তাঁর অধীনে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট জিতেছে এক নজিরবিহীন ইন্ডিয়ান সুপার লিগ ডাবল— লিগ উইনার্স শিল্ড ও আইএসএল কাপ, দুইই। গত মরশুমে আইএসএল কাপ হাতছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা এতদিনে প্রশমিত হয়েছে আত্মবিশ্বাস, আধিপত্যে ভরা এই অভিযানে।

মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম মরশুমেই ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেছেন স্প্যানিশ কোচ হোসে মোলিনা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে তিনিই কি সবুজ-মেরুন বাহিনীর সেরা আইএসএল কোচ?

সাফল্যের বিচারে বা পরিসংখ্যান ও নজিরের বহর দেখলে তাঁর এই বাহিনীকেই আইএসএলে খেলা সেরা দল বলা যায়। কিন্তু আন্তোনিও লোপেজ হাবাস, হুয়ান ফেরান্দোরা সবুজ-মেরুন ব্রিগেডের যে ভিত তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা যে ভাবে দলের এই ভিতের মধ্যে সংগ্রামের বীজ পুঁতে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই তো সাফল্যের ইমারত তৈরি করেছেন মোলিনা।

ডুরান্ড হারের আগুন!

এ মরশুমের শুরুতে ডুরান্ড কাপ ফাইনালে হারের পর অনেকেই হয়তো সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন নয়া কোচের দক্ষতা নিয়ে এবং মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু সেই হারই বোধহয় মোলিনার শিষ্যদের বুকে আগুন জ্বালিয়েছিল, ব্যর্থতার আগুন। প্রাক্তন কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের ছেড়ে যাওয়া শক্তিশালী দলকে নিজের মতো করে গড়ে তোলেন মোলিনা। সূক্ষ্ম কৌশলগত পরিবর্তন, খেলোয়াড়দের নির্দিষ্ট ভূমিকা এবং তাঁর গেমপ্ল্যানের প্রতি ফুটবলারদের অগাধ আস্থা অর্জন করে।

হাবাসের যোগ্য উত্তরাধিকারী?

হাবাসের গড়ে তোলা কাঠামোতে কোনও বড় পরিবর্তন না এনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পরিকল্পনা করেন মোলিনা। দলবদলে তাঁর পাশে ছিল ক্লাব ম্যানেজমেন্ট। মুম্বই সিটি এফসি থেকে দলে নিয়ে আসা হয় দুর্ধর্ষ মিডফিল্ডার লালেংমাউইয়া রালতে বা আপুইয়াকে। অস্ট্রেলিয়া থেকে উড়িয়ে আনা হয় সে দেশের লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা জেমি ম্যাকলারেনকে। আইএসএলে সাফল্য পাওয়া অভিজ্ঞ স্কটিশ মিডিও গ্রেগ স্টুয়ার্টের মতো তারকাকেও যুক্ত করা হয় এ বারের শিবিরে। হেক্টর ইউস্তে, আনোয়ার আলির বিদায়ে রক্ষণে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হলেও তা পূরণ করতে মোলিনার সুপারিশে ক্লাব ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আসে নতুন সেন্টার-ব্যাক জুটি টম অলড্রেড ও আলবার্তো রড্রিগেজকে।

মরশুমের শুরুতে ফর্মেশন নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও যে ভাবে মৃৎশিল্পী কাঠামোর ওপর এক অপূর্ব মূর্তি তৈরি করে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন, অনেকটা সে ভাবেই মোলিনা দল সাজিয়ে তোলেন একটি নির্ভরযোগ্য কাঠামোর ওপর। অলড্রেড ও রড্রিগেজ গড়ে তোলেন রক্ষণের মজবুত প্রাচীর, যার ভরসায় আক্রমণের ঝড় তুলতে থাকেন তাঁদের সতীর্থরা। গোল আসতে থাকে একের পর এক।

আত্মবিশ্বাসের স্তর এমন জায়গায় চলে যায়, যে অলড্রেড, রড্রিগেজরাও উঠে গিয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে আসেন। নবাগত দীপেন্দু বিশ্বাসও সেই তালিকায় নিজের নাম লেখান। আর দলের ‘অলরাউন্ডার’ ক্যাপ্টেন শুভাশিস বোসের তো জবাব নেই। যেখানেই তাঁকে চেয়েছে পরিস্থিতি, সেখানেই হাজির হয়ে গিয়েছেন তিনি। আধ ডজন গোলও করেছেন।

নির্দিষ্ট ভূমিকা, অগাধ আস্থা, অটুট সংহতি

মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে শুধু যে কৌশল ছিল, তা নয়। ছিল খেলোয়াড়দের মানসিক প্রস্তুতি ও শক্তিও। প্রতিটি খেলোয়াড়ের ভূমিকায় আস্থা রেখেছেন ও তাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন মোলিনা। প্রধান এগারো থেকে শুরু করে রিজার্ভ বেঞ্চের প্রায় প্রত্যেককে সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী মাঠে নামিয়েছেন তিনি।

আপুইয়ার শেষ মুহূর্তের গোল, ম্যাকলারেনের ধারালো ফিনিশিং কিংবা স্টুয়ার্টের সৃষ্টিশীলতা— সব মিলিয়ে দলটি হয়ে ওঠে এক সুসংবদ্ধ পরিবারের মতো। তাই সারা আইএসএল মরশুমে ঘরের মাঠে অপরাজিতই থেকে যায় তারা। নির্মম কাউন্টার অ্যাটাক এবং নিখুঁত অফ দ্য বল পজিশন— সব কিছুতেই ছিল সবুজ-মেরুন ব্রিগেডের একচ্ছত্র আধিপত্য।

তাই গতবারের মতো এ বার আর শিল্ড জেতার জন্য লিগের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের। দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই তারা সেরার শিরোপা নিশ্চিত করে ফেলে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী এফসি গোয়ার চেয়ে আট পয়েন্ট এগিয়ে থেকে মরশুম শেষ করে।

প্লে অফে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন

আট মাসের লিগের শেষ পর্যন্ত যে এই মানসিক দৃঢ়তা ধরে রেখেছিল মোলিনা-বাহিনী তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্লে অফে, যখন সেমিফাইনালের প্রথম লেগে জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধে শোচনীয় ভাবে হারার পরেও দ্বিতীয় লেগে তারা এক নাটকীয় জয় ছিনিয়ে নেয় একেবারে ম্যাচের শেষ মুহূর্তে। সারা লিগে অনেক আক্রমণ তৈরি করেও যিনি একটিও গোল পাননি, সেই আপুইয়া-ই শেষ মুহূর্তে গোল করে সেই ম্যাচ জেতান।

সে দিন সেই অবিশ্বাস্য জয়ের পর মোলিনা বলেন,“দলের ছেলেরা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিকল্পনায় অটল থাকতে পেরেছে। সেই জন্যই শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের প্রাপ্য অর্জন করতে পেরেছি”। কাপ ফাইনালেও পিছিয়ে পড়ার পর ঘুরে দাঁড়িয়ে জয় তুলে নেয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। দক্ষতা, কৌশল, পরিকল্পনা ছাড়াও চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মানসিক শক্তির ওপর ভর করে টানা দ্বিতীয়বার কাপ জয়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেয় তারা। প্রতিষ্ঠা করে আইএসএলের প্রথম ডাবল জয়ের মাইলফলক।

এ বার কলিঙ্গ অভিযান: ত্রিমুকুটের স্বপ্ন

মরশুম এখানেই শেষ নয়। রবিবার ভুবনেশ্বরে শুরু হচ্ছে কলিঙ্গ সুপার কাপ। সেখানেও তাদের চোখে থাকবে আরও একটি ট্রফি জয়ের স্বপ্ন। সম্ভাবনা আছে এক বিরল ত্রিমুকুটের— লিগ শিল্ড, আইএসএল কাপ ও কলিঙ্গ সুপার কাপের। তবে পূর্ণশক্তির দল নিয়ে তারা এই টুর্নামেন্টে নামতে পারবে বলে মনে হয় না। ডাগ আউটে হয়তো থাকবেন না মোলিনা নিজেও। কিন্তু থাকবে তাঁর প্রভাব, তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি, লড়াই এবং নেতৃত্বের মন্ত্র। হোসে মোলিনার হাত ধরে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট যে পথে এগোচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই পারে লাখ লাখ ক্লাব সমর্থক। আরও উজ্জ্বল মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার স্বপ্ন।

কারণ, এই মরশুম শুধু সাফল্যের মরশুম ছিল না, এই মরশুম রেখে যাচ্ছে এক বার্তাও— মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে ফিরিয়ে এনেছেন হোসে মোলিনা। তারা এসেছে শাসন করতে।