এটিকে মোহনবাগানের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল মুম্বই সিটি এফসি। রবিবার বাম্বোলিমের জিএমসি স্টেডিয়ামে ২-০ গোলে জিতে এ বারের হিরো আইএসএলের শীর্ষস্থান দখল করল তারা। ফলে আগামী মরশুমে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্লাব-লিগ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল স্প্যানিশ কোচ সের্খিও লোবেরার দল। গত বছর এফসি গোয়াকে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দরজায় পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পর এ বছর মুম্বই সিটি এফসি-কেও সেই সম্মান এনে দিলেন ‘সুপার কোচ’ লোবেরা।

হিরো আইএসএলের সফলতম কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের সবুজ-মেরুন বাহিনীর সামনে অবশ্য এখন সেমিফাইনালে জিতে ফাইনালে ওঠার লক্ষ্য, যেখানে তাদের খেলতে হবে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে। অন্য সেমিফাইনালে মুম্বইয়ের সামনে এফসি গোয়া, যারা এ দিন ফতোরদা স্টেডিয়ামে হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করে লিগ টেবলের চার নম্বর জায়গাটা সুরক্ষিত করে। সেমিফাইনালে প্রথম লেগে ৫ মার্চ মুখোমুখি হবে মুম্বই ও গোয়া এবং পরের দিন এটিকে মোহনাবাগান নামবে নর্থইস্টের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় লেগ ৮ ও ৯ মার্চ।

এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের টিকিট পাওয়ার জন্য এ দিন মুম্বই সিটি এফসি-র সামনে জয় ছাড়া কোনও রাস্তা ছিল না। এটিকে মোহনবাগান ড্র করলেই সেই সম্মান অর্জন করে নিতে পারত। কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও (নীচে পরিসংখ্যান দেখুন) মুম্বইয়ের দু’টি গোল শোধ করতে পারেননি রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসরা। সাত মিনিটের মাথায় সেনেগালিজ ডিফেন্ডার মুর্তাদা ফল গোল করে এগিয়ে দেন দলকে। ৩৯ মিনিটের মাথায় সেই ব্যবধান বাড়ান নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড বার্থোলোমিউ ওগবেচে। দু’জনেই গোল করেন হেডে। ভুল শুধরে দ্বিতীয়ার্ধে গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেও মুম্বইয়ের দুর্ভেদ্য রক্ষণ ভেদ করে বিপক্ষের জালে বল জড়াতে পারেনি এটিকে মোহনবাগান।   

  • ৪ মিনিট: বক্সের মধ্যে ফলের ক্লিয়ারেন্স উইলিয়ামসের গায়ে লেগে পৌঁছয় বক্সের ডানদিকে রয়ের কাছে। গোলে কোণাকুণি শট নেন রয়, কিন্তু তা বাঁচিয়ে দেন অমরিন্দর।
  • ৭ মিনিট: বক্সের মধ্যে রাখা আমেদ জাহুর ফ্রি কিক ডানদিক দিয়ে ঢুকে হেড করে গোলে ঠেলে দেন প্রায় অরক্ষিত মুর্তাদা ফল। মুম্বই সিটি এফসি ১-০।
  • ১৯ মিনিট: হ্যামস্ট্রিং পুল হওয়ায় মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান সন্দেশ ঝিঙ্গন। সন্দেশের জায়গায় নামেন প্রবীর দাস।
  • ৩৯ মিনিট: বক্সের বাইরে থেকে হারনান সান্তানার বাঁকানো ফ্রি কিক ক্রস বারে লেগে ফিরে আসে। ফিরতি বলে হেড করে জালে বল জড়িয়ে দেন বার্থোলোমিউ ওগবেচে। মুম্বই সিটি এফসি ২-০।
  • ৬০ মিনিট: ডানদিকের উইং দিয়ে ওঠা প্রবীর বক্সের মাথা থেকে গোলে জোরালো শট নেন। কিন্তু তা ক্রসবারে লাগে।
  • ৬৪ মিনিট: ডেভিড উইলিয়ামস বক্সের মাঝখান থেকে সোজা গোলে শট নেন, যা অমরিন্দর ফিস্ট করে বার করে দেন।
  • ৭৫ মিনিট: এডুর ফ্রিকিকে হেড করে গোলে বল ঠেলেন কার্ল ম্যাকহিউ। কিন্তু বল বারের ওপর দিয়ে চলে যায়।

এ দিন প্রথম এগারোয় দুটি পরিবর্তন করে দল নামান হাবাস। শুভাশিস বসুর জায়গায় প্রণয় হালদার ও হাভিয়ে হার্নান্ডেজের জায়গায় মার্সেলো পেরেইরা বা মার্সেলিনহো। এডু গার্সিয়া ও হাভিকে তিনি রেখে দেন রিজার্ভ বেঞ্চে।

অন্যদিকে, মুম্বই সিটি এফসি কোচ সের্খিও লোবেরা তাঁর প্রথম দলে তিনটি পরিবর্তন করেন। মান্দার রাও দেশাই, হারনান সান্তানা ও প্রাঞ্জল ভূমিজ মাঠে নামেন মেহতাব সিং, ডি ভিগ্নেশ ও সি গদার্ডের পরিবর্তে। 

দ্রুত গতিতে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে খেলা শুরু হওয়ার পরই গোলের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন রয় কৃষ্ণা। চতুর্থ মিনিটে বক্সের মধ্যে মুর্তাদা ফলের ক্লিয়ারেন্স ডেভিড উইলিয়ামসের গায়ে লেগে পৌঁছয় রয়ের কাছে। গোলে কোণাকুণি শট নেন রয়, কিন্তু তা বাঁচিয়ে দেন মুম্বই গোলকিপার অমরিন্দর।

একাধিক আক্রমণের চেষ্টার পরে সাত মিনিটের মাথাতেই গোল পেয়ে যায় সাগরপাড়ের দল। বক্সের মধ্যে রাখা আমেদ জাহুর ফ্রি কিক ডানদিক দিয়ে ঢুকে হেড করে গোলে ঠেলে দেন প্রায় অরক্ষিত মুর্তাদা ফল। যে উড়ন্ত বলে মাথা ছুঁইয়ে নিজের বারো নম্বর গোলটি দেন দীর্ঘদেহী ফল, তাঁর সামনে থাকা স্প্যানিশ ডিফেন্ডার তিরি লাফিয়ে উঠেও সেই উড়ে আসা বলের নাগাল পাননি। গত ম্যাচেও তিরি তাঁর সেরা ফর্মে ছিলেন না। এ দিনও তাঁর ফর্ম সমর্থকদের চিন্তায় ফেলে দেওয়ার পক্ষে ছিল যথেষ্ট। দ্বিতীয়ার্ধে তাঁকে বসিয়ে দিতে বাধ্য হন হাবাস।

তিরি ছন্দে ছিলেন না। চারটি হলুদ কার্ড দেখায় এই ম্যাচে দলে ছিলেন না শুভাশিস বসু। তার ওপর ম্যাচের ১৯ মিনিটের মাথায় হ্যামস্ট্রিং পুল হওয়ায় মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান সন্দেশ ঝিঙ্গনও। এর ফলে এটিকে মোহনবাগানের শক্তিশালী ডিফেন্স বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। সন্দেশের জায়গায় নামেন প্রবীর দাস, যিনি গতবার এটিকে-র হয়ে রাইট উইং ব্যাকের ভূমিকায় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই মরশুমে তাঁর কাছ থেকে সেই পারফরম্যান্স দেখা যায়নি। রবিবার অবশ্য আশা জাগান প্রবীর।

রক্ষণের দুর্বলতারই মাশুল তাদের আবার দিতে হয় ৩৯ মিনিটের মাথায়, যখন দ্বিতীয় গোল পেয়ে যায় মুম্বই সিটি এফসি। বক্সের বাইরে থেকে হারনান সান্তানার বাঁকানো ফ্রি কিক ক্রস বারে লেগে ফিরে আসে। ফিরতি বলে হেড করে জালে বল জড়িয়ে দেন বার্থোলোমিউ ওগবেচে। প্রথম গোলের ক্ষেত্রে যেমন মুর্তাদা ফল আনমার্কড্ ছিলেন, এই গোলের ক্ষেত্রেও ওগবেচে কোনও রকম পাহাড়ায় ছিলেন না। চলতি লিগের আট নম্বর গোলটি পেয়ে গেলেন তিনি। 

৪৩ মিনিটে ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন গত ম্যাচে হ্যাটট্রিক পাওয়া বিপিন সিং। কিন্তু বক্সের বাঁ দিক থেকে নেওয়া তাঁর জোরালো শট বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। স্টপেজ টাইমের শেষ মিনিটেও জাহুর ফ্রিকিক থেকে হারনান সান্তানা গোলের দিকে ব্যাক হিল করেন। কিন্তু পোস্টের সামান্য বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

দুটো গোল খেলেও প্রথমার্ধে প্রতিপক্ষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যায় এটিকে মোহনবাগান। বল পজেশন (৪৮%), গোলে শট (১-২), পাসের সংখ্যার (১৩৪-১৩৬) দিক থেকে প্রথম ৪৫ মিনিটে সমানে সমানেই লড়ছিল দুই দল। ফলে ম্যাচটা উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সুযোগকে গোলে পরিণত করা ও বিপক্ষের অ্যাটাকরদের রোখার ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ে গঙ্গাপাড়ের দল।

দ্বিতীয়ার্ধে চোট সারিয়ে দলে ফেরা এডু গার্সিয়া নামেন ফর্ম হারানো তিরির জায়গায় এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে লেনি রড্রিগেজকে তুলে নিয়ে ডিফেন্ডার সালাম রঞ্জন সিংকে নামান হাবাস। অর্থাৎ প্রথম দলের নিয়মিত তিন ডিফেন্ডারকে ছাড়াই পুরো দ্বিতীয়ার্ধ খেলতে হয় এটিকে মোহনবাগানকে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই যে সবুজ-মেরুন ঝড় ওঠার আশায় ছিলেন সমর্থকেরা, তা কিন্তু দেখা যায়নি। বরং দেখা যায় উল্টোটা। এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণের ওপর চাপ বাড়ায় মুম্বই সিটি এফসি। ক্রমশ সেই চাপ সামলে পাল্টা আক্রমণে ওঠা শুরু করে এটিকে মোহনবাগান। কিন্তু মুম্বইয়ের তৎপর ডিফেন্সের জন্য বারবার বাধা পাচ্ছিল তারা।

৬০ মিনিটের মাথায় ডানদিকের উইং দিয়ে ওঠা প্রবীর বক্সের মাথা থেকে গোলে জোরালো শট নেন। কিন্তু তা ক্রসবারে লাগে। ৬৪ মিনিটের মাথায় ডেভিড উইলিয়ামস বক্সের মাঝখান থেকে সোজা গোলে শট নেন, যা অমরিন্দর ফিস্ট করে বার করে দেন। তার আগেই প্রবীরের ক্রস থেকে হাঁটু দিয়ে বল ঠেলেন রয়। সেবারও বাঁচিয়ে দেন মুম্বই গোলকিপার। ৭৫ মিনিটের মাথায় এডুর ফ্রিকিকে হেড করে গোলে বল ঠেলেন কার্ল ম্যাকহিউ। কিন্তু বল বারের সামান্য ওপর দিয়ে চলে যায়।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আট মিনিট আগে মার্সেলো পেরেইরাকে তুলে হাভিয়ে হার্নান্ডেজ নামেন। উদ্দেশ্য অবশ্যই আক্রমণে ধার বাড়ানো। শেষ ২৫ মিনিট ঘন ঘন আক্রমণে ওঠে এটিকে মোহনবাগান। এই সময়টা বেশিরভাগই খেলা হয় মুম্বইয়ের অর্ধে। তবে এই চাপ যথেষ্ট দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামলান দুগোলে এগিয়ে থাকা মুম্বইয়ের ফুটবলাররা। রক্ষণে দ্বিস্তরীয় দেওয়াল তুলে দেন তাঁরা। যা ভেদ করে বল জালে জড়ানো বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভবও হয়ে ওঠেনি সবুজ-মেরুন বাহিনীর পক্ষে।

এটিকে মোহনবাগান দল: অরিন্দম ভট্টাচার্য (গোল),সন্দেশ ঝিঙ্গন (প্রবীর দাস), তিরি (এডু গার্সিয়া), প্রীতম কোটাল, লেনি রড্রিগেজ (সালাম রঞ্জন সিং), কার্ল ম্যাকহিউ, প্রণয় হালদার, মনবীর সিং, মার্সেলো পেরেইরা (হাভিয়ে হার্নান্ডেজ), রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস।

পরিসংখ্যানের যুদ্ধ

বল পজেশন: এটিকে মোহনবাগান ৫১% - মুম্বই সিটি এফসি ৪৯%

সফল পাস: ১৯৬/৩৪৬ (৫৭%) - ১৪৭/২৯০ (৫১%)

গোলে শট: ২-২

ফাউল: ১৪-১৭

ইন্টারসেপশন: ১৩-১২

কর্নার: ৫-৫

হলুদ কার্ড: ২-৩

ম্যাচের হিরো: মুর্তাদা ফল