এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগ: আর্কাদাগে দু’গোলে জয়ের কড়া চ্যালেঞ্জ ইস্টবেঙ্গল এফসি-র
‘যেহেতু সাতদিন আগেই আমরা ওদের বিরুদ্ধে খেলেছি এবং ওদের দেখে নিয়েছি, তাই এই ম্যাচে অনেক ভাল ভাবে তৈরি হয়ে নামব আমরা’, বলছেন আত্মবিশ্বাসী লাল-হলুদ কোচ।

এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে ঘরের মাঠে তুর্মেনিস্তানের এফকে আর্কাদাগের কাছে হারের পর এ বার প্রতিপক্ষের মাঠে নেমে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে। সম্পুর্ণ অন্য পরিবেশে, অচেনা মাঠে, প্রতিপক্ষের সমর্থকদের সামনে ইস্টবেঙ্গল অন্তত দু’গোলে জেতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নামবে বুধবার, যা মোটেই সোজা নয়।
২০২৩-এ তাদের ফুটবল অভিযান শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত নিজেদের মাঠে কোনও ম্যাচ হারেনি তুর্কমেনিস্তানের এই ক্লাব। বুধবার কলকাতার ইস্টবেঙ্গল যদি তাদের হারাতে পারে, তা হলে এক নতুন ইতিহাস গড়বে তারা। কিন্তু সেই কাজটা মোটেই সোজা হবে না। গত বুধবার ঘরের মাঠে প্রথম লেগের খেলায় সেটা বেশ ভালমতোই বুঝে নিয়েছে তারা।
লাল-হলুদ বাহিনীর স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোন অবশ্য মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, গত ম্যাচে তারা যেহেতু প্রতিপক্ষকে আরও ভাল করে চিনে নিয়ে এই ম্যাচে নামছেন এবং যেহেতু তাদের সেরা খেলোয়াড়রা খেলার জন্য প্রস্তুত, তাই এ বার সফল হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
আত্মবিশ্বাসী লাল-হলুদ কোচ
কোচ অস্কার এ দিন বলেন, “প্রথম লেগের আগে প্রতিপক্ষকে নিয়ে খুব বেশি তথ্য-পরিসংখ্যান আমাদের হাতে ছিল না বলে ওদের নিয়ে বেশি চর্চা করতে পারিনি আমরা। তাই কৌশল, পরিকল্পনা তৈরিতেও কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সাতদিন আগেই ওদের বিরুদ্ধে খেলেছি এবং ওদের দেখে নিয়েছি, তাই এই ম্যাচে অনেক ভাল ভাবে তৈরি হয়ে নামব আমরা। তা ছাড়া এই ম্যাচে দলের সেরা খেলোয়াড়দের পাচ্ছি। চোট-আঘাতের সমস্যা তেমন নেই। কার্ড সমস্যাও নেই। তাই এই ম্যাচে আশা করি জিতব আমরা”।
সেমিফাইনালে উঠতে হলে অন্তত দু’গোলের ব্যবধানে জিততে হবে লাল-হলুদ বাহিনীকে। এক গোলের ব্যবধানে জিতলে টাই ব্রেকারে সফল হয়ে শেষ চারে উঠতে হবে তাদের। কিন্তু ৯০ মিনিটের লড়াইয়ে তারা সহজেই সফল হতে পারবে, এমন আশা না করাই ভাল।
ঘরের মাঠে আরও কঠিন আর্কাদাগ
নিজেদের দেশের লিগে আর্কাদাগ অপ্রতিরোধ্য এক দল, যাদের সাফল্যের হার একশো শতাংশ। সে দেশের এক নম্বর লিগ ইওকারি লিগায় গত মরশুমে তারা ৩০টি ম্যাচের সবকটিতেই জেতে এবং লিগ চ্যাম্পিয়নের শিরোপা পায়। এই ৩০ ম্যাচে তারা ১৪৭টি গোল করে ও মাত্র ২০টি গোল হজম করে। এমন গোল পার্থক্য সম্প্রতি আর কোনও দল তৈরি করতে পেরেছে কি না, এই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এর প্রাথমিক পর্বে যাদের কাছে হেরেছিল ইস্টবেঙ্গল, সেই আলটিন আসিরকে আর্কাদাগ গত মরশুমে তাদের দেশের লিগে চার গোলে হারিয়েছিল।
এমন একটা দলকে তাদের ঘরের মাঠে নেমে হারানো একেবারেই সোজা হবে না লাল-হলুদ বাহিনীর পক্ষে। যদিও ইস্টবেঙ্গলের কোচ বলছেন, তাঁর দল সেরা পারফরম্যান্স দেখাতে পারলে তা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, “আর্কাদাগ নতুন ক্লাব। ওরা ভাল ফল করেছে ঠিকই, কিন্তু তা তাদের ঘরোয়া লিগে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের মতো দলের বিরুদ্ধে, যারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে সম্প্রতি ভাল খেলেছে, তাদের বিরুদ্ধে খেলা অন্যরকম হবে। আশা করি, কাল ইস্টবেঙ্গলের মুখ উজ্জ্বল করে পরের রাউন্ডে যাব আমরা”।
গত বছর জানুয়ারিতে সুপার কাপের ফাইনালে ওডিশা এফসি-কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ফলে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এর প্রাথমিক পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু সেখানে তারা তুর্কমেনিস্তানের আলটিন আসিরের কাছে হেরে যায়। ফলে তারা পরবর্তী স্তরের এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের গ্রুপ পর্বে খেলার সুযোগ পায়। সেখানে তারা প্রথমে বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসকে ৪-০-য় হারায়, ভুটানের পারো এফসি-র সঙ্গে ২-২ ড্র করে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে লেবাননের নেজমে এফসি-র বিরুদ্ধে ৩-২-এ জিতে এখন কোয়ার্টার ফাইনাল পর্বে মুখোমুখি এফকে আর্কাদাগের বিরুদ্ধে।
প্রথম লেগের শিক্ষা!
তবে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে ঘরের মাঠে যতটা ভাল ও দাপুটে পারফরম্যান্স আশা করা হয়েছিল তাদের কাছ থেকে ততটা তারা দিতে পারেনি। সে দিন আক্রমণে যতটা গতি ও তীব্রতা আশা করা হয়েছিল তাদের কাছ থেকে, তা দেখা যায়নি। বক্সের বাইরে থেকে ছ’টি ও ভিতর থেকে সাতটি শট নিলেও কোনওটিকেই গোলে পরিণত করতে পারেনি তারা।
আক্রমণে দিয়ামান্তাকস, মেসি বৌলি ও সেলিস- তিন বিদেশী থাকা সত্ত্বেও শারীরিক সক্ষমতায় এগিয়ে থাকা ডিফেন্ডারদের কড়া পাহাড়া ভেঙে পেরে ওঠেনি তারা। প্রথমার্ধে দশ মিনিটের মাথায় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ইয়াজগিলিক গুরবানভের গোলে হেরে যায় তারা।
এ বার প্রতিপক্ষকে যদি শুরু থেকেই তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে দেয় ইস্টবেঙ্গল, তা হলে তাদের বিপদ বাড়তে পারে। তবে সে জন্য তাদের আক্রমণ বিভাগকে আরও গতিময় ও আগ্রাসী হতে হবে। শুরু থেকেই জয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারলে ক্রমশ আর্কাদাগ পাল্টা চাপে ফেলতে পারে তাদের।
মেসির ছোঁয়াতেও ছন্দহীন দিমি!
এএফসি-র প্রতিযোগিতায় যেহেতু বিদেশীর সংখ্যার ওপর কোনও বিধিনিষেধ নেই, তাই বুধবার দলের সব বিদেশীকেই একসঙ্গে মাঠে নামাতে পারবে ইস্টবেঙ্গল। তাদের দুই বিদেশী অ্যাটাকার ভেনেজুয়েলার রিচার্ড সেলিস ও ক্যামেরুনের রাফায়েল মেসি বৌলি দলের আক্রমণে গতি ও তীব্রতা দুইই আনতে পারেন, যা তাঁরা আইএসএলে করেছেন। বিশেষ করে মেসি বৌলি দলের আক্রমণ বিভাগকে যথেষ্ট সচল করে তুলেছেন। কিন্তু অস্কার ব্রুজোনের চিন্তার বিষয় তাঁর দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্রিক স্ট্রাইকার দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসের ধারাবাহিকতার অভাব।
গত আইএসএল মরশুমের সর্বোচ্চ স্কোরার দিয়ামান্তাকস এ মরশুমে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়ার পর এ বারের আইএসএলে সেরা ছন্দে নেই। শেষ এগারোটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র দুটিতে গোল পেয়েছেন তিনি। তাও এই দুই গোলের মধ্যে আটটি গোলহীন ম্যাচ খেলেন তিনি। এই আট ম্যাচে গোলের খরা কাটিয়ে গত ২২ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে গোলে ফিরলেও পরের তিনটি ম্যাচে ফের গোলহীন অবস্থায় মাঠ ছাড়েন তিনি।
বরং এখন অনেক বেশি আশাজনক পারফরম্যান্স দেখাচ্ছেন রাফায়েল মেসি বৌলি। আইএসএলে পাঁচটি ম্যাচে ৩৫৩ মিনিট মাঠে থেকে দু’টি গোল করেছেন ও একটি অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। দশটি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন এবং যে দু’টি শট গোলে রেখেছেন, সেই দু’টি থেকেই গোল পেয়েছেন। তবে গত বুধবার এএফসি-র ম্যাচে তিনিও খুব একটা তৎপর ছিলেন না। মাঝমাঠে সউল ক্রেসপোও সে দিন ছন্দে ছিলেন না।
তরতাজা লাল-হলুদ শিবির
সে দিনের ম্যাচে হয়তো টানা ম্যাচ খেলার ক্লান্তির প্রভাব পড়েছিল তাঁদের খেলায়। কিন্তু এই ম্যাচে তা হওয়ার কথা নয়। কারণ, এই ম্যাচে যাতে দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়দের তরতাজা অবস্থায় পেতে পারেন, সে জন্য আইএসএলের শেষ ম্যাচে তাঁদের কাউকেই খেলতে না দিয়ে দল নিয়ে তুর্কমেনিস্তানে রওনা দেন অস্কার ব্রুজোন। দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে লিগের শেষ ম্যাচে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের কাছে চার গোল খেয়ে হেরেও যায় তারা। বুধবার জিততে পারলে বা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে পারলে সেই ম্যাচে দ্বিতীয় সারির দল খেলানোর যৌক্তিকতা হয়তো প্রমাণ করতে পারবেন লাল-হলুদ কোচ।
এফকে আর্কাদাগের শক্তিশালী ও বড় চেহারার ফুটবলারদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে হলে এই বিদেশীরা ছাড়াও সুচতুর কৌশলও প্রয়োজন ইস্টবেঙ্গলের, যা তৈরি করেছেন কোচ ব্রুজোন। তিনি বলেন, “কালকের ম্যাচে হয়তো অনেকটা অংশে শারীরিক লড়াই হবে, সেকেন্ড বল দখলের লড়াই হবে। সেট পিস, ট্রানজিশন ও কারা কত বেশি ভার্টিকাল ফুটবল খেলতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হবে। আইএসএলে আমরা য়ে রকম মাঠে খেলি, তার চেয়ে এই মাঠটা একটু অন্যরকম। তবে আমাদের ছেলেরা আশা করি পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে”।
আর্কাদাগ দলে কোনও বিদেশী ফুটবলার নেই। দেশীয় ফুটবলারদের নিয়েই এতদিন সফল হয়ে এসেছে তারা। বুধবারও ঘরের মাঠে সমর্থকদের সামনে এশীয় মঞ্চে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাওয়ার জন্যই মরিয়া হয়ে উঠবেন দুরদিয়েভ, গুরবানভ, আকমামেদভ, তির্কিশভরা। তাঁদের রুখলেই শুধু হবে না, দু’গোলের ব্যবধানে বা টাই ব্রেকারে জেতার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে কলকাতার মশাল-ব্রিগেডকে।
ম্যাচ- এফকে আর্কাদাগ বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি
প্রতিযোগিতা- এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগ, কোয়ার্টার ফাইনাল
ভেনু- আর্কাদাগ স্টেডিয়াম, আর্কাদাগ
কিক অফ- ১২ মার্চ, ২০২৫, বিকেল ৪.০০
লাইভ স্ট্রিম- ফ্যানকোড