ডুরান্ড কাপ ফাইনাল: খেতাব রক্ষার চ্যালেঞ্জ নর্থইস্টের, ইতিহাসের মুখে ডায়মন্ড বাহিনী
আলাদিনকে আটকে রাখতে পারলে অর্ধেক কাজ সেরে ফেলতে পারবে ডায়মন্ড হারবার এফসি। অতীতে এমন কৌশল অবলম্বন করে সফল হয়েছে কলকাতার আইএসএল ক্লাবগুলি।

পরপর জোড়া অঘটন ঘটিয়ে এ বার ডুরান্ড কাপের ফাইনালে গতবারের চ্যাম্পিয়ন নর্থইস্ট ইউনাইটেডের মুখোমুখি কলকাতার ডায়মন্ড হারবার এফসি। শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টের দুই সেরা দল যখন খেতাবি লড়াইয়ে নামবে, তখন তৈরি হবে এক নতুন ইতিহাস। ডুরান্ড কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হবে এক নতুন চ্যাম্পিয়ন ও এক নতুন ফাইনালিস্ট।
কোয়ার্টার ফাইনালে জামশেদপুর এফসি ও সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল এফসি—এই দুই দলকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে চার বছর বয়সী ডায়মন্ড হারবার এফসি, যাদের অনেকে কলকাতার প্রধান ফুটবল ক্লাবগুলির মধ্যে রাখতে চান। এ বছরই আই লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার পর এ বার ডুরান্ড কাপেরও ফাইনালে ওঠার যে কৃতিত্ব অর্জন করেছে তারা, তাতে এই আখ্যা তাদের প্রাপ্য বলে মনে করছেন অনেকেই। কিন্তু সে জন্য তাদের ১৩৪ তম ডুরান্ড কাপের ফাইনালে জিততে হবে, যা মোটেই সোজা কাজ নয়।
১৭ বারের ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন ও গতবারের ফাইনালিস্ট মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট এ বার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে গিয়েছে। ১৬ বারের চ্যাম্পিয়ন ইস্টবেঙ্গলও শেষ চারের লড়াইয়ে টিকতে না পেরে টুর্নামেন্টের বাইরে চলে গিয়েছে। আর এক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মহমেডান এসসি তো গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। তাই কলকাতার সম্মান এখন নবাগত ডায়মন্ড হারবারেরই হাতে।
.@NEUtdFC’s Goal-Getters in #DurandCup2025! 🔥#NorthEastUnitedFC #IndianFootball #134thEditionofIndianOilDurandCup | @thedurandcup pic.twitter.com/0TiFC3cgdI
— Indian Super League (@IndSuperLeague) August 22, 2025
খেতাব রক্ষার চ্যালেঞ্জ নর্থইস্টের
অন্যদিকে, ভারতীয় ফুটবলে এখন সবচেয়ে বেশি ফুটবলার উঠে আসছে দেশের যে অঞ্চল থেকে, সেই উত্তর-পূর্ব ভারতের সম্মান বজায় রাখার দায়িত্ব এখন নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র কাঁধেই। গত বার ডুরান্ড কাপ ফাইনালে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে হারিয়েই চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেছিল এই দল। সেটিই ছিল তাদের ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম সর্বভারতীয় খেতাব। এ বার সেই খেতাব ধরে রাখারই চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে।
শুক্রবার নর্থইস্টের কোচ হুয়ান পেদ্রো বেনালি বলেন, “ওদের বিরুদ্ধে যারা ফেবারিট ছিল, সেই ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছে ডায়মন্ড হারবার। তবে আমরা নিজেদের ফেভারিট মনে করছি না। ফাইনালে কেউ ফেভারিট হয় না। এটা আসলে মনস্তাত্বিক লড়াই। আসলে এই ম্যাচে মানসিক ভাবে যারা শক্তিশালী থাকবে, তারাই জিতবে”।
গতবারের ডুরান্ড জয় যে আকস্মিক বা কাকতালীয় ছিল না, তা নর্থইস্ট ইউনাইটেড প্রমাণ করেছিল গত আইএসএলেই, যেখানে তারা লিগ টেবলে চার নম্বরে থেকে প্লে অফে পৌঁছয় এবং সেই পর্বের প্রথম ম্যাচে জামশেদপুর এফসি-র কাছে হেরে লড়াই থেকে ছিটকে যায়। সেই জামশেদপুরকেই তাদের মাঠে হারিয়ে এ বার ফাইনালে উঠেছে নর্থইস্টের প্রতিপক্ষ ডায়মন্ড হারবার এফসি। অর্থাৎ, নর্থইস্টের পক্ষেও ম্যাচটা মোটেই সোজা হবে না। শনিবার টুর্নামেন্ট শেষ হবে এক আকর্ষণীয় ও উত্তেজক লড়াই দিয়ে, সে রকমই ধরে নেওয়া যায়।
আলাদিনের আশ্চর্য ফুটবল!
তবে গত এক বছরের পারফরম্যান্সে প্রতিপক্ষদের সমীহ যে আদায় করে নিতে পেরেছে বেনালির দল, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মহম্মদ আলি বেমামের ও নেস্টর আলবিয়াখের মতো খেলোয়াড় না থাকা সত্ত্বেও এ বারও যে ভাবে ডুরান্ড ফাইনালে উঠেছে তারা, তা এক কথায় অভাবনীয়। এ বারও তাদের সাফল্যের রথে সারথীর ভূমিকায় রয়েছেন মরক্কোর বিস্ময় ফরোয়ার্ড আলাদিন আজারেই, যাঁকে দেখলেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের জিনের কথা মনে পড়ে যায়। কোচ তাঁর কাছ থেকে যা-ই চান, তা-ই পান।
গত আইএসএলে তাঁর পারফরম্যান্স তো ইতিহাস। ২৫ ম্যাচে ২৩ গোল করে গোল্ডেন বুট জেতেন আজারেই। তাঁর সেই অভিযান চলছে সমান গতিতে। এই ডুরান্ড কাপে পাঁচ ম্যাচে সাত গোল করেছেন তিনি। মালয়েশিয়ান আর্মডফোর্সের বিরুদ্ধে দলের ৩-১ জয়ে তিনটি গোলই করেন আলাদিন। পরের ম্যাচে শিলং লাজং এফসি-র বিরুদ্ধে ২-১ জয়েও দু’টি গোলই করেন আলাদিন। রাঙদাজিজ ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে ২-২ ড্রয়ে তিনি গোল করতে না পারলেও একটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন।
কোয়ার্টার ফাইনালে বোড়োল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৪-০ জয়েও তাঁর অবদান ছিল দু’গোল। সেমিফাইনালে নর্থইস্ট ইউনাইটেড ডার্বিতে শিলং লাজং এফসি-কে তারা ১-০-য় হারায়। তবে সে ম্যাচে গোল পাননি আলাদিন। গোল করেন রেডিম তলাং। কিন্তু পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই গোল করেছেন যিনি, তাও একাধিক গোল, সেই আলাদিন আজারেই শনিবার যুবভারতীতে সবার নজরে থাকবেন।
আলাদিনকে আটকে রাখতে পারলেই অর্ধেক কাজ সেরে ফেলতে পারবে ডায়মন্ড হারবার এফসি। অতীতে এমন কৌশল অবলম্বন করে সফল হয়েছে কলকাতার আইএসএল ক্লাবগুলি। তবে শুধু আলাদিনের ওপরই যে পুরো দল নির্ভরশীল, তা নয়। নর্থইস্টের দলে রয়েছে এক ঝাঁক প্রতিভাবান ফুটবলার, যাদের আটকানো যে কোনও দলের পক্ষেই কঠিন কাজ। শুধু গোলের ক্ষেত্রে তারা একটু বেশিই নির্ভরশীল আলাদিনের ওপর। এটা যেমন তাদের শক্তি, তেমনই দুর্বলতাও।
তবে শিলং লাজং এফসি ছাড়া নর্থইস্ট ইউনাইটেডকে তেমন কোনও কঠিন প্রতিপক্ষের সামনে পড়তে হয়নি। লাজংয়ের বিরুদ্ধে দু’বার খেলেছে তারা, দু’বারই জিতেছে। ডায়মন্ড হারবার এফসি-র বিরুদ্ধে তাদের ফের এক কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে। নিজেদের শহরে ডায়মন্ড বাহিনী যে প্রচুর সমর্থক পাবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
দলগত শক্তিই ভরসা হীরক-বাহিনীর
আইএসএলে খেলা জবি জাস্টিন, মেলরয় আসিসি, হালিচরন নারজারি, কোয়ার্টার ফাইনালে জোড়া গোলের নায়ক রুয়াতকিমার মতো প্রতিভাবান ও অভিজ্ঞ ফুটবলাররা রয়েছেন হীরক বাহিনীতে। এ ছাড়া লুকা মাজেন, ক্লেটন সিলভেইরা, মিকেল কোর্তাজারের মতো বিপজ্জনক বিদেশি ফুটবলাররাও রয়েছেন কলকাতার দলে।
ইস্টবেঙ্গল, জামশেদপুরের বিরুদ্ধে যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছিল তাঁর দল, ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ম্যাচেও সেই পারফরম্যান্সই নিশ্চয়ই দেখাতে চাইবেন ডায়মন্ড কোচ কিবু ভিকুনা। এই টুর্নামেন্টে দলীয় দক্ষতায় একের পর এক ম্যাচ জিতেছে তারা। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে সেই দলগত পারফরম্যান্স বজায় রাখতে পারলে লাল-হলুদ বাহিনীর মতো নর্থইস্টকেও কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে নবাগতরা।
সেমিফাইনালে নামার আগে কিবু বলেছিলেন, “ভাববেন না যে, আমরা মাঠে নামার আগেই হেরে বসে আছি। ফুটবলে ফেভারিটদের হেরে যাওয়া নতুন কোনও ঘটনা নয়। লড়াকু মানসিকতা ও বুদ্ধির জোরে অঘটন ঘটানো যায়”। ফাইনালে দল নামানোর আগে শুক্রবার তিনি বলেন, “আমরা গতবারের চ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে খেলছি, যারা খুবই ভাল দল। আমরা তৈরি। ডুরান্ড কাপের ফাইনালের মতো একটা ম্যাচ খেলতে নামছি যখন, তখন একটা চাপ তো থাকবেই। এই চাপ থাকাটা একদিক দিয়ে ভাল। তবে বাড়তি চাপে ভুগছি না”।
শনিবার দেখা যাবে দুই দলের ভিন্ন স্টাইলের দ্বৈরথ। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের ভরসা আক্রমণ তৈরি, অ্যান্ডি রদ্রিগেজ ও চেমা নুনিয়েজের মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে এবং আলাদিনেক নিখুঁত ফিনিশিংয়ে। অন্যদিকে, ডায়মন্ড হারবার ভর করে লুকা মাজেনের হোল্ড-আপ প্লে, জবি জাস্টিনের ক্ষিপ্র আক্রমণ ও মাঝমাঠে স্যামুয়েল ও পলের নিরলস পরিশ্রমে।
তবে পরিসংখ্যান বলছে, রক্ষণভাগে নর্থইস্ট তুলনামূলকভাবে বেশি সংগঠিত। ফাইনালে ওঠার পথে তারা মাত্র চার গোল হজম করেছে। তবে ডায়মন্ড বাহিনী বারবার প্রমাণ করেছে প্রয়োজনে তারা নিজেদের কৌশল আকস্মিক বদলে ফেলে প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে পারে। গোলে মিরশাদ মিচুর উপস্থিতি তাদের বড় শক্তি হয়ে উঠেছে। সেই শক্তি ফাইনালেও তাদের সম্বল হয়ে উঠবে।
ম্যাচ: ১৩৪তম ডুরান্ড কাপ ফাইনাল
নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি বনাম ডায়মন্ড হারবার এফসি
ভেনু: বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা
তারিখ: ২৩ অগাস্ট, ২০২৫
কিক-অফ: সন্ধ্যা ৫.৩০
সম্প্রচার: সোনি স্পোর্টস
লাইভ স্ট্রিমিং: SonyLIV