। রেফারি অবশ্য সেই তুলনায় ততটা কড়া হননি।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই হোসে পার্দোর জায়গায় বোরহা হেরেরা ও নিশু কুমারের জায়গায় শৌভিক চক্রবর্তীকে নামান ইস্টবেঙ্গল কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। হেরেরা, সিভেরিও ও ক্রেসপোর মধ্যে বোঝাপড়া ভাল। তাই তিনি মাঠে নামার পরে দলের আক্রমণে কিছুটা হলেও ধার বাড়ে। ৫৩ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে উঠে বক্সে ক্রস পাঠান মহেশ। বক্সে থাকা নন্দকুমার বল রিসিভ করে তার পরে গোল করতে গিয়েই ভুল করেন। ততক্ষণে তাঁকে আটকানোর জন্য নর্থইস্ট ডিফেন্ডাররা হাজির হয়ে যান।
প্রতিপক্ষের কোচের মতো কুয়াদ্রাতেরও রেফারির সিদ্ধান্ত তেমন পছন্দ হয়নি। ফলে তিনিও মেজাজ হারিয়ে হলুদ কার্ড দেখেন। কিন্তু এর পরেই যে ঘটনাটি ঘটে, তাতে যুবভারতীতে কার্যত নৈঃশব্দ নেমে আসে। ৫৭ মিনিটের মাথায় ডানদিকের উইং দিয়ে বল নিয়ে ওঠেন ফাল্গুনী সিং। বক্সে ক্রস না পাঠিয়ে তিনি নিজেই কাট ইন করে বক্সে ঢুকে বাঁ পায়ে দ্বিতীয় পোস্টের দিকে কোণাকুনি শট নেন, যা পোস্টে লেগে গোলে ঢুকে পড়ে (২-০)। প্রভসুখন প্রথম পোস্টের দিকে ছিলেন। ফলে তিনি বলের নাগাল পাননি।
দু’গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর আর ঝুঁকি নেয়নি নর্থইস্ট। নিজেদের রক্ষণে লোক বাড়িয়ে প্রতিপক্ষকে আটকানোই তখন ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। ওই সময়ে ৪-৪-২-এ খেলার প্রবণতা দেখা গেলেও নর্থইস্টের রক্ষণে প্রায়ই ছ’জন, এমনকী, আটজনকেও দেখা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে অবশ্য প্রতি আক্রমণে উঠছিল উত্তর-পূর্বের ফুটবলাররা। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণে তীব্রতা তখনও বাড়েনি।
ধার বাড়ানোর জন্য ৬০ মিনিটের মাথায় ক্লেটন সিলভাকে নামানো হয় জর্ডন এলসিকে তুলে। শেষপর্যন্ত তারা ব্যবধান কমায় ৭৭ মিনিটের মাথায়। আগে থেকেই ক্রেসপো, বোরহা এবং মহেশ একে অপরকে সাহায্য করে আক্রমণে গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের চেষ্টাতেই প্রথম গোল পায় ইস্টবেঙ্গল। ডানদিক দিয়ে ঢুকে বক্সের মাথায় থাকা মহেশকে গোলের পাস দেন ক্রেসপো। তিনি গোলে শট নেন, যা নর্থইস্ট ডিফেন্ডার দীনেশ সিংয়ের পায়ে লেগে গোলে ঢুকে যায় (২-১)। দীনেশের পায়ে না লাগলেও হয়তো মহেশের শট গোলেই ঢুকত।
ব্যবধান কমানোর পর সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে কলকাতার দল। ৮৩ মিনিটের মাথায় ফের বাঁ দিক থেকে বক্সে নিখুঁত ক্রস পাঠান নন্দকুমার। কিন্তু তা গোলকিপারের কাছে চলে যায় বলে আগেভাগেই বলের দখল নিয়ে নেন। শেষ দিকে আক্রমণের ঝড় তোলে লাল-হলুদ বাহিনী। ৮৭ মিনিটের মাথায় গোলের সামনে থেকে নেওয়া নন্দকুমারের শট আটকে দেন মিরশাদ। এই সময় সিভেরিও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং পেনাল্টির জোরালো আবেদন জানাতে থাকেন। কিন্তু রেফারি তা নাকচ করে দেন।
আট মিনিটের বাড়তি সময়ের বেশিরভাগেই বল ছিল ইস্টবেঙ্গলের দখলে। সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। ৯৫ মিনিটের মাথায় মাঝমাঠ অতিক্রম করা গোলমুখী সিভেরিওকে অবৈধভাবে বাধা দিয়ে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখেন ম্যাচের প্রথম গোলদাতা জাবাকো।
এই ঘটনার জেরেই পেনাল্টি বক্স ও সেন্টার লাইনের মাঝখানে ফ্রি কিক পায় ইস্টবেঙ্গল। সিভেরিওর ফ্রি কিক থেকে প্রথমে হেড করে গোলে বল পাঠান ক্রেসপো, যা মিরশাদ ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচালেও তাঁর হাত থেকে বল ছিটকে আসে ক্লেটনের পায়ে। ক্লেটন বক্সের মাঝখানে থাকা নন্দকুমারের উদ্দেশ্য হাওয়ায় বল ভাসিয়ে দেন। নন্দ সেই বল হেড করে জালে জড়িয়ে দেন (২-২)। এর পরে অবধারিত ভাবে পেনাল্টি শুট আউটে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।
ইস্টবেঙ্গলের ক্লেটন, ক্রেসপো, বোরহা, মহেশ ও নন্দকুমার গোল করলেও নর্থইস্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা পার্থিব গগৈয়ের শট ক্রসবারে ধাক্কা লাগায় তাঁর পুরো দল এ দিন হতাশায় ডুবে যায়। সারা ম্যাচে ভাল খেলেও শেষ কয়েক মুহূর্তের ভুলের খেসারত দিয়ে ফাইনালের দরজার সামনে গিয়েও ফিরে আসতে হল তাদের।