রবিবার রাতে যে ভাবে শেষ মুহূর্তে গোল করে বেঙ্গালুরু এফসি-কে আইএসএল ফাইনালে তুলেছিলেন সুনীল ছেত্রী, সোমবার ঠিক সেভাবেই শেষ মুহূর্তের গোলে শিল্ডজয়ী মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে ফাইনালে তুললেন তাদের ২৪ বছর বয়সী মিজো মিডফিল্ডার লালেঙমাউইয়া রালতে, ভারতীয় ফুটবলে যিনি জনপ্রিয় আপুইয়া নামে।

সেমিফাইনালের প্রথম লেগে জামশেদপুরের কাছে ১-২ গোলে হেরেছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী। সেই হারও ছিল হাভিয়ে হার্নান্ডেজের শেষ মুহূর্তের গোলে। ফলে ঘরের মাঠে দ্বিতীয় লেগ থেকে ফাইনালে উঠতে অন্তত দু’গোলের ব্যবধানে জয় প্রয়োজন ছিল টানা দু’বারের শিল্ডজয়ীদের। সেই ২-০-র ব্যবধানেই জিতে ফাইনালে পৌঁছে গেল তারা। আগামী শনিবার ফাইনালে তাদের মুখোমুখি হতে চলেছে বেঙ্গালুরু এফসি। গত বার শিল্ড জেতার পরেও নক আউট ফাইনালে মুম্বই সিটি এফসি-র কাছে হেরে গিয়েছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী। এ বার ফের আইএসএলের ইতিহাসে জোড়া খেতাব জয়ের সুযোগ এসে গিয়েছে তাদের সামনে।

এ দিন শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে প্রবল চাপে রেখেও ৫০ মিনিট পর্যন্ত গোলের দরজা খুলতে পারেনি মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। ৫০ মিনিটের মাথায় নিজেদের বক্সের মধ্যে বলে হাত ছুঁইয়ে ফেলেন জামশেদপুরের ডিফেন্ডার প্রণয় হালদার। এই হ্যান্ডবলের ফলে পাওয়া পেনাল্টি থেকে প্রথম লক গেট খোলেন অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার জেসন কামিংস। এই গোলের পরে ফের যখন নিজেদের গোলের সামনে সারাক্ষণ দেওয়াল তুলে রাখে জামশেদপুর এফসি, কলকাতার দল এক গোলে এগিয়ে থাকায় যখন খেলা অতিরিক্ত সময়ের দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই সংযুক্ত সময়ে অসাধারণ ও বিশ্বমানের গোল করে দলকে ফাইনালে দেন আপুইয়া।

এই নিয়ে চলতি মরশুমে টানা ১২টি হোম ম্যাচ জিতল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, যা আইএসএলের ইতিহাসে এক অনন্য নজির। এই নিয়ে চতুর্থবার আইএসএলের ফাইনালে উঠল তারা। ২০২২-২৩ মরশুমে বেঙ্গালুরু এফসি-কে হারিয়ে ককাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারা। ২০২০-২১-এ মুম্বই সিটি এফসি-র কাছে হেরে রানার্স আপ হয়েছিল তারা। গতবার মুম্বইয়ের কাছেই হার মানতে হয়েছিল। এ বার ২০২২-২৩ ফাইনালের রিপ্লে হতে চলেছে আগামী শনিবার।

এ দিন দলে তিনটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামান মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট কোচ হোসে মোলিনা। আশিক কুরুনিয়ান, আপুইয়া ও জেমি ম্যাকলারেন দলে ফেরেন। মনবীর সিং ছিলেন বেঞ্চে। অন্যদিকে, জামশেদপুর এফসি তাদের তুরুপের তাস হাভিয়ে সিভেরিওকে শুরু থেকে না নামিয়ে বেঞ্চে রাখে। স্টিফেন এজের জায়গায় লাজার সিরকোভিচ ও আশুতোষ মেহতার জায়গায় রেই তাচিকাওয়াকে নামায় তারা।

শুরু থেকেই এ দিন প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। শুরুতেই বাঁ দিক দিয়ে ওঠা আশিক গোলের সামনে ক্রস বাড়ালেও বলে পৌঁছতে পারেননি ম্যাকলারেন। অনিরুদ্ধ থাপাও বক্সের বাইরে থেকে গোলে শট নিলে তার দখল নিয়ে নেন গোলকিপার আলবিনো গোমস। জেসন কামিংসও পরপর দু’বার গোলে শট নিয়েও লক্ষ্যভ্রষ্ট হন।

তবে ম্যাচের ১৮ মিনিটের মাথায় যে গোলের সম্ভাবনা বানচাল করে দেয় জামশেদপুর, তা সবুজ-মেরুন বাহিনীকে জোড়া গোল এনে দেওয়ার পক্ষে ছিল যথেষ্ট। প্রথমে আশিস রাইয়ের দূরপাল্লার শট বারের নীচ দিয়ে গোলে ঢোকার ঠিক আগে ফিস্ট করে বের করে দেন গোলকিপার আলবিনো। তার ফলে পাওয়া কর্নার থেকে দু-দু’বার গোলে শট নেন আলবার্তো রড্রিগেজ ও টম অলড্রেড। প্রথমবার সেভ করেন আলবিনো ও পরেরবার গোললাইনে দাঁড়িয়ে অনবদ্য হেড করে বের করে দেন সৌরভ দাস।

এই সময়ে জামশেদপুর এফসি-র অর্ধেই বেশিক্ষণ খেলা চলে এবং ঘন ঘন আক্রমণে ইস্পাতনগরীর ইস্পাতকঠিন রক্ষণকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে সবুজ-মেরুন বাহিনী। প্রথম আধ ঘণ্টায় ৭৫ শতাংশ বল ছিল মোহনবাগানের খেলোয়াড়দেরই পায়ে। তাদের স্ট্রাইকার জর্ডন মারে অবশ্য এর মধ্যে বারদুয়েক বিশাল কয়েথকে পরীক্ষার মুখে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন, তবে প্রতিবারই পরীক্ষায় উতরে যান গোলকিপার বিশাল।

মারে ছাড়া এ দিন ইস্পাতবাহিনীর প্রায় সব ফুটবলারকেই নিজেদের গোল এরিয়ায় দেখা যায়। তা সত্ত্বেও জায়গা তৈরি করে বারবার আক্রমণ হানেন সবুজ-মেরুন ফুটবলাররা। কিন্তু গোলকিপার আলবিনো এ দিন বেশ তৎপর ছিলেন।

ড্রিঙ্কস ব্রেকের পর ফের গোলে শট নেন কামিংস। একবার নয়, তিনবার। প্রথমবার তাঁর সোজাসুজি শট আটকে দেন আলবিনো। পরের বার ডানদিক থেকে তাঁর কোণাকুনি শট আলবিনোর আঙুল ছুঁয়ে অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়। তৃতীয়বার বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে গোলে শট নিলে ফের তার দখল নিয়ে নেন আলবিনো। প্রথমার্ধের সংযুক্ত সময়ে বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া কামিংসের ফ্রি কিক সোজা গোলের দিকে গেলেও ফের তা সেভ করেন আলবিনো।

প্রথমার্ধেই আধ ডজন সেভ করেন জামশেদপুরের গোলকিপার। মোহনবাগান যেখানে সাতটি শট গোলে রাখে, সেখানে জামশেদপুরের মোট শটের সংখ্যা ছিল তিন এবং তার মধ্যে একটি শট ছিল লক্ষ্যে। সবুজ-মেরুন বাহিনী যেখানে ৩০৫টি পাস খেলে, সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ৯৮টির বেশি পাস খেলার সুযোগ পায়নি।

দ্বিতীয়ার্ধেও দুই দলের কৌশল ও পরিকল্পনায় এতটুকু বদল হয়নি। শুরুতেই বক্সের বাঁ দিকে লাইনের ঠিক বাইরে ফ্রিকিক থেকে লিস্টন কোলাসো গোলের দিকে বল ঠেললেও তা ক্লিয়ার হয়ে যায়। কিন্তু ৫০ মিনিটের মাথায় প্রতিপক্ষকে গোলের সুযোগ করে দেন জামশেদপুরের বঙ্গতারকা প্রণয় হালদার। কর্নার ক্লিয়ার করতে গিয়ে বল হাতে লাগিয়ে ফেলেন তিনি। ফলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। এর আগে এক ঝাঁক লক্ষ্যভ্রষ্ট শট নিলেও পেনাল্টি থেকে জালে বল জড়াতে ভুল করেননি জেসন কামিংস (১-০)।

গোল খাওয়ার পরেই রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে হাভিয়ে সিভেরিও ও ঋত্বিক দাসকে নামান জামশেদপুরের কোচ খালিদ জামিল। লক্ষ্য অবশ্যই গোল শোধ করা। তবে সবুজ-মেরুন বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা এতটুকুও কমেনি, বরং ক্রমশ বাড়তে থাকে। ৫৮ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে ওঠা কোলাসোর ক্রসে হেড ফ্লিক করে গোলের দিকে বল ঠেলে দেন ম্যাকলারেন। কিন্তু তা অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়।

দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম কোয়ার্টারের পর থেকে অবশ্য বলের দখল বাড়িয়ে ম্যাচে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা দেখা যায় জামশেদপুরের খেলায় এবং এই সময়েই রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামেন মনবীর সিং। আশিকের জায়গায় মাঠে আসেন তিনি। উদ্দেশ্য অবশ্যই আক্রমণে তীব্রতা ফের বাড়িয়ে আধিপত্য ফিরিয়ে আনা। মনবীর মাঠে আসায় চেনা ছকে ফিরে যায় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। ডান উইংয়ে তিনি ও বাঁ দিক দিয়ে লিস্টন কোলাসো বল নিয়ে উঠতে শুরু করেন।

তবে প্রথমার্ধে ও দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম কুড়ি মিনিট যতটা আক্রমণাত্মক মেজাজে দেখা গিয়েছিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে, তার পর থেকে আক্রমণের গতি ও তীব্রতা- দুইই কমে যায়। সে জন্যই ড্রিঙ্কস ব্রেকের পর কামিংসকে তুলে নিয়ে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে নামান মোলিনা। কারণ, ফাইনালে পৌঁছতে তখনও তাদের আরও একটি গোল প্রয়োজন ছিল। তুমুল গরম ও আর্দ্রতার কারণে দলের ফুটবলাররাও ক্লান্ত হয়ে পড়তে শুরু করে। ক্রমশ তাদের আক্রমণে আগ্রাসন কমে আসে।

এই সুযোগ নিয়েই ইস্পাতনগরীর আক্রমণ জুটি মারে ও সিভেরিও আক্রমণে উঠতে শুরু করেন। এই সময়ে তারা একটি গোল শোধ করে দিতে পারলে সরাসরি ফাইনালের দরজা খুলে ফেলতে পারত। ফলে মাঝে মাঝে প্রতি আক্রমণে ওঠা শুরু করে তারা। পাঁচ মিনিটের সংযুক্ত সময়ে কোনও পক্ষ গোল করতে পারলে তারাই পেয়ে যেত ফাইনালের টিকিট এবং মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে সেই টিকিট এনে দেন তাদের তারকা মিডফিল্ডার আপুইয়া।

সংযুক্ত সময়ের চতুর্থ মিনিটে অসাধারণ এক গোল করে দলকে বহু আকাঙ্খিত দ্বিতীয় গোলটি এনে দেন আপুইয়া। বক্সের বাঁদিক থেকে কাট ব্যাক করে বক্সের সামনে আপুইয়াকে গোলের শট প্রায় সাজিয়ে দেন অনিরুদ্ধ থাপা। গোলের প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে অসাধারণ ও মাপা শট হাওয়ায় গতিপথ বদলে বারের ঠিক নীচ দিয়ে জালে জড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের আকাশ-বাতাস (২-০)।

চলতি আইএসএলে এটিই প্রথম ও একমাত্র গোল আপুইয়ার। এর আগে অনেক দূরপাল্লার শটে গোল করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু কোনও বারই সফল হননি। এ বার এমন এক মুহূর্তে সাফল্য চুম্বন এঁকে দিল তাঁর পায়ে, যখন তাঁর দল ছিল ফাইনালের দোরগোড়ায়। সারা ম্যাচেও মাঝমাঠে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ফলে অবধারিত ভাবে সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব তাঁর হাতেই ওঠে।

মোহনবাগান এসজি দল (৪-৪-১-১): বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, টম অলড্রেড, আলবার্তো রড্রিগেজ, শুভাশিস বোস, লিস্টন কোলাসো, অনিরুদ্ধ থাপা, আপুইয়া, আশিক কুরুনিয়ান, জেসন কামিংস, জেমি ম্যাকলারেন।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: মোহনবাগান এসজি ৭৩.৬% - জামশেদপুর এফসি ২৬.৪%, সফল পাসের হার: ৮৬%-৬৪%, গোলে শট: ১০-২, ফাউল: ৯-৮, ইন্টারসেপশন: ৬-৭, ক্রস: ৩৯-৬, কর্নার: ১২-২, হলুদ কার্ড: ১-৩।

ম্যাচের সেরা: আপুইয়া (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট)