তাদের কাছে এটাই মরশুমের সবচেয়ে বড় ম্যাচ এবং এই ম্যাচে জিতলে অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যায়। মিটে যায় অনেক কিছু না পাওয়ার আক্ষেপ। বঙ্গ ফুটবলের দুই প্রধান ক্লাবের সমর্থকদের কাছে ডার্বির গুরুত্ব এতটাই যে, সারা বছর আর কোনও সাফল্য না এলেও তারা অতটা হতাশ হন না, যতটা দুঃখ ডার্বি হারলে পান।

তাই রবিবার রাতে ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালের পর যখন বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের গ্যালারির একদিকে চলছিল বেলাগাম আনন্দের জোয়ার, তখন অপর দিকের গ্যালারিকে যেন গ্রাস করে হতাশার স্তব্ধতা।

২০২৩-এর ডুরান্ড কাপে ইস্টবেঙ্গলকে ১-০-য় হারিয়েছিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এর পর থেকে জাতীয় ক্লাব মরশুমে যে পাঁচটি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে দুই প্রধান, তার মধ্যে একটিতে ইস্টবেঙ্গল জেতে ও একটিতে ড্র হয়। বাকি তিনটিতেই জেতে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। শেষ তিন ডার্বিতেই জেতে সবুজ-মেরুন বাহিনী। ২০২৪-এর ১৯ জানুয়ারি-র (সুপার কাপ) পর গত রবিবারই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাল ইস্টবেঙ্গল এফসি। তাই তাদের সমর্থকদের বাঁধাভাঙা উল্লাসই স্বাভাবিক।

আরও কঠিন কাজ বাকি: অস্কার

তবে এখনই উচ্ছ্বাসে ভাসতে রাজি নন ইস্টবেঙ্গলের স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোন। কারণ, ডুরান্ড কাপ জিততে গেলে এখনও তাদের দু’টি কঠিন ধাপ পেরোতে হবে তাদের। রবিবার ম্যাচের পর বলেন, “আমরা হয়তো ডুরান্ড কাপের সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে জিতলাম। তবে কঠিনতম ম্যাচগুলো এখনও জেতা বাকি আছে। তাই কাজ এখনও শেষ হয়ে যায়নি”।

রবিবার সন্ধ্যায় বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে গ্রিক ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস-এর জোড়া গোলে গতবারের রানার্স আপ-দের ২-১-এ হারিয়ে ডুরান্ড কাপের শেষ চারে নিজেদের জায়গা পাকা করে নেয় লাল-হলুদ ব্রিগেড। ম্যাচের ৩৮ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ইস্টবেঙ্গলের দিমি। বিরতির পর, ৫২ মিনিটের মাথায় ফের তাঁর গোলেই ব্যবধান দ্বিগুন হয়ে যায়। ৬৮ মিনিটের মাথায় অনিরুদ্ধ থাপা দূরপাল্লার শটে গোল করে ব্যবধান কমান। ম্যাচের শেষ দশ মিনিটে বাগান-বাহিনী সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেও তাদের সফল হতে দেননি লাল-হলুদ ডিফেন্ডাররা।

গত জাতীয় ক্লাব মরশুমে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে একবারও হারাতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল এফসি। গত মরশুমেরই মাঝামাঝি সময়ে লাল-হলুদ বাহিনীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন অস্কার। যেদিন দলের দায়িত্ব নিতে কলকাতায় এসে পৌঁছন তিনি, সেদিনই যুবভারতীতে ছিল কলকাতা ডার্বি। ডাগ আউটে বসে অসহায়ের মতো দু’গোলে হার দেখেছিলেন তিনি। ফিরতি লিগেও এক গোলে হেরেছিলেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর কাছে। সেই ক্ষতে এতদিন পরে কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়ল।

রবিবার জয়ের পর কোচ বলেন, “গতবার ডার্বিতে ভাল খেলতে পারিনি আমরা। এ বার সেই আক্ষেপ মিটল। আমরা ডুরান্ড কাপে আরও একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছি। সোমবার থেকে সেমিফাইনালের পরিকল্পনা শুরু করে দেব। গত বার আমাদের দল বারবার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। এ বার আর তেমন কিছু হোক, চাইব না”।

ম্যাচের দু’দিন আগেই শিবিরে খবর আসে, প্যালেস্টাইনের মিডফিল্ডার মহম্মদ রশিদের পিতৃবিয়োগ হয়েছে। ফলে তাঁকে দেশে ফিরে যেতে হয়। রবিবার ম্যাচ শুরু হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যেই চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন মরক্কো থেকে আসা ফরোয়ার্ড হামিদ আহদাদ। তা সত্ত্বেও মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের মতো দলের বিরুদ্ধে দু’গোলে এগিয়ে যাওয়াই ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে।

এই জয় রশিদকেই উৎসর্গ করেছেন ইস্টবেঙ্গলের কোচ-ফুটবলাররা। ভারতে সম্ভবত সেমিফাইনালে ডায়মন্ড হারবার এফসি-র বিরুদ্ধে নামবেন রশিদ। হামিদের চোটও তেমন গুরুতর নয় বলে খবর লাল-হলুদ শিবিরে। দলের স্প্যানিশ মিডফিল্ডার সউল ক্রেসপো জানিয়ে দিলেন, “আমরা রশিদের পাশেই রয়েছি। ওকেই আজকের এই জয় উৎসর্গ করছি আমরা”।

ছন্দে ফিরে খুশি লাল-হলুদের দিমি

তবে এটাও ঠিক যে, হামিদ চোট পেয়ে বেরিয়ে না গেলে দিয়ামান্তাকসের মাঠে নামা হত কি না, সন্দেহ আছে। হয়তো একেবারে ম্যাচের শেষ দিকে নামতেন তিনি। ২০২৩-২৪ মরশুমে কেরালা ব্লাস্টার্সের হয়ে খেলে আইএসএলে সর্বোচ্চ স্কোরারের খেতাব অর্জন করেছিলেন এই গ্রিক ফরোয়ার্ড। গত মরশুমের আগে তাঁকে সই করানোয় সমর্থকেরা বেশ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু মরশুম শুরু হওয়ার পর তাঁর পারফরম্যান্সের রেখচিত্রে পতন দেখে বেশ হতাশ হয়েছিলেন সবাই।

তাই এ বার ইস্টবেঙ্গলের দিমি-র কাছ থেকে তেমন প্রত্যাশা ছিল না সমর্থকদের। কোচও তাঁকে কোনও ম্যাচে শুরু থেকে নামাচ্ছিলেন না। রবিবার ১৬ মিনিটের মাথায় রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে মাঠে নেমে সেরা ছন্দে ফিরে নিজেকে ফের একবার নিজেকে প্রমাণ করলেন লাল-হলুদের দিমি।

ডার্বি জয়ে তাঁর জোড়া গোলের অবদান নিয়ে দিয়ামান্তাকস বলেন, “এই জয়ের অনুভূতি দারুন। সব মিলিয়ে আমরা দারুন খেলেছি। এই জয়ের জন্য সমর্থকদেরও অনেক ধন্যবাদ। তাঁরা শেষ মিনিট পর্যন্ত আমাদের পাশে ছিলেন। আরও গোল করতে পারতাম আমরা। আমি নিজেই সুযোগ নষ্ট করেছি। তবে আমাদের জয়টাই আজকের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা”।

দলের এই অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড ছন্দে ফেরায় খুশি কোচ অস্কারও। বলেন, “দিমিকে শেষ ম্যাচে খেলাইনি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দলের মর্যাদা রক্ষা করেছে। আশা করি ও ফের ছন্দে ফিরেছে। সারা মরশুমেই ওকে এই ফর্মে দেখতে পাব”।

কোনও অজুহাত নয়: হোসে মোলিনা

লাল-হলুদ শিবিরে যখন উচ্ছ্বাস, উল্লাসের জোয়ার, তখন যেন শ্মশানের স্তব্ধতা সবুজ-মেরুন শিবিরে। সমর্থকেরাও দুঃখে, হতাশায় ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরমুখো হতে শুরু করেন। সেই সমর্থকদের জন্যই মন খারাপ কোচ হোসে মোলিনার। ম্যাচের পর বলেন, “আজ জিততে পারলাম না। সমর্থকদের জন্যই খারাপ লাগছে। তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। তবে কাল ফের নতুন দিন শুরু হবে। আশা করি, ওদের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে পারব”।

রবিবার ডার্বিতে তাঁর দল যে ভাল খেলতে পারেনি, তা মোটেই অস্বীকার করেননি মোলিনা। বলেন, “প্রথমার্ধে আমাদের মাঝমাঠ একেবারেই ভাল খেলতে পারেনি। অনেক সুযোগ নষ্ট করেছি আমরা। গোলের সামনে গিয়েও গোল করতে পারিনি। সেই তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের ছেলেরা ছন্দে ফিরতে পেরেছে। চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে ওরা”।

অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার শুভাশিস বোস চোটের কারণে দলের বাইরে। মনবীর সিং-ও এ দিন মাঠে নামতে পারেননি। ম্যাচের আগের দিন কোচ নিজেই বলেছিলেন, সবে প্রাক মরশুম প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তাই ফিটনেস ও দক্ষতা—কোনও দিক থেকেই সেরা জায়গায় নেই সবুজ-মেরুন শিবির। তবে রবিবারের হারের জন্য কোনও অজুহাত দিতে রাজি নন তিনি। বলেন, “অজুহাত দেওয়া আমার স্বভাব নয়। মনবীর, শুভাশিসরা না থাকায় হেরে গেলাম বা আমাদের খেলোয়াড়দের ফিটনেসের অভাবের জন্য হেরে গেলাম, কোনওটাই ঠিক নয়। এগুলো কোনও অজুহাত হতে পারে না”।

তবে এই হারের ফলে এ বার এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এর ম্যাচের প্রস্তুতিতে মন দিতে পারবে সবুজ-মেরুন শিবির। আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর ঘরের মাঠে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে নামবে তারা। সেই ম্যাচের প্রস্তুতি শুরু হবে তাদের। তার মধ্যে আবার ভারতীয় শিবিরের জন্য বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে ছাড়তেও হবে মোলিনাকে। গতবারে যে টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে হেরে গিয়েছিল তারা, সেই ডুরান্ড কাপের অভিযান এ বার কোয়ার্টার ফাইনালেই শেষ হয়ে যাওয়াটা এখন তাঁর কাছে অতীত।