এক বছরের অপেক্ষা শেষ। গতবার যা পারেনি তারা, এক বছর অপেক্ষার পরে সেই আফসোসই মিটিয়ে নিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বেঙ্গালুরু এফসি-কে ২-১-এ হারিয়ে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের দ্বিমুকুট জিতে নিল কলকাতার সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। নির্ধারিত সময়ে ফল ১-১ থাকার পর অতিরিক্ত সময়ে জয়সূচক গোল করে লিগের ইতিহাসে এই প্রথম দ্বিমুকুট জিতল হোসে মোলিনার দল। দেড় মাস আগেই লিগশিল্ড জিতে নিয়েছিল তারা। এ বার প্লে অফের চ্যালেঞ্জ জিতে কাপও জিতে নিল তারা। ভারতীয় ফুটবলে তৈরি হল এক নতুন ঐতিহাসিক মাইলফলক।

শনিবার ঘরের মাঠে নির্ধারিত সময়ের প্রথমার্ধে বেঙ্গালুরু এফসি আধিপত্য বিস্তার করলেও দ্বিতীয়ার্ধে খেলায় ফিরে আসে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ৪৯ মিনিটের মাথায় আলবার্তো রড্রিগেজের নিজগোলে এগিয়ে যায় বেঙ্গালুরু এফসি। ৭২ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে সেই গোল শোধ করে সবুজ-মেরুন বাহিনীর অস্ট্রেলিয়ান তারকা জেসন কামিংস। অতিরিক্ত সময়ে ছ’মিনিটের মাথায় আর এক অজি তারকা জেমি ম্যাকলারেনের গোলই শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক খেতাব এনে দেয় গঙ্গা পাড়ের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবকে।

দুর্দান্ত, ঐতিহাসিক জয়ের দিনে যে দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, তা বলা যায় না। সারা ম্যাচে ৩৮.৫ শতাংশ বল পজেশন ছিল তাদের। ৬৫ শতাংশ পাস নিখুঁত ছিল তাদের। তাদের ১৩টি শটের মধ্যে ছ’টি ছিল লক্ষ্যে, যেখানে বেঙ্গালুরুর ১২টির মধ্যে চারটি শট ছিল গোলে। বেঙ্গালুরুর তুলনায় পাসের সংখ্যাতে পিছিয়ে ছিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট (৫১২-৩১৮)। কিন্তু অতিরিক্ত সময়ের ওই একটি গোল এবং তার পরে নিজেদের রক্ষণকে নিশ্ছিদ্র করে তোলার ফল পায় বাগান-বাহিনী।

বেঙ্গালুরু এফসি শুরুর দিকে দাপুটে ফুটবল খেললেও ম্যাচ যত গড়ায়, ততই খেই হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে প্রতিপক্ষের গোলের সামনে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয় তারা। সুনীল ছেত্রী, আলবার্তো নগুয়েরা ও রায়ান উইলিয়ামসরা বারবার গোলের সুযোগ তৈরি করেও তাই কাজের কাজ কিছু করতে পারেননি। তুলনায় মোহনবাগানের নির্ভরযোগ্য তারকারা যেমন লিস্টন কোলাসো, অনিরুদ্ধ থাপা, মনবীর সিংরা চেনা মেজাজে ছিলেন না। তবু বাজিমাত করল তাঁদের দলই।

এ দিন আশিক কুরুনিয়ানের বদলে মনবীর সিংকে প্রথম এগারোয় রেখে দল নামায় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। অন্যদিকে, সুনীল ছেত্রী ও রায়ান উইলিয়ামসকে রেখে প্রথম এগারো বাছেন জেরার্ড জারাগোজা। দুই দলই আক্রমণাত্মক মেজাজে খেলা শুরু করে। ন’মিনিটের মাথায় জেমি ম্যাকলারেনের গোলমুখী শট সেভ করেন গুরপ্রীত। গুরপ্রীতর হাত থেকে বল ছিটকে বেরনো সত্ত্বেও অবশ্য তা গোলে পাঠাতে ব্যর্থ হন জেসন কামিংস। ১৮ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে ওঠা আশিস রাইয়ের ফরোয়ার্ড পাস থেকে মনবীর সিং বক্সের মধ্যে এক মাপা ক্রস বাড়ালেও তার নাগাল পাননি জেমি ম্যাকলারেন।

বেঙ্গালুরু প্রথম ভাল সুযোগটি পায় ১৯ মিনিটের মাথায়, যখন আলবার্তো নগুয়েরার কর্নার থেকে অনেকটা লাফিয়ে উঠে দুর্দান্ত গোলমুখী হেডফ্লিক করেন সুনীল ছেত্রী, যা গোল লাইনে দাঁড়িয়ে বুক দিয়ে আটকান শুভাশিস বোস। ফিরতি বলে ফের শট নেন রায়ান উইলিয়ামস। এ বার তা বাঁচান বিশাল কয়েথ।

কুড়ি মিনিট খেলা গড়ানোর পর থেকে আক্রমণে তীব্রতা বাড়ায় বেঙ্গালুরু এবং পরপর দু’বার গোলের সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেন উইলিয়ামস এবং নামগিয়াল ভুটিয়া। এই সময়ে পরপর কয়েকটি আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। প্রতি আক্রমণে উঠে এই চাপ কাটানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি তারা। চাপের মুখে ভুল ভ্রান্তিও হয় তাদের। এই সুযোগে চাপ বজায় রাখে নীল-বাহিনী। প্রথম আধ ঘণ্টায় তাদের দখলে ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ বল।

বেঙ্গালুরুর আক্রমণ বিভাগে সুনীল ছেত্রী ও আলবার্তো নগুয়েরা, দু’জনেই তৎপর ছিলেন এ এ দিন। ফলে তীব্রতায় সবুজ-মেরুন বাহিনীকে বেশ পিছনে ফেলে দেয় বেঙ্গালুরু এফসি। ৪০ মিনিটের মাথায় ডানদিক থেকে নগুয়েরা গোলের সামনে ক্রস বাড়ালেও এডগার মেনদেজকে বলের নাগাল পেতে দেননি সবুজ-মেরুন ডিফেন্ডাররা।

আক্রমণ তৈরি করলেও গোলে শট নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন সাফল্য পায়নি বেঙ্গালুরু এফসি। প্রথমার্ধে তারা পাঁচটি কর্নার আদায় করে নিলেও দু’টির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি। সেখানে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের একটি শট গোলে ছিল।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই যে সুযোগ পেয়ে যান মনবীর সিং, তাকে অনায়াসে সহজ সুযোগ বলা যায়। বাঁ দিক থেকে কামিংসের ভাসানো ক্রসে হেড করেন তিনি। কিন্তু অল্পের জন্য তা পোস্টের বাইরে চলে যায়। এরই মাশুল দিতে হয় তার পরের মিনিটেই, যখন ডান দিক থেকে রায়ান উইলিয়ামসের ক্রস বাইলাইনের বাইরে পাঠাতে গিয়ে নিজের গোলের দিকেই পাঠিয়ে দেন আলবার্তো রড্রিগেজ। আকস্মিক এই ভুলে হতভম্ব বিশাল কয়েথ বল আটকানোর সময়ই পাননি (১-০)।

এই গোলের আট মিনিট পরেই গোল শোধের অনবদ্য সুযোগ পান কামিংস। বক্সের বাইরে থেকে শুভাশিসের বাড়ানো বল বক্সের মাথায় যখন পান কামিংস, তখন তিনি শুভাশিসের দিকে মুখ করে ছিলেন। নিজের মার্কারকে সামলে গোলের দিকে ঘুরে তিনি সোজা গোলে শট নেন, যা অনবদ্য সেভ করেন গুরপ্রীত।

এ দিন লিস্টন কোলাসো ও অনিরুদ্ধ থাপা যতক্ষণ মাঠে ছিলেন, ততক্ষণ স্বচ্ছন্দে খেলতে পারেননি। তাঁদের এই পারফরম্যান্সের জন্যই দু’জনকেই একসঙ্গে তুলে নিয়ে সহাল আব্দুল সামাদ ও আশিক কুরুনিয়ানকে নামান সবুজ-মেরুন কোচ মোলিনা। মাঠে নামার পরই বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে একাধিক ডিফেন্ডারকে ডজ করে গোলে শট নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন সহাল।

গোল শোধের সুবর্ণ সুযোগ মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট পেয়ে যায় ৭০ মিনিটের মাথায়, যখন জেসন কামিংসের ক্রসে বক্সের মাথা থেকে গোলে শট নেন ম্যাকলারেন এবং তা আটকাতে গিয়ে বল চিঙলেনসানা সিংয়ের হাতে লাগে। রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজাতে দেরি করেননি। ৭২ মিনিটের মাথায় স্পট কিক থেকে গোল করতে ভুল করেননি কামিংস (১-১)।

এই গোলের চার মিনিট পরে ব্যবধান বাড়ানোরও সুযোগ পায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। বক্সের ডানদিক থেকে যে কোণাকুনি ক্রস দেন আশিস, তাতে হেড করে গোলের চেষ্টা করেন ম্যাকলারেন। কিন্তু মাথার ঠিক জায়গা দিয়ে হেড করতে না পারায় বারের অনেক ওপর দিয়ে বল উড়ে যায়। এই গোল পাওয়ার পর থেকেই মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে শুরু করে এবং ফের তারা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে।

এই সময়ে, ৮১ মিনিটের মাথায়, জয়সূচক গোল পাওয়ার উদ্দেশ্যে কামিংসকে তুলে গ্রেগ স্টুয়ার্টকে নামায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। এর ঠিক পরেই আশিকের ক্রস পেয়ে বক্সের মধ্যে থেকে ফের গোলে শট নেন ম্যাকলারেন। এ বারও তা চিঙলেনসানার গায়ে লেগে গোলের বাইরে চলে যায়। নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে কঠিন কোণ থেকে গোলে শট নেন আশিক। কিন্তু হাঁটু দিয়ে তা আটকে দেন গুরপ্রীত।

চার মিনিটের সংযুক্ত সময়ে বক্সের ডান দিক থেকে গ্রেগ স্টুয়াটের ক্রস যে ভাবে প্রায় গোল সাজিয়ে দিয়েছিল ম্যাকলারেনকে, অবিশ্বাস্য ভাবে সেই বলে পৌঁছতেই পারেননি অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার। অথচ সামনে গুরপ্রীত ছাড়া তখন আর কেউই ছিলেন না। এই বলে ঠিকমতো শট নিতে পারলে অবধারিত গোল পেতেন তিনি এবং ম্যাচটা অতিরিক্ত সময়ে গড়াতও না।

অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই শুভাশিসকে তুলে নিয়ে দীপক টাঙরিকে নামান মোলিনা। অর্থাৎ, মাঝমাঠে লোক বাড়িয়ে খেলা শুরু করে তারা। তবে শুরুতেই গোলের সুযোগ পেয়ে যায় বেঙ্গালুরু, যখন ডান উইং থেকে নেওয়া রায়ান উইলিয়ামসের শট আববার্তোর গায়ে লেগে গোলের ডান কোণের দিয়ে উড়ে যায়। কিন্তু তা অনবদ্য সেভ করেন বিশাল।

তবে দ্বিতীয় গোলটি করতে বেশি সময় নেয়নি সবুজ-মেরুন বাহিনী। ৯৬ মিনিটের মাথায় প্রতিপক্ষের বক্সের ডানদিকের কোণ থেকে বক্সের মাঝখানে বল বাড়ান স্টুয়ার্ট। সেই বল পেয়ে প্রায় ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গোলে শট নেন ম্যাকলারেন। এবার আর তাঁর শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি (১-২)।

এই গোলের পরে অবশ্য বেশিক্ষণ ম্যাকলারেনকে মাঠে রাখেননি মোলিনা। ১০২ মিনিটের মাথায় তাঁর বদলে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে নামান তিনি। লক্ষ্য আরও একটি গোল। ম্যাচে আধিপত্য বাড়ানোও ছিল আর এক উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই প্রতিপক্ষের বক্সের সামনে থেকে পাওয়া ফ্রি কিক সোজা গোলে পাঠানোর চেষ্টা করেন সুনীল ছেত্রী, যা বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এর পরে বারবার গোলের চেষ্টা করেও মোহনবাগান ডিফেন্ডারদের তৎপরতায় তাদের গোলের কাছে ঘেঁষতে পারেননি সুনীলরা।

মোহনবাগান এসজি দল (৪-২-৩-১): বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, টম অলড্রেড, আলবার্তো রড্রিগেজ, শুভাশিস বোস (দীপক টাঙরি-৯১), অনিরুদ্ধ থাপা (সহাল আব্দুল সামাদ-৬২), আপুইয়া, লিস্টন কোলাসো (আশিক কুরুনিয়ান-৬২), জেসন কামিংস (গ্রেগ স্টুয়ার্ট-৮১), মনবীর সিং, জেমি ম্যাকলারেন।

বেঙ্গালুরু এফসি দল (৪-৩-৩): গুরপ্রীত সিং সান্ধু (গোল), নামগিয়াল ভুটিয়া (ফানাই-৬০), চিঙলেনসানা সিং, রাহুল ভেকে, রোশন সিং, আলবার্তো নগুয়েরা, পেদ্রো কাপো, সুরেশ সিং (মহম্মদ সালাহ-৯০), রায়ান উইলিয়ামস, এডগার মেনদেজ (পেরেইরা দিয়াজ-৬৮), সুনীল ছেত্রী।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: মোহনবাগান এসজি ৩৮.৫% - বেঙ্গালুরু এফসি ৬১.৫%, সফল পাসের হার: ৬৫%-৭৮%, গোলে শট: ৬-৪, ফাউল: ১৪-১৭, ইন্টারসেপশন: ৮-১২, ক্রস: ২৫-৩৬, কর্নার: ৬-৮, হলুদ কার্ড: ৪-৩।

ম্যাচের সেরা: জেমি ম্যাকলারেন (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট)