এক গোলে পিছিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত ৩-১-এ জিতে চলতি হিরো আইএসএলের ফাইনালের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেল হায়দরাবাদ এফসি। শনিবার বাম্বোলিমে দ্বিতীয় সেমিফাইনালের প্রথম লেগে এই হারের ফলে এটিকে মোহনবাগানের ফাইনালে ওঠার রাস্তা বেশ দূর্গম হয়ে উঠল। ফাইনালে উঠতে গেলে বুধবার দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে তাদের অন্তত তিন গোলের ব্যবধানে জিততেই হবে, যা হায়দরাবাদের মতো দলের বিরুদ্ধে যে বেশ কঠিন, তা প্রমাণ করে দিলেন স্প্যানিশ কোচ মানুয়েল মার্কেজের দল।

শনিবার ১৮ মিনিটে রয় কৃষ্ণার গোলে গতবারের রানার্স আপ-রা এগিয়ে গেলেও প্রথমার্ধের একেবারে শেষে এক মুহূর্তের জন্য সবুজ-মেরুন ডিফেন্সের ফোকাস নড়ে যাওয়ায় বার্থোলোমিউ ওগবেচে লিগে তাঁর ১৮ নম্বর গোলটি করে সমতা আনেন। দ্বিতীয়ার্ধে মাত্র ছ’মিনিটের ব্যবধানে পরপর দু’টি গোল করে দলকে জয় এনে দেন ইয়াসির মহম্মদ ও সিভেরিও। প্রথমার্ধে যথেষ্ট গোছানো ফুটবল খেললেও দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি এক জোড়া খেলোয়াড় পরিবর্তনের পরেই এটিকে মোহনবাগান বেশ আগোছালো হয়ে যায় এবং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ম্যাচ জিতে নেন ওগবেচেরা।

শনিবার বাম্বোলিমে মনবীর সিংকে ডাগ আউটে বসিয়ে রেখে প্রথম এগারো নামায় এটিকে মোহনবাগান। কার্ল ম্যাকহিউও ছিলেন পরিবর্তদের তালিকায়। আক্রমণ বিভাগে তিন বিদেশি রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস ও জনি কাউকোকে রেখে প্রথম এগারো সাজান কোচ হুয়ান ফেরান্দো। অন্য দিকে, গত দুই ম্যাচে খেলতে না পারলেও বার্থোলোমিউ ওগবেচে এ দিন হায়দরাবাদের প্রথম এগারোয় ছিলেন এবং গোলও করেন।

শুরুর দিকে আক্রমণের ঝড় না তুলে বল পজেশন বাড়ানোর দিকে মন দেয় এটিকে মোহনবাগান। হায়দরাবাদ এফসি-ও অযথা ঝুঁকি নেওয়ার চেষ্টা করেনি। রয় কৃষ্ণা গোলের সামনে না থেকে ডান উইং বরাবর আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। বাঁ দিক দিয়ে উঠছিলেন লিস্টন এবং মাঝখানে কাউকো ও ডেভিড।

ম্যাচের ১৪ মিনিটের মাথাতেই গোলের সহজ সুযোগ পেয়ে যান ডান দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে পড়া জনি কাউকো। মাঝমাঠে অনিকেত যাদবের পা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া বল ডেভিড উইলিয়ামসের পায়ে এলে তিনি তা সামনে বাড়ান কাউকোর উদ্দেশ্যে। গোলকিপার লক্ষ্মীকান্ত কাট্টিমণি বিপদের গন্ধ পেয়ে এগিয়ে আসেন এবং কাউকোর শট আটকে দেন।

তবে ১৮ মিনিটের মাথায় বাঁ দিকের উইং দিয়ে উঠে গোলের ক্রসটি দেন লিস্টন এবং তাঁর নিখুঁত ক্রসে পা লাগিয়ে বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দেন চেনা রয় কৃষ্ণা (১-০)। তাঁর পায়ের এই টাচ-ই এতদিন খুঁজে পাচ্ছিলেন না সমর্থকেরা। যদিও দ্বিতীয়ার্ধে আর এই কৃষ্ণাকে দেখা যায়নি। আকাশ মিশ্র তাঁকে কড়া পাহাড়ায় রেখেও শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারেননি। লিস্টন যে ভাবে নিম দোরজিকে ধোঁকা দিয়ে ইনসাইড কাট করে বক্সে ঢোকেন, তাও প্রশংসাযোগ্য।

এই গোলের পরে নিজেদের দূর্গ বাঁচানোর দিকে বেশি মন দেয় সহুজ-মেরুন বাহিনী। গোল খাওয়ার পরেই যে তা শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে হায়দরাবাদ, তা মাথায় রেখেই এই দিকে বেশি ফোকাস করে তারা। যার জেরে বিপক্ষের বক্সে ঢুকতে পারছিলেন না ওগবেচেরা। ওই অঞ্চলে ঢুকতে গিয়ে বাধা পাওয়ায় তারা ৩৮ মিনিটে বক্সের সামনে ফ্রিকিক পেলেও তাদের তা কাজে লাগাতে দেয়নি সবুজ-মেরুনের দুর্ভেদ্য ওয়াল। সেই দেওয়ালেই আটকে যায় ফ্রিকিক।

প্রথমার্ধের বাকি সময়ে খেলাটা মূলত মাঝমাঠেই আবদ্ধ থাকে। দু’পক্ষই কয়েকটি সুযোগ তৈরির চেষ্টা করলেও দুই দলেরই রক্ষণের তৎপরতায় কোনও দলের অ্যাটাকাররাই সফল হতে পারেননি। কিন্তু প্রথমার্ধের স্টপেজ টাইমের শেষ মুহূর্তে যে ভাবে গোল শোধ করে হায়দরাবাদ, তার জন্য এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণই মূলত দায়ী। একেবারে শেষ মুহূর্তে মনঃসংযোগ বজায় রাখতে না পারার মাশুল দিতে হয় ডিফেন্ডারদের।

কর্নার থেকে বল গোলের সামনে জটলার মধ্যে উড়ে আসার পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় হুয়ানানের পায়ে। তিনি গোলের সামনে অরক্ষিত অবস্থায় থাকা ওগবেচেকে বল দেন এবং হেড করে লিগের ১৮ নম্বর গোলটি করতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি নাইজেরিয়ান বিশ্বকাপার। মাথার ডানদিক দিয়ে হেড করে বল জালে জড়িয়ে দেন তিনি (১-১)। ওই সময়ে বক্সের মধ্যে এটিকে মোহনবাাগানের অন্তত সাতজন খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও গোল আটকাতে পারেননি।

অবধারিত ভাবে দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ফের ব্যবধান তৈরির চেষ্টা শুরু করে। যদিও রয় দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করেন একটু পিছন থেকে। ৫১ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক থেকে দীপক টাঙরির লম্বা পাসে গোলের সামনে পেলেও হুয়ানানের বাধায় ব্যর্থ হন কাউকো। ৫৩ মিনিটের মাথায় একসঙ্গে জোড়া পরিবর্তন করেন ফেরান্দো। ডেভিডের জায়গায় কার্ল এবং লেনির জায়গায় মনবীর। ডেভিড এ দিন কিছুটা লিষ্প্রভ ছিলেন বলেই হয়তো তাঁকে তুলে নেন কোচ। তবে লেনি এই সময়ে খুব একটা খারাপ ফর্মে ছিলেন না। এটিকে মোহনবাগানের পারফরম্যান্সে ধস নামে এই দুই পরিবর্তনের পর থেকেই।

এই জোড়া পরিবর্তনই দলের মাঝমাঠকে বেশ কিছুটা দুর্বল করে দেয় এবং এই এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই ৫৮ মিনিটের মাথায় ব্যবধান তৈরি করে ফেলে হায়দরাবাদ। বক্সের বাইরে থেকে যখন সিভেরিওকে বল দেন ওগবেচে, তখন তাঁকে আটকাতে দুই দিক থেকে দৌড়ে এসে মাঠে লুটিয়ে পড়েন সন্দেশ ও কাউকো। সিভেরিওর পা থেকে ছিটকে আসা বল পেয়ে সোজা গোলে শট নেন ইয়াসির মহম্মদ (১-২)।

এই গোলের পরে তিরিকেও চোটের জন্য তুলে নিতে বাধ্য হন ফেরান্দো। তাঁকে তুলে বুমৌসকে নামান তিনি। কিন্তু তিরি বেরিয়ে যাওয়ায় সবুজ-মেরুন রক্ষণও দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার আগেই ফের হানা দেন হায়দরাবাদের ফুটবলাররা এবং সফলও হন। এ বারে ইয়াসিরের কর্নারে হেড করে গোল করেন সিভেরিও (১-৩)। প্রীতম কোটাল তাঁকে পাহাড়ায় রাখা সত্ত্বেও তাঁর হেডের সময় আটকাতে পারেননি।

এই সময়ে খেলায় ফিরে আসার জন্য সবুজ-মেরুন বাহিনীর আক্রমণের ঝড় তোলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ধীরে সেই চেষ্টা শুরু করে তারা। ৭২ মিনিটের মাথায় লিস্টন বাঁ দিকে দিয়ে আক্রমণে উঠে বক্সে ঢুকে সোজা গোলকিপারের গায়ে শট মারেন। ৭৫ মিনিটের মাথায় বিপক্ষের বক্সের ডানদিকে রয়ের কাছ থেকে বল পেয়ে বুমৌস কাট ব্যাক করেন জনি কাউকোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি ফের লক্ষ্যভ্রষ্ট হন।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ন’মিনিট আগে সন্দেশের জায়গায় প্রবীর দাস ও দীপক টাঙরির জায়গায় কিয়ান নাসসিরিকে নামান ফেরান্দো। কিয়ান নামার পরেই ডানদিক দিয়ে উঠে গোলের সামনে ক্রস করেন মনবীরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মনবীর বলের জায়গায় ঠিকমতো পৌঁছতেই পারেননি।

ম্যাচের শেষ দশ মিনিটে হায়দরাবাদের শক্তিশালী ডিফেন্স নিজেদের সেরা জায়গায় চলে আসে এবং বিপক্ষকে কোনও সুযোগই কাজে লাগাতে দেননি। স্টপেজ টাইমে পরপর দু’টি কর্নার পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি তাঁরা। কিয়ান নাসিরির একটি শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। বুধবার এটিকে মোহনবাগান যদি নির্ধারিত সময়ে দুই গোলে এগিয়ে থাকতে পারে, তা হলে অতিরিক্ত সময়ে তা নিষ্পত্তি হবে। না হলে টাইব্রেকারে গড়াতে পারে ম্যাচ।

এটিকে মোহনবাগান দল: অমরিন্দর সিং (গোল), প্রীতম কোটাল (অধি), সন্দেশ ঝিঙ্গন (প্রবীর দাস), তিরি (হুগো বুমৌস), শুভাশিস বোস, লেনি রড্রিগেজ (মনবীর সিং), দীপক টাঙরি (কিয়ান নাসিরি), জনি কাউকো, ডেভিড উইলিয়ামস (কার্ল ম্যাকহিউ), লিস্টন কোলাসো, রয় কৃষ্ণা।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: হায়দরাবাদ এফসি ৪৬% - এটিকে মোহনবাগান ৫৪%

সফল পাস: ২৯৮/৩৯০ (৭৬%) - ৩৮৫/৪৮৭ (৭৯%), গোলে শট: ৩-৫, ফাউল: ৭-১১, সেভ: ৪-০, ইন্টারসেপশন: ১৯-১৫, কর্নার: ৫-৯, হলুদ কার্ড: ০-০, ম্যাচের সেরা: বার্থোলোমিউ ওগবেচে