গোল না খেলে আর কীসের হার? তাই ফুটবলে কোচেরা গোলকিপারদের ওপর ভরসা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সদ্যসমাপ্ত আইএসএলের ২০২৩-২৪ মরশুমেও তার অন্যথা হয়নি একেবারেই। আর গোলকিপাররাও প্রাণ দিয়ে নিজেদের দূর্গ সামলেছেন।

তবে সবাই যে সফল হতে পেরেছেন তা নয়। আসলে গোলকিপারদের সাফল্য অনেকটা নির্ভর করে দলের রক্ষণের ওপরও। যে দলের রক্ষণ শক্তিশালী, সেই দলের গোলকিপারদের ওপর ততটা চাপ থাকে না, যতটা থাকে দলের রক্ষণ দুর্বল হলে। কিন্তু কিছু কিছু অবধারিত গোল বাঁচিয়ে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দেন গোলকিপাররা এবং সেগুলি যত বেশি ঘটাতে পারে তারা, ততই তাদের সফল বলে মনে করা হয়।

এ বারের আইএসএলে সে রকমই কয়েকজন গোলকিপার নিজেদের সেরা প্রমাণ করেছেন। তাঁরা ধারাবাহিক ভাবে প্রায় প্রতি ম্যাচেই নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। সারা লিগে একই রকম দুর্ভেদ্য থেকেছেন। দু-একটা ম্যাচে হয়তো চেনা ছন্দে পাওয়া যায়নি তাঁদের। কিন্তু লিগের বেশির ভাগ ম্যাচেই তাঁরা ছিলেন একই রকম অদম্য। এমনই চার গোলকিপারকে নিয়ে এই প্রতিবেদন।

ফুর্বা লাচেনপা, মুম্বই সিটি এফসি, ক্লিন শিট ৯


ভারতীয় ফুটবল কিংবদন্তি বাইচুং ভুটিয়ার রাজ্য সিকিম থেকে উঠে আসা গোলকিপার ফুর্বা লাচেনপা-ই এ বারের আইএসএলের সেরা তারকা গোলকিপার। সেজন্য কাপ চ্যাম্পিয়নদের গোলপ্রহরীকে গোল্ডেন গ্লাভ সন্মানও দেওয়া হয়েছে। গোল খাননি, এমন ম্যাচের বা ক্লিন শিটের সংখ্যার (৯) দিক থেকে তিনি, ওডিশা এফসি-র অমরিন্দর সিং এবং মোহনবাগান এসজি-র বিশাল কয়েথ একই জায়গায় থাকলেও প্রতি গোল হজম করার গড় সময়ের (১০৮.৩৫ মিনিট) বিচারে তিনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকায় সেরার পুরষ্কার ওঠে লাচেনপার হাতেই।

সারা লিগে যতগুলি শট তাঁর গোলের দিকে ধেয়ে এসেছে, তার মধ্যে ৭১% বাঁচিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন তিনি। যদিও গত মরশুমের চেয়ে এ মরশুমে তাঁর এই পরিসংখ্যান ভাল নয়। তবে গতবারের সাতটি ক্লিন শিটের তুলনায় এ বার নিজেকে অনেক ভাল ভাবে দুর্ভেদ্য প্রমাণ করতে পেরেছেন মুম্বই সিটি এফসি-র গোলকিপার।

অমরিন্দর সিং, ওডিশা এফসি, ক্লিন শিট- ৯


ধারাবাহিক ভাবে এই মরশুমেও নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন ওডিশা এফসি-র গোলকিপার অমরিন্দর সিং। আগে শুধু গোলকিপার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এ বার দলকে সবার পিছন থেকে নেতৃত্ব দিয়ে নিজেকে আরও কার্যকরী করে তুলেছেন তিনি। সের্খিও লোবেরার সিস্টেমে একটা বৈশিষ্ট দেখা যায়, যেখানে গোলকিপারকেও পায়ে বল নিয়ন্ত্রণে দক্ষ হতে হয়। অমরিন্দর কিন্তু সেই ক্ষমতা রপ্ত করে ফেলেছেন। ফলে কোচেরও ভরসার পাত্র হয়ে উঠেছেন। ছোট পাস বা লং বল বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা অনস্বীকার্য।

এ বারের আইএসএলে তিনি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেভ করেছেন। সব মিলিয়ে ২৪টি ম্যাচে ৮১টি গোল বাঁচান তিনি। এবং ন’টি ম্যাচে কোনও গোল খাননি। গড়ে ৯১.২৫ মিনিট অন্তর একটি করে গোল খেয়েছেন। তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ৭৭%, যা গত মরশুমের চেয়ে অনেক ভাল (৬২%)। গত বার ক্লিন শিটের সংখ্যাও অনেক কম ছিল তাঁর (২)। এ বার সে তুলনায় অনেক উন্নতি করেছেন তিনি।

বিশাল কয়েথ, মোহনবাগান এসজি, ক্লিন শিট-৯


গত মরশুমে সবুজ-মেরুন শিবিরে যোগ দেওয়ার পর থেকেই গোলকিপার হিসেবে নিজের সেরা সময় খুঁজে পেয়েছেন বিশাল। গত বছর যে ভাবে দলের কাপ জয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, দু-দু’বার টাই ব্রেকারে প্রতিপক্ষের শট আটকে, এ বার সারা লিগে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে কাউকে টাইব্রেকার পর্যন্ত যাওয়ারও সুযোগ দেননি তিনি। অবশ্য দলের দুর্দান্ত রক্ষণের কাছ থেকে তিনি অনেক সাহায্য পেয়েছেন বিশাল।

মাত্র ২৭ বছর বয়সেই গোলকিপিংয়ে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তিনি, যা এই বয়সে বেশ কঠিন। এ মরশুমে মোহনবাগানের প্রতি ম্যাচে গোলের নীচে দাঁড়িয়েছেন তিনি, খেলেছেন ২২৫০ মিনিট। আর কোনও গোলকিপারই এ মরশুমে এতক্ষণ মাঠে থাকতে পারেননি। এবং প্রায় প্রতি ম্যাচেই সেরা ফর্মে ছিলেন বিশাল। উচ্চতার সঙ্গে তাঁর ক্ষিপ্রতা তাঁর গোলকিংয়ের দক্ষতাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ মরশুমে সবচেয়ে বেশি (৩) পেনাল্টি সেভ করেছেন তিনিই। লাচেনপা ও অমরিন্দরের মতো তিনিও ৯টি ক্লিন শিট রাখতে পেরেছেন। মোট ৫০টি সেভ করেছেন তিনি। গতবার অবশ্য তাঁর পারফরম্যান্সের খতিয়ান আরও ভাল ছিল। ১১টি ক্লিন শিট রেখে মোট ৬৮টি সেভ করেছিলেন তিনি।

প্রভসুখন সিং গিল, ইস্টবেঙ্গল এফসি, ক্লিন শিট-৭



তাঁর দলের পারফরম্যান্স এ বার তেমন ভাল না হলেও ইস্টবেঙ্গল এফসি-র গোলকিপার প্রভসুখন গিল কিন্তু তাঁর জায়গায় অন্যতম সেরা হয়ে ওঠার প্রমাণ দিয়েছেন বহু ম্যাচেই। গত বার পর্যন্ত গোলকিপিং নিয়ে লাল-হলুদ শিবিরে যথেষ্ট সমস্যা ছিল। এ বার সেই সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছেন প্রভসুখন।

এ বার কলকাতার দলে যোগ দিয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে কোচের এই একটা দিকে চিন্তা দূর করে দেন গিল। কিন্তু শুধু গোলকিপার ধারাবাহিকতা দেখালেই দলের সাফল্য আসে না, অন্যান্য বিভাগের খেলোয়াড়দেরও ধারাবাহিক হতে হয়। তা না হওয়ায় শুধু গিল তাঁর দক্ষতা দিয়ে দলকে সাফল্য এনে দিতে পারেননি। অথচ সাত-সাতটি ম্যাচে গোল খাননি তিনি। মূলত তাঁর জন্যই ইস্টবেঙ্গল এ বার তাদের রক্ষণকে আগের তিন বারের চেয়ে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী প্রমাণ করতে পেরেছে। এর আগে আইএসএলের কোনও মরশুমে সাতটি ক্লিন শিট রাখতে পারেনি লাল-হলুদ ব্রিগেড। সব মিলিয়ে এ মরশুমে ৫৪টি সেভ করেছেন গিল ও তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ৬৮%। গত মরশুমের পারফরম্যান্সের চেয়ে এই পারফরম্যান্স প্রায় দ্বিগুন উন্নত।