সদ্যসমাপ্ত আইএসএলের ২০২৩-২৪ মরশুমে বেশিরভাগ ম্যাচই দর্শকদের উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে দিয়েছে চরমে। অনেক ম্যাচে প্রথম থেকে শেষ মিনিট পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা বজায় থেকেছে। আর বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা যখন তাদের প্রিয় দুই প্রধানের খেলা দেখেন, তখন তো তাদের উন্মাদনার কোনও সীমা থাকে না।

গত বারের মতো এ বারও দুই প্রধানের ডার্বিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। ফলে সমর্থকেরাও প্রায় সবসময়ই তাদের আসন ছেড়ে উঠে প্রায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খেলা দেখেছেন সর্বক্ষণ। তবে শুধু ডার্বি নয়, কলকাতার দুই দলের আরও অনেক ম্যাচেই উত্তেজনার পারদ ওঠে চরমে। এমন কোন বিশেষ ম্যাচগুলিতে এ রকম হয়েছিল, তা একবার পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে নেওয়া যাক।

মোহনবাগান এসজি বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি, ২-২, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

সেই ম্যাচে কলকাতা ডার্বি তার চেনা আগুনে মেজাজে ফেরে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। সারা ম্যাচে দুই দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে সে দিন। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ৯০ মিনিটের সেই ফুটবল যুদ্ধ দেখেন গ্যালারির হাজার ষাটেক দর্শক। তুমুল উত্তেজনার মধ্যেই হয় চার-চারটি গোল। শেষ পর্যন্ত ২-২-এ খেলা শেষ করে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ও ইস্টবেঙ্গল এফসি। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে সেই প্রথম কলকাতা ডার্বি অমীমাংসিতই থেকে গেল।

ম্যাচের শুরুতেই গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন জীবনে প্রথম ডার্বিতে নামা মণিপুরী তরুণ অজয় ছেত্রী। ১৭ মিনিটের মাথায় সমতা আনেন মোহনবাগানের আলবানিয়ান ইউরো কাপার আরমান্দো সাদিকু। বিরতিতে ১-১ থাকার পর ৫৫ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ফের এগিয়ে দেন লাল-হলুদ অধিনায়ক ক্লেটন সিলভা। তবে তাদের জয়ের সম্ভাবনায় জল ঢেলে ফের সমতা আনেন মোহনবাগানের অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। ফুটবলের যুদ্ধ ছাড়াও সে দিন দু’পক্ষের খেলোয়াড়দের পরষ্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বও বাধে দফায় দফায়। সারা ম্যাচে মোট ২২টি ফাউল হয় এবং রেফারি দশবার হলুদ কার্ডও দেখান, দুই দলের পাঁচ জন করে খেলোয়াড়কে।

কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি মোহনবাগান এসজি, ৩-৪, ১৩ মার্চ, ২০২৪

সে দিন সাত গোলের ফোয়ারা দেখে কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম, যেমন দেখেছিল গত আইএসএল ২০২২-২৩ মরশুমে। সে বার ৫-২-এ ম্যাচ জিতে কলকাতায় ফিরেছিল সবুজ-মেরুন ব্রিগেড, এ বারও জয়ের হাসি মুখে নিয়েই মাঠ ছাড়ে তারা। ৪-৩-এ জিতে লিগ টেবলের দুই নম্বরে রয়ে যায় তারা।

তিন দিন আগেই কলকাতা ডার্বি খেলার ক্লান্তি নিয়ে সে দিন জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে নেমেছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী। এই স্টেডিয়ামের মাঠে নামা মানে তাদের অত্যুৎসাহী সমর্থকদের বিরুদ্ধেও নামা। তার ওপর ৭৭ শতাংশ আর্দ্রতা। কোনও কিছুই সে দিন তাদের অনুকুলে ছিল না। তবু প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের শব্দব্রহ্ম থেকেই নিজেদের উজ্জীবিত করে তোলেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর ফুটবলাররা।

ম্যাচের শুরুতে চতুর্থ মিনিটেই গোল করে দলকে এগিয়ে দেন আলবানিয়ার ফরোয়ার্ড আরমান্দো সাদিকু। সেই গোলেই এগিয়ে থেকে বিরতিতে যান তাঁরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে যা হয়, তাকে সাইক্লোন বললেও বোধহয় কম বলা হবে। গোলের ঝড় শুরু হয়। বিরতির পর ১৪ মিনিটের মধ্যে পরপর চারটি গোলে ম্যাচের ছবিটা পুরো বদলে যায়।

উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা স্টেডিয়ামে প্রথমে ৫৪ মিনিটে মোহননের গোলে সমতা আনে ব্লাস্টার্স। ৬০ মিনিটে দ্বিতীয় গোল করে ফের ব্যবধান তৈরি করেন সাদিকু। ৬৩ মিনিটে ফের সমতা আনেন ব্লাস্টার্সের গ্রিক ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস। তার পাঁচ মিনিট পরেই কর্নার থেকে হেডের গোলে মোহনবাগানকে ফের এগিয়ে দেন দীপক টাঙরি। ম্যাচের শেষে স্টপেজ টাইমের শেষ মুহূর্তে ফের গোল করে ব্যবধান বাড়ান রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামা জেসন কামিংস। তারও পরে শেষ বাঁশি বাজার ঠিক আগে নিজের দ্বিতীয় গোল করে ব্যবধান কমান দিয়ামান্তাকস। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেননি তিনি।

মোহনবাগান এসজি বনাম চেন্নাইন এফসি, ২-৩, ৩১ মার্চ, ২০২৪

মরশুমের মাঝে আন্তোনিও লোপেজ হাবাস কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের আটটি অপরাজিত ম্যাচের দৌড় এই ম্যাচে থামায় লিগ টেবলের এগারো নম্বরে থাকা চেন্নাইন এফসি। সে দিন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে তারা ৩-২-এ জেতে। অপ্রত্যাশিত এই হারের ফলে মোহনবাগান লিগশিল্ডের দৌড়ে মুম্বই সিটি এফসি-র চেয়ে পিছিয়ে পড়ে।
অসুস্থতার জন্য সে দিন দলের সঙ্গে মাঠে থাকতে পারেননি হেড কোচ হাবাস। ছন্দে ছিলেন না দলের অন্যতম সেরা ফুটবলার দিমিত্রিয়স পেট্রাটসও। ফলে বিরতিতে এক গোলে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও জয়ের হাসি মুখে নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেননি আরমান্দো সাদিকুরা। ম্যাচের শেষ ২৫ মিনিটের মধ্যে তিন-তিনটি গোল করে তাদের লিগশিল্ড জয়ের স্বপ্নে বড়সড় আঘাত করে ওয়েন কোইলের দল।

প্রথমার্ধে জনি কাউকোর গোলে এগিয়ে যাওয়া মোহনবাগান ৭২ মিনিটের মাথায় প্রথম গোল খায়। জর্ডন মারের এই গোলের পর ৮০ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন বিদেশী ডিফেন্ডার রায়ান এডওয়ার্ডস। স্টপেজ টাইমের চতুর্থ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে সমতা এনে দেন পেট্রাটস। কিন্তু একেবারে শেষ মিনিটে জয়সূচক গোল করে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের গ্যালারিকে নিস্তব্ধ করে দেন চেন্নাইনের পরিবর্ত ফরোয়ার্ড ইরফান ইয়াডওয়াড।

কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি, ২-৪, ৩ এপ্রিল, ২০২৪

কেরালা ব্লাস্টার্সের মাঠে গিয়ে যে ভাবে তাদের হারিয়ে দিয়ে এসেছিল মোহনবাগান এসজি, সেই কাণ্ডই ঘটায় তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল এফসি-ও। কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে হলুদ ও লাল-হলুদ বাহিনীর লড়াইয়ে কেরালা ব্লাস্টার্সকে ৪-২-এ হারিয়ে ১১ নম্বর থেকে সাত নম্বরে উঠে আসে ইস্টবেঙ্গল। জোড়া গোল করেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার সল ক্রেসপো ও নাওরেম মহেশ সিং।

আগের রাতেই প্লে অফে জায়গা পাকা করে ফেলেছিল ব্লাস্টার্স। তা সত্ত্বেও সে দিন নিজেদের মাঠে নেমে মেজাজ ধরে রাখতে না পারার মাশুল দিতে হয় ব্লাস্টার্সের দুই তরুণ সদস্য মিডফিল্ডার জিকসন সিং ও ডিফেন্ডার নাওচা সিংকে। এই দু’জন লাল কার্ড দেখায় সে দিন ন’জনে খেলতে হয় কেরালা ব্লাস্টার্সকে। ফলে ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করতে সুবিধা হয় লাল-হলুদ বাহিনীর। তাও দু’টি গোল শোধ করে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল হলুদ-বাহিনী। এর মধ্যে প্রথমটি করেন তাদের লিথুয়ানিয়ান ফরোয়ার্ড ফেদর সেরনিচ। অন্যটি ছিল আত্মঘাতী গোল, ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডার হিজাজি মাহেরের।

ম্যাচের মোড় ঘোরে প্রথমার্ধের একেবারে শেষ দিকে, যখন ৪৫ মিনিটের মাথায় ভারতীয় দলের ফুটবলার জিকসন সিং ম্যাচের দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যান। স্টপেজ টাইমে আরও বড় ভুল করেন তাদের গোলকিপার করণজিৎ সিং। গোলমুখী বিষ্ণুকে বক্সে অবৈধ ভাবে বাধা দিয়ে ইস্টবেঙ্গলকে পেনাল্টি ‘উপহার’ দেন তিনি, যা থেকে গোল পান ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় সল ক্রেসপো।

জিকসনের পর ৭৫ মিনিটে লাল কার্ড দেখেন নাওচা সিং, যিনি বল ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলের আমন সিকে-র মুখে বিপজ্জনক ভাবে ঢুঁসো মারেন। আঘাত পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আমন। নাওচাকে লাল কার্ড দেখানোর সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় নেননি রেফারি। ন’জন নিয়েই অবশ্য তুমুল লড়াই চালিয়ে যায় ব্লাস্টার্স। কিন্তু ঘরের মাঠে শেষরক্ষা করতে পারেনি তারা। শেষে রেফারি সাত মিনিট বাড়তি সময় দিলেও আর লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না কেরালার দলের ফুটবলারদের মধ্যে।

মোহনবাগান এসজি বনাম মুম্বই সিটি এফসি, ২-১, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪

আগের আটবার যা পারেনি তারা, সে দিন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সেটাই করে দেখায় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এক নয়, জোড়া অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়ে প্রথমবার আইএসএলে লিগসেরার খেতাব জেতে এবং লিগের ইতিহাসে প্রথম তারা হারায় মুম্বই সিটি এফসি-কে।

যুবভারতীর ভরা গ্যালারির সামনে আইএসএল ২০২৩-২৪-এর লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়ন মুম্বই সিটি এফসি-কে ২-১-এ হারিয়ে লিগসেরার খেতাব জিতে নেয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। ম্যাচের ২৮ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসোর গোলে এগিয়ে যায় মোহনবাগান এসজি। ৮০ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড জেসন কামিংস। সারা ম্যাচে গোলের জন্য মরিয়া মুম্বই সিটি এফসি-কে অবশেষে ৮৯ মিনিটর মাথায় গোল এনে দেন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে। এই ম্যাচ ড্র করলেই লিগশিল্ড উঠত মুম্বইয়ের ফুটবলারদের হাতে। কিন্তু ম্যাচের শেষ ১০ মিনিট দশ জনে খেলেও মুম্বইকে সেই আকাঙ্খিত গোলটি করতে দেয়নি মোহনবাগানের দুর্ভেদ্য রক্ষণ।

নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে যে ধাক্কাটা খায় মোহনবাগান, তা ছিল অভাবনীয়। ব্রেন্ডান হ্যামিল লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়ে চলে যান। প্রথমে থ্রো ইনে সময় নষ্ট করার জন্য ও পরে রেফারির সঙ্গে তর্ক করার জন্য তাঁকে লাল কার্ড দেখানো হয়। অর্থাৎ, বাড়তি যে আট মিনিট দেন রেফারি, তার পুরোটাই মোহনবাগান খেলে দশজনে।
বাড়তি সময়ে অশান্ত হয়ে ওঠে মাঠের পরিবেশ, যখন কামিংস ও আপুইয়ার মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয় এবং দু’জনেরই সতীর্থরা এসে একে অপরের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। আট মিনিট বাড়তি সময় দিলেও তা দশ মিনিট গড়িয়ে যায়। কিন্তু বাড়তি সময়ে পেয়েও তা মুম্বইকে কাজে লাগাতে দেয়নি মোহনবাগান।

মোহনবাগান এসজি বনাম ওডিশা এফসি, ২-০, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সেমিফাইনালের প্রথম লেগে হারের বদলা নিয়ে ওডিশা এফসি-কে ২-০-য় হারিয়ে আইএসএল ২০২৩-২৪-এর ফাইনালে ওঠে গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। দুই সেমিফাইনাল মিলিয়ে ৩-২-এ জিতে টানা দ্বিতীয়বার আইএসএলের ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা।

উত্তেজনায় ঠাসা সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে প্রথমার্ধে জেসন কামিংস গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। দ্বিতীয়ার্ধের স্টপেজ টাইমে সহালের গোলে ফাইনালে ওঠে তারা। প্রথম লেগে ঘরের মাঠে যে রকম দাপট দেখিয়েছিল ওডিশা এফসি, সে দিন সেই দাপট দেখা যায়নি তাদের খেলায়। এক সময় মোহনবাগান সমর্থকদের প্রিয় তারকা রয় কৃষ্ণাকেও সে দিন বেশি নড়চড়া করতে দেননি হেক্টর ইউস্তেরা।

এই ম্যাচের আগে সবুজ-মেরুন বাহিনীর স্প্যানিশ ডিফেন্ডার ইউস্তে কথা দিয়েছিলেন রয়কে গোল করতে দেবেন না। এ দিন তিনি ও তাঁর সতীর্থরা প্রতিপক্ষের কাউকেই গোল করতে দেননি। সারা ম্যাচে যেখানে দশটি শট গোলে রাখেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটসরা, সেখানে চারটির বেশি শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি আহমেদ জাহুরা। বল দখলের লড়াইয়ে তারা এগিয়ে থাকলেও আটটির বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি ওডিশা এফসি। সেখানে ১৪টি গোলের সুযোগ তৈরি করে মোহনবাগান। দাপট একেই বলে।